সাত কন্যা সন্তান জন্মের পরে আমার জন্ম। ঠাকুরদাদা নাম রেখেছিলেন জ্যোতির্ময়। ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট, এই শ্লোগান তখন চালু হয়নি। তাছাড়া বংশ রক্ষার্থে হিন্দু সংসারে ছেলে যে কতটা অপরিহার্য তা তৎকালীন সময়ে সবাই বুঝত, জানতো। এখনো যে এই চিন্তাধারার অবসান হয়েছে তা হলফ করে বলা যায় না।

বাবা মার অত্যন্ত আদরে বড় হচ্ছিলাম। দিদিরা একটা তুলতুলে জীবন্ত পুতুল পেয়ে আনন্দে থাকত সবাই। পাঠশালা, হাইস্কুল হয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে সরকারী ব্রজমোহন কলেজে অধ্যয়নের সময়েই কিছুটা উচ্ছন্নে যাই আমি। এমনিতেই বাবা মা দিদিদের আদরে লালিত পালিত হওয়ায় ছোট বেলা থেকেই সব আবদার পুরন হওয়ায় উচ্ছন্নে যাওয়ার প্রথম ধাপে বাড়িতে থাকাবস্থায়ই সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কলেজ জীবনে তার ষোল কলা পূর্ণ হয়েছিল। সিগারেট তো ছিলোই, সাথে মাসে হোস্টেলে মাসে দু একবার মদের আড্ডাও হতো আমারই রুমে। ধনী আড়ৎদার পুত্রের এমন একটু আধটু বদভ্যাস তখন তেমন দোষের কিছু ছিলো না।

কলেজ জীবনটা স্বপ্নের মতই কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই বাবা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হলেন। বড় চার দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে ততদিনে। বাবা অসুস্থ হওয়ায় আড়ৎদারি ব্যবসায় প্রায় ধ্বস নামে। সেই উচ্ছন্নে যাওয়া আমি কিভাবে যেন বড় হয়ে গেলাম বাবার অসুস্থ হবার ছয় মাসের মধ্যে। পড়াশুনা বাদ দিয়ে সংসারের, ব্যবসার হাল ধরলাম। দিদিরাও কেমন অবাক বিস্ময়ে দেখতো আমাকে কিভাবে আদরের জ্যোতির্ময় তাঁদের থেকে বড় হয়ে গিয়ে, বড় ভাইয়ের মত দায়িত্ব পালন করছে।

তিন দিদিরই যথা সময়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম মহা ধুম ধামের সাথে। ঠাকুর দাদাও চলে গিয়েছেন স্বর্গে। অসুস্থ বাবা, মা আর আমি মিলে সংসারে তিনজন মাত্র। মার কস্ট হয় বাবার সেবা করে সংসার সামলাতে। অবধারিত ভাবে আমার বিয়ের প্রশ্ন চলে আসে। প্রথমে একটু অরাজি হলেও পরে সিদ্ধান্ত নেই বিয়ে করার। সংসারে আমিই তো কর্তা। খুঁজে পেতে পটুয়াখালীর বিখ্যাত মজুমদার বাড়ির ছোট মেয়ের সাথে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো।

পাটিপত্র, পানখিল, দধি মঙ্গল, গায়ে হলুদ, শঙ্খ কঙ্কন ইত্যাদি আচার শেষ হয়েছে। বিয়ের লগ্ন রাত বারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। বাসার পাশেরই রঙ্গলাল পালের শ্রাবনী গাড়ি রিজার্ভ করা হলো বরযাত্রার জন্য। পটুয়াখা্লী যেতে তখন পাঁচটি  ফেরি। এখনকার মত সেতু হয়নি তখন। চার পাঁচ ঘন্টা লাগে যেতে। বিয়ের লগ্ন যেহেতু বারোটার পরে, তাই বিকেল পাঁচটায় বন্ধু হেলাল, দুলাল, শ্যাম, নারায়ন, পরিমল, নাসির সহ অন্যান্য বর যাত্রী সহযোগে পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রাত দশটার মধ্যে পটুয়াখালী পৌছাতে পারব।

