সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার এই তারকা ক্রিকেটার সবধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন। তিনি জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও সে কথা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কে জানাননি। দুই বছর আগে আইপিএলে খেলতে গিয়ে জুয়াড়িদের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বিষয়টি কাউকে জানাননি এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল আগামী দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছে সাকিবকে।

নিজের দোষ স্বীকার করায় তার এক বছরের সাজা স্থগিত করা হয়েছে। এই এক বছর তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করবে আইসিসি। তারা সন্তুষ্ট হলে আপাতত এক বছরের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে সাকিব আল হাসানকে। আগামী বছরের ৩০ অক্টোবর থেকেই তিনি মাঠে নামতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল থেকে প্রাপ্ত সূত্র হতে জানা যায়, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে সাকিবকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আইসিসি।

আইসিসি'র ভাষ্যমতে -

২০১৭ সালে সাকিব আল হাসানের সাথে একজন ব্লাক লিস্টেড বুকি দিপাক আগারওয়ালের যখন যোগাযোগ হয় তার আগেই সাকিব জানতেন যে দিপাকের কাছে সাকিবের নাম্বার দেয়া হয়েছে। দিপাক সাকিবকে তার সাথে দেখা করার অনুরোধ জানান এবং আরো কিছু ক্রিকেটারের ফোন নম্বর চান। দিপাকের সাথে যোগাযোগের এই বিষয়টি সাকিব আইসিসিকে জানাননি।

এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে ত্রিদেশীয় সিরিজের বিষয়েও দিপাক আগারওয়াল ও সাকিবের মধ্যে আবারও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ১৯শে জানুয়ারি একটি ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য দিপাক আগারওয়াল সাকিব আল হাসানকে অভিনন্দনও জানান।

আইপিএলের ২৬ এপ্রিল ২০১৮ তে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ এবং কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব এর মধ্যে যে ম্যাচটি ছিল সেই ম্যাচে একজন জুয়াড়ি সাকিবকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেন এবং সাকিব সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

এসব ঘটনার একটিও সাকিব আইসিসিকে জানাননি যা ক্রিকেটের নিয়ম বহির্ভূত অপরাধ। আইসিসি স্পষ্ট করে বলেছে- সাকিব আল হাসান আইসিসি'র এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেননা অর্থাৎ এ শাস্তি তাকে মেনে নিতেই হবে।

সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব হয়েও কি করে এমন ভুল করেছেন সেটা সবার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভ। বাংলাদেশ দলের খেলায় তার উপস্থিতি অন্যান্যদের অনুপ্রেরণা যোগায়, সাহস দেয়। তাই তার মতন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন ভুল আশা করা যায়না।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলা প্লেয়ারদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে তার নেতৃত্বে ছিলেন সাকিব আল হাসান। এ আন্দোলনের ফলে দেশের ক্রিকেটে এক অনিশ্চয়তার ঘোর আমাবস্যা নেমে এসেছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তাগন থেকে শুরু করে ক্রিকেটপ্রেমীদের সবাই অকূলপাথারে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ক্রিকেটারদের দাবীগুলি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে প্লেয়াররা সেই আন্দোলন স্থগিত করেন।

আগামী মাসে ভারতের সাথে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি এবং দিবা রাত্রির টেস্ট ম্যাচ রয়েছে যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নতুন সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে খেলা দেখার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। এমন একটি সময় সাকিবের দলে অনুপস্থিতি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যে কিছুটা চাপের মুখে ফেলবে তা বলাই বাহুল্য। অনেকে মনে করছেন, এতদিন আগের ঘটা সাকিবের সেই ঘটনাগুলি ঠিক এই মুহূর্তেই কেন প্রকাশ পেলো? তাহলে কি সাকিবের এই সাজায় তিনি কারও ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার? এর পিছনে কোন অশুভ শক্তির ইন্ধন আছে কিনা সেটি নিয়েও সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করছেন এদেশের ক্রিকেট প্রেমীগন।

অনেকেই বলেছেন, সাকিবের বিষয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা আইসিসি'র মাধ্যমে কি জানতেন না? তাহলে সাকিবকে কেন তারা জানাননি এ বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে। আমাদের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীদের জিজ্ঞাসা- কেন আন্দোলনের ঠিক পরেই নেতৃত্বদানকারী সাকিবের এমন দুর্দশা?

এই প্রসঙ্গে একটু বলতে চাই- আশরাফুল, আজহার উদ্দিন, হ্যানসি ক্রনিয়ে এদের কথা কি মনে আছে? জুয়াড়িদের সাথে আঁতাতের কারনেই এদের কঠোর সাজা ভোগ করতে হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন প্লেয়ারের এমন ভুল কিন্তু মেনে নেয়া যায়না। বাস্তবতার নিরিখে সবারই বিষয়টি ভাবতে হবে। বুকিদের সাথে ক্রিকেট প্লেয়ারদের এমন ঘটনা ক্রিকেটবিশ্বে এর আগেও ঘটেছে এবং তা চরম ন্যাক্যারজনকও বটে। তাই আইসিসি ক্রিকেটের দুর্নীতির বিষয়ে চরম সংবেদনশীল এবং তারা সবসময় এসব পর্যবেক্ষণ করে।

