
= বাবা কি করো?
– আমি ব্রীক ফিল্ডে মা
= এখন দুপুর কটা বাজে খেয়াল আছে? এই মূহুর্তে বাসায় যাও, দ্রুত শাওয়ার নিয়ে খাবে।
– ঠিক আছে মা।
ত্রিশ মিনিট পরে আবার
= বাবা কোথায় তুমি?
– আমি বাসায় মা
= ঠিক বাসায় তো বাবা?
– হ্যা মা।
= বাবা রাত কটা বাজে এখন?
– এগারোটা মা
= তুমি এখনো জেগে আছো কেন? ডাক্তার কখন তোমাকে ঘুমুতে বলেছেন?
– রাত দশটার মধ্যে?
= এখন আর অনলাইনে যেন আর দেখিনা তোমাকে। সব বন্ধ করে ঘুমাবে।
– আচ্ছা মা, ঘুমাব।
এমন খবরদারি চালাতো রোজ পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই। এমন একটি দিন নেই যেদিন ও তিনবেলা আমি খেয়েছি কিনা, ঔষধ খেয়েছি কিনা, দুপুরে রাতে সময়মত খাই কিনা এসব জিজ্ঞেস না করতো। আমার মেয়ে নেই, ওর মাঝেই আমি আমার মেয়েকে খুঁজে পাই। এমন ধরনের কথা আর কত লিখবো
২০১৪ সনের ১ জুন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি যাই আমি। সিডনি থাকাবস্থায়ও ওর এমন খবরদারি চলছিল। আমিও ওর কথা মানতাম আসলে।ভালো লাগতো ওর এমন খবরদারি করা। জুনের সাত তারিখে সিডনি থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর যাই। কুয়ালালামপুর থাকাবস্থায়ও নিয়মিত খোঁজ খবর নিতো। বারো তারিখ রাতে হঠাৎ করে বললো ‘ বাবা আমার জানি কেমন লাগছে, তুমি প্লিজ এখন একবার কল দাও আমাকে’।
কল দিলাম, কেমন বিষন্ন গলা, কেমন এক অস্থিরতা।
= বাবা তোমার সাথে এ জীবনে আমার কি দেখা হবেনা? (বলেই কেঁদে ফেললো মেয়েটা আমার।) – কেন হবে না মা? আমি তো আগামীকালই বিমানে উঠবো। কাঁদিস না মা।
= তুমি আগামী কালকেই আসবে। এসেই আমার সাথে চৌদ্দ তারিখ দেখা করো বাবা।
– আচ্ছা মা চৌদ্দ তারিখেই দেখা করবো।
আমার মনটাও খুব বিষণ্ণ হয়ে গেলো। মেয়েটা এমন করে কাঁদেনি কখনো। ওর কান্নার আওয়াজ যেন শুনতেই থাকলাম পরদিন বিমানে ওঠার পরেও। বিমানে বসে খাবার সময় এমন জোরে আমার ঠোটে কামড় লাগলো যে রক্ত বেড় হয়ে গেলো। সাথে সাথে মেয়ের কথা মনে পরে গেলো। তখন বাংলাদেশ সময় তিনটা দশ। মেয়ের কথা মনে আসার পরই মনটা আবার বিষণ্ণ হয়ে গেলো, চোখ দিয়ে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
চৌদ্দ তারিখ সকাল দশটায় ফেইসবুকে এক ছেলে মেসেজ দিলো, আপনি মেঘ পরীর বাবা? আপনার মেয়ে গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে জানেন আপনি?
