বাংলাদেশে ঘুষ ব্যতীত কোন কাজ সম্পাদন হয় কিনা আমার জানা নেই। আমার পেশাদারী জীবনে ঘুষ প্রদান ব্যতীত আমি কোন কাজ করাতে পারিনি। একটি মাত্র ব্যতিক্রম আছে অবশ্য। ঠিকাদারি জীবনের একেবারে প্রথম দিকে একজন উপজেলা প্রকৌশলী যার নাম শহিদুল ইসলাম, তিনি আমার কাছ হতে ঘুষ নেন নি। পরে জেনেছি উনি কারো কাছ হতেই ঘুষ নেন না। যে দেশে ঘুষ নেয়া দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, সে দেশে একজন শহিদুল ইসলাম ব্যতিক্রম হবেন বা খবরের শিরোনাম হবে এটিই স্বাভাবিক। সমস্ত ঘুষখোরদের মাঝে এক নিঃসঙ্গ শহিদুল ইসলাম আর দেশেই থাকতে পারেন নি। চাকরী ছেড়ে দিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছেন পরিবার সহ। ঘুষ না খাওয়ার অপরাধে তাঁর এই দেশান্তর। শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে, যিনি মাথা নত করেন নি বা সবার মত হতে পারেননি।

৩৮ বছরের পেশাদারী জীবনে বিভিন্ন অফিসের সামান্য গার্ড হতে সচিব পর্যন্ত সবাই ই ঘুষ নিয়েছেন অবলীয়ায়। প্রথম প্রথম যৌবনের তেজে ঘুষ দিতে অস্বীকার করতাম। ফলাফল- বিভিন্ন অযুহাতে ফাইল ঘুড়তে থাকতো। এরপর সিস্টেম শিখে গিয়েছি বা সিস্টেমে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। অফিসের পিওনকে দু একশ টাকা না দিলে তাঁর বাথরুম পায়, স্যার ডাকে, মিটিং এ ডিউটি আছে ইত্যাদি বলে ফাইল এক টেবিল হতে অন্য টেবিলে যেতো না।
আবার সচিব মহোদয় ' জিসান সাহেব এই সপ্তাহে অনেক মিটিং আছে, ফাইল দেখতে পারা সম্ভব হবে না। আগামী সপ্তায় আসেন ।' এমন কথায় প্রথম প্রথম মন খারাপ করে ফিরে আসতাম। পরে এমন করেছি যে,

'জিসান সাহেব এখুনি দেখে দিচ্ছি ফাইল, কতদূর- সেই বরিশাল  হতে আসেন, আপনাকে কিভাবে বসে থাকতে বলি?'

কেবল সরকারী কর্মকর্তা নয়, ঘুষ দিয়েছি মন্ত্রী, এমপিদেরও। তবে নিজের অভিজ্ঞতায় একটি সত্যি কথা উল্লেখ করতেই হয়, যে পরিমান ঘুষ মন্ত্রী, এমপিদের দিয়েছি, তার কয়েকশত গুন বেশী দিয়েছি সরকারী কর্মকর্তাদের। সরকারী কর্মকর্তারা সুকৌশলে নিজেদের ঘুষ খাওয়াটা মন্ত্রী, এমপিদের উপর চাপিয়ে দেন। একারণেই সমস্ত অপবাদ জোটে সরকারী দলের, আর ফুলের মত চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকেন সরকারী কর্মকর্তারা। সরকার পরিবর্তন হয়ে যায় দুর্নীতির কারণে, আর যারা সবচেয়ে বেশী দুর্নীতিবাজ তারা চাকুরীতে বহাল থাকেন ভালো চরিত্রের অধিকারী হয়ে।

আওয়ামীলীগ এর প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাহেব (ওনার যুক্তিতে ঘুষ অবৈধ নয় , < লিংকে ক্লিক করে বাংলা নিউজ ২৪ এর খবরটি পড়ুন ) এই ঘুষকে স্পিড মানি হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, স্পিড মানি ছাড়া কাজ থমকেই থাকে। আমার এই লেখায় যে সমস্ত স্থানে ঘুষ শব্দটি আছে, সে শব্দটি স্পিড মানি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।

সাত জুলাই ২০২২ ইংরেজি তারিখের অভিজ্ঞতাঃ
জেলার একটি রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েছিলাম একটি দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য। রেজিস্ট্রি অফিসের হেড ক্লার্ক চেয়ারে ছিলো না। তাই টেবিল সহ রুমের সব কিছুর উপর একটু নজর বুলালাম।


উপরের ছবিটায় অস্বাভাবিক কিছু নজরে পরছে আপনাদের? 


সম্ভবত নজরে পরেনি। এবার দেখুন ভালো ভাবে। চেয়ারে একটি ব্যাগ ঝুলানো। ব্যাগের চেইনটি খোলা।
কিসের জন্য এই ব্যাগ? স্পিড মানির জন্য। প্রতিদিন অনেক জনগন রেজিস্ট্রি অফিসে যান। জমি দলিল রেজিস্ট্রি, হেবা, দানপত্র, ঘোষনা পত্র, দলিলের নকল, সার্চিং ইত্যাদি কাজে জনগন ছুটে আসেন এই অফিসে।
সময়ের অনেক মূল্য অফিসের হেড ক্লার্কের। বারবার ব্যাগের চেইন খুলে আবার আটকানো- অনেক সময়ের ব্যাপার। অথবা ড্রয়ার খোলা আবার আটকানো, তাও ঝামেলার। সুতরাং সবই যখন ওপেন সিক্রেট কেন এই লুকোচুরি? চেইন খোলা ব্যাগেই টাকা দিতে হয় এখানে আগত জনগনকে। আমিও দিয়েছি। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা রেট। এই যে স্পিড মানি, তা সবাই মেনে নিয়েছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা এটি। কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে যদি স্পিড মানি না দেয়া লাগে তবে তা অস্বাভাবিক হিসেবেই গন্য হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকলেও সার্ক ভুক্ত দেশ সমূহের (দক্ষিণ এশিয়া) মধ্যে দুর্নীতিতে ২য় সেরা অবস্থানে বাংলাদেশ।

অদ্য ১২ জুলাই ২০২২ এর The Daily Star এর সংবাদটি পড়ুন >  এখানে ক্লিক করে

নিজের পেশাগত জীবনের বিভিন্ন অফিসে দেয়া স্পিড মানির কিছু মজাদার অভিজ্ঞতাও আছে আমার। যা ধীরে ধীরে সোনেলার পাঠকদের জানানোর ইচ্ছে আছে।

শুভ ব্লগিং।

 

 

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