দপদপিয়া ফেরী পার হয়ে লেবুখালি ফেরি ঘাটে এসে দীর্ঘ জ্যাম। দুই ঘন্টার বেশি লেগে গেলো ফেরির অন্য পাড়ে পৌছাতে। সামনে আরো তিনটি ফেরি। লেবুখালি ফেরির জ্যাম তো সামনেও আছে। চিন্তায় পরে গেলাম লগ্নের পূর্বে পৌছাতে পারব তো? ঘড়ির কাটা থেমে নেই, অথচ আমরা পথে তখনো। শেষ পটুয়াখালীর ফেরিতে যখন গাড়ি উঠলো তখন রাত সারে এগারোটা। টেনশন কমাতে দুলালের পকেটে থাকা রাম এর বোতল থেকে এক সিপ মেরে দিলাম। পটুয়াখালী প্রান্তে ফেরি থেকে গাড়ি নামলো রাত বারোটায়। আরো পনের কুড়ি মিনিট লাগবে বিয়ে বাড়ি যেতে।
আমাদের সবার টেনশন তো আছেই, কনে বাড়ির টেনশন কতটা তা ভাবছি।

ওই তো এসে গিয়েছি কনে বাড়ি। গেটে আলোকসজ্জা। লগ্নের বাকি আছে আর মাত্র দশ মিনিট।
গেটে গাড়ি থামতেই  উলুধ্বনি দিয়ে আমাদের বরন করা হলো। কন্যাপক্ষ অস্থির হয়ে আছে আমাদের জন্য, কনে লগ্ন ভ্রষ্টা না হয় আবার।  একজনে বললো' দ্রুত করেন লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে বর বরণ করলেন আমার হবু শাশুড়ি মা,  তার হবু জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান দুর্বা ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে। এরপর দৌড়ে গিয়ে বসলাম বিয়ের পিড়িতে। সাত পাক বা সপ্তপদীর জন্য কনেকে পিড়িতে বসিয়ে আনা হলো, কনের জামাই বাবুরা পিড়ি বয়ে নিয়ে এলেন, কনের মুখ পান পাতা দিয়ে ঢাকা। সাত পাক ঘোরা র পরে বিভাহোমা অর্থাৎ আমি ও আমার স্ত্রী আগুনের সামনে প্রার্থনা করলাম।


এরপর শুভদৃষ্টির সময়ই বাঁধল বিপত্তি। এ কাকে বিয়ে করলাম আমি? যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল এতো সে নয়! হিন্দু বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে, এটি আর শোধরানোর উপায়ও নেই। আমার মুখ এতক্ষন সাদা লাল শোলার ফুলে ঢাকা ছিল। আমাকে দেখে বিশাল হুলুস্থুল বিয়ে বাড়িতে। শ্রাবন্তি তাকিয়ে আছে আমার দিকে ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তার চোখে মুখে মুগ্ধতা ছিল, আমারো। এমন অপরূপা মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।

ঘটনা হচ্ছে, একই পাড়ায় দুটো বিয়ের অনুষ্ঠান। প্রথম যেটায় আলোকসজ্জা আর গেট দেখেছে গাড়ির ড্রাইভার, সেখানেই গাড়ি দার করিয়েছে। কনে পক্ষও অপেক্ষায় ছিল তাঁদের লগ্ন বয়ে যায় যায় অবস্থায়। অতিরিক্ত টেনশনে সব ওলট পালট হয়ে গিয়েছে।

বিয়ের পুরোহিত সহ অন্যান্য সবার মতে আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত হলে শুভদৃষ্টি, মালা বদল, সম্প্রদান, অঞ্জলি, সিঁদুর দান এসব আচার শেষে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

পুরোহিতের বলা মন্ত্র তখনো আমার হৃদয়ে আলোড়ণ তুলছে।
“যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।”
—তোমার এই হৃদয় আমার হোক আমার এইহৃদয় তোমার হোক।


সেদিন থেকে শ্রাবন্তি আমার জন্ম-জন্মান্তরের সাথী হয়ে আছে।

0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