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে গেলাম। জানলাম গতকাল তিনটা দশেই দুর্ঘটনা হয়েছে, যখন বিমানে বসে খাবার সময় আমার ঠোঁটে কামড় পরেছিল। গাড়িতে মেঘ পরী আর ওর আম্মু ছিলো। দুজনেই স্পট ডেথ।
আমি আর লিখতে পারছি না এখন। আমার মেয়েটা যেন আল্লাহর কাছে পরীর মতই শান্তিতে থাকে এমন দোয়া করুণ সবাই।
মেয়েটা বেঁচে থাকলে সোনেলা নিয়ে কত আনন্দ করতো এখন।
স্বর্গের মেঘ পরীর সর্ব শেষ কবিতা । তাঁর ফেইসবুক আইডি থেকে নেয়া ।
” অদৃশ্য অনুভূতি “
——স্বর্গের মেঘ পরী
তোমার ছোঁয়ায় ,
রঙিন হয় আমার
প্রত্যেকটা অনুভব,
হয়তো প্রলাপ,
হয়তো সমুদ্রের
পাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউ ,
তবু মনের আকাশে
তারা ফুটে ওঠে অনর্গল, তছনছ
হয়ে যায় শেষ ইচ্ছা,
স্মৃতিহারা বইয়ের পাতা খুলে দেয়
নড়বড়ে সবকটা অর্গল,
জানি কাঁটা আছে,তবু গোলাপের
আশায়
স্বর্গীয়স্পর্শী মায়াবী চাহনি ৷
সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে, তার
বুকের উপর জানি ধূলোঝড়
ঢাকবে মিনার,
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা,
কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।
রাতপরীদের চুপকথা বার্তাবহ,
যাযাবর
জীবনের হাতছানি,রূপোলি জল শুয়ে- শুয়ে স্বপ্ন দেখছে;
সূর্যের চুম্বনে।- সোনার
শেকলে বাঁধে সংসার,যন্ত্রণা দুঃসহ ৷
ইচ্ছেডানা ভেঙ্গে গেছে কবেই ,
বোবা চোখে অমোঘ ,
ছুঁয়ে দিলে তুমি ভুল করে,
কতোটুকু বিষ রেখেছো আড়াল কোরে সোনালী ঐ প্রেমের পাশে ! তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত
তান দিগন্ত থেকে দিগন্তে ।
( তারিখ: ১০ জুন ২০১৪ )
সোনেলায় তাঁর শেষ লেখা –
” ছিন্ন ভালবাসা “
না পাওয়ার বেদনা বুকে নিয়ে
আমি ও একদিন হারিয়ে যাবো দূর
থেকে দূরান্তরে ।
চোখের কার্নিশ
থেকে মিথ্যে ভালবাসার মায়াজাল,
ছিন্ন করে বলব না আর ভালোবাসি !
শুনবো না তোমায়, দেখবো না ফিরে,
পড়বো না তোমার মায়াজালে ।
স্পর্শ গুলো ভুলে,ক্লান্ত দেহে ভুলবো
যখন তোমার অনুভূতি গুলা,
বন্ধ ডায়রির উপর পড়বে ধূলিকনার
আবরন।
স্মৃতিগুলো ভুলে,
সামনে পথে পা বাড়িয়ে শেষ করে দেব
তোমার ভালবাসার অস্তিত্ব ,
রঙিন রঙের হাতে গোলাপের সৌরভ
মেশানো
প্রতিটি নি:শ্বাস নিস্তব্ধ করে দিয়ে
জীবন্ত কাঁটার
কাছে হেরে যাবে হ্বদয়ের
স্পন্দনগুলো ।
স্বর্গের মেঘ পরী চলে যাবার পরে কৃষ্ণ মানব নামে একজন ব্লগার এসে অতীতে মেঘ পরীকে নিয়ে একটি লেখা পোষ্ট করেছিলেন। স্বর্গের মেঘ পরী নিজেই এই লেখাটি ফেইসবুকে পোষ্ট করেছিল এভাবে-
মেঘ পরী আমার চলে গেল শ্রাবনের
বৃষ্টির ফোঁটায় , মেঘ পরী আমার
চলে গেল
শীতের ঘন কুয়াশায় ।
আসবে কি ফিরে ?