ক্রিকেট নিয়ে দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান The anti corruption and security unit (ACSU) বাংলায় যেটি আকসু নামে পরিচিত তারা সাকিবের বিষয়টি গত জানুয়ারি মাস থেকেই পর্যালোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। আকসু একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তাদের কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই এবং যে কোন দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড় ও সেই দেশকে বা দেশের ক্রিকেটবোর্ডকে কোন তদন্তের বিষয়ে তারা জানাতে বাধ্য নয়। তাই একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সাকিবের এই সাজার পিছনে এদেশের কারোরেই হাত নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ আইসিসি'র এখতিয়ারভুক্ত।

সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি অপূরণীয় সম্পদ, গোটা বিশ্বের ক্রিকেট খেলোয়ার এবং ভক্তদের আইকন। তাই তাকে নিয়ে কেউই ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে এদেশের ক্রিকেটের কোন ক্ষতি চাইবেনা এটা নিশ্চিত। সাকিব যেটি করেছেন সেটি অপরপক্কতার পরিচয়, হেলায় গা ভাসানো। এমন সংবেদনশীল বিষয়গুলি অবশ্যই তার বিসিবি এবং আকসুকে জানানো উচিত ছিলো।

সাকিব জুয়াড়িদের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে নিজের নৈতিকতা কিছুটা হলেও বজায় রেখেছেন। এই ঘটনা থেকে আমাদের দেশের ক্রিকেটারদের এবং ক্রিকেটবোর্ডের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে তা বলাই বাহুল্য। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা কিন্তু এই ভদ্রোচিত খেলায় জুয়াড়িদের আনাগোনা, ম্যাচ ফিক্সিং এবং এর সাথে জড়িত খেলোয়াড় সেই দেশকে, দেশের ক্রিকেটভক্তদের এক লজ্জাস্কর পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। তবুও যেন জেনেশুনে ক্রিকেটাররা এমন ফাঁদে পা দেয়, দিচ্ছে, কেন? কারণ অর্থ ও প্রতিপত্তি। অর্থের মোহে তারা নিজেদের নৈতিকতা থেকে সরে আসেন। দেশের প্রতি নিজেদের দায়িত্ববোধ ভুলে যান আর সেই দেশের মানুষকে পুরো ক্রিকেট দুনিয়ার সামনে অপমানিত হতে হয়।

সে দিক থেকে সাকিব অন্তত একটি ভালো কাজ করেছেন তা হলো জুয়াড়িদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি এবং আমি বলবো তিনি প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু বিসিবি এবং আইসিসিকে এই তথ্য গোপন করার মতো যে ভুল তিনি করেছেন তার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে এটি কিছুতেই আশা করা যায় না। হতে পারে তিনি হয়তো জলঘোলা করতে চাননি কিংবা এসব বলেন নিজের ক্রিকেটের ক্যারিয়ারে কোনো কালো দাগ লাগাতে দিতে চাননি। তবে যেহেতু বিষয়টি আমাদের নিজের দেশ এবং দেশের ক্রিকেটের সাথে জড়িত, সেই সাথে জড়িত কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তের আবেগ- তাই এই অনুভূতিতেও তিনি যে আঘাত করেছেন সেটাও তাকে বুঝতে হবে।

আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি, ভালোবাসি আমাদের ক্রিকেটারদের। এই ভালোবাসা থেকেই সাকিবের অন্যায়কে আমরা ভুল বলে সম্বোধন করছি। কিন্তু তার এই ভুলের মাসুল গুনতে হবে আমাদের ক্রিকেটকেই। একজন সাকিব একদিনে তৈরী হয়না, দলে সাকিবের অনুপস্থিতি দেশের ক্রিকেটারদের কতটা চাপের মুখে ফেলবে তা ভেবে বাকী ক্রিকেটারদেরকেও শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডকেও প্লেয়ারদের সাথে নিজেদের দূরত্ব ঘোচাতে হবে, প্লেয়ারদের সাথে নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক মেলবন্ধন বাড়াতে ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহনকরতঃ তাদের আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের এখন উত্থানের যুগ, এমন সময় সাকিবের এই শাস্তি দেশের ক্রিকেটকে কিছুটা হলেও স্থবির করে দেবে অবশ্যই। তবে আমরা বীরের জাতি। আমরা জানি সমস্ত বাধাবিপত্তি পেড়িয়ে কিভাবে লড়তে হয়। আমাদের দেশ ক্রিকেটপাগল ভক্তে পরিপূর্ণ। সাকিবের পাশে আমরা সবাই আছি।

সাকিব তার বক্তব্যে বলেন- তিনি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছেন -তিনি আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবেন ক্রিকেট মাঠে এবং আমরাও এটাই চাই। একজন সাকিব আল হাসান তার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি নব উদ্যমে ফিরে আসুন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সব ক্রিকেটারগন ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন, দেশ এবং দেশের ক্রিকেটকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন এই হোক আমাদের প্রত্যেক ক্রিকেট খেলোয়াড়ের গৃহীত শপথ। তাদের দিকেই যে পথ চেয়ে আছে বাংলাদেশের লক্ষকোটি ক্রিকেটভক্ত।

0 Shares

৩৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