কোন হেমন্তের
গৌধুলী লগ্নে নীরবে নিভৃতে , ,
মৌনতা ভেঙে চুপিসারে আমার
বাহুডোরে ।
বি:দ্র আমার একজন কাছের মানুষের লেখা
মেঘ পরীকে নিয়ে কৃষ্ণ মানব এর স্মৃতিময় লেখাটি পড়ুন এখানে।
উৎস্বর্গঃ
আমার মেয়ে স্বর্গের মেঘ পরীকে, যে তাঁর বাবাকে দেখতে চেয়েছিলো। আশংকা করেছিলো মৃত্যুর একদিন পূর্বে যে তাঁর সাথে আমার হয়ত আর দেখাই হবে না।
মা গো তোকে ভুলতে পারিনি এখনো, পরকালে নিশ্চয়ই দেখা হবে আমাদের। আমাকে প্রাণ ভরে বাবা ডাকিস তুই তখন।
৩২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা, যা কার-ও পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব না।
পরীর দেশে পরী-জীবনে কাটুক তার সময় তা কামনা করি।
জিসান শা ইকরাম
ভালো থাকুক পরী, পরীদের দেশে।
মোঃ মজিবর রহমান
পরি পরি হয়েই থাকুক। এইরকম কোন বাবার জিবনে আল্লাহ যেন না দেয়।
পরি বেহেস্তের পরি হয়ে থাকুক। তার বিদেহি আত্বার শান্তি কামনা করি।
জিসান শা ইকরাম
আমীন……….
ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
কান্নাকে রুখতে পারিনি, চোখের পানি টপ করে বেরিয়ে গেলো, আপনার মেয়ে মেঘপরী মেঘ হয়ে উড়ে গেলো আকাশে, আহা কি নির্মম, একবারও দেখা হয়নি, আহ। 😢
মামনির জন্য দোয়া করছি যেন রাব্বুল আলামীন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করে, আমীন।
জিসান শা ইকরাম
আমীন……
ধন্যবাদ ইঞ্জা ভাই।
ইঞ্জা
সুম্মা-আমীন।
কৃতজ্ঞতা ভাইজান।
প্রদীপ চক্রবর্তী
নির্বাক আমি।
এ এক হৃদবিদারক ঘটনা।
চোখেরজলে চোখেরপাতা ভিজে..
তাহার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
জিসান শা ইকরাম
মেয়েটার জন্য খুব কস্ট হয় প্রদীপ।
ধন্যবাদ তোমাকে।
অশোকা মাহবুবা
স্বর্গের মেঘ পরী এভাবে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে চলে গেল! এই কষ্ট তো কখনো ভোলার নয়। যেখানেই থাকুক পরী ভালো থাকুক দোয়া করি।
জিসান শা ইকরাম
আমীন…….
ধন্যবাদ আপনাকে অশোকা।
তৌহিদ
সত্যিই হৃদয়বিদারক!! আবেগী হয়ে উঠলাম। দু’জন মানুষের নিজেদের মধ্যে কতটা আত্মার বন্ধন থাকলে এমনটা হতে পারে আপনার এই লেখা না পড়লে বুঝে উঠতে পারতামনা।
মেঘ পরী ভালো থাকুক স্বর্গের দেশে। অনেক দোয়া রইলো তার জন্য।
ভালো থাকবেন ভাই।
জিসান শা ইকরাম
আপনার দোয়া যেন আল্লাহ কবুল করেন। আমীন…….
ধন্যবাদ ভাই।
রেহানা বীথি
লিখতে পারছি না কিছুই, চোখ ঝাপসা
জিসান শা ইকরাম
আমার মেয়েটির জন্য দোয়া করবেন।
রেহানা বীথি
অবশ্যই ভাইয়া
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ আপনাকে।
নিতাই বাবু
মহান সৃষ্টিকর্তা মেঘ পরীকে স্বর্গবাসী করুক, এই কামনা করি। আর কিছু লিখতে পারছি না। ক্ষমা করুন আমাকে।
জিসান শা ইকরাম
সৃষ্টিকর্তা আপনার চাওয়াকে যেন পূর্ন করেন দাদা।
ধন্যবাদ আপনাকে, ভালো থাকবেন।
সঞ্জয় মালাকার
সত্যিই হৃদয়বিদারক। আবেগী হয়ে উঠলাম।
ভাইয় প্রতিটা কথায় জল ঝরছিল চোখে,
প্রতিটা শব্দ আমার বিশ্বাস ভাঙা চিত্র।
মেঘ পরী ভালো থাকুন স্বর্গের দেশে – আপনিও ভাল থাকুন সব সময় শুভ কামনা।
জিসান শা ইকরাম
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ সঞ্জয় মালাকার।
শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
মেঘ পরী ভালো থাকুক তার স্বর্গের বাসস্থানে। দোয়া রইলো তার বিদেহী আত্মার প্রতি।
জিসান শা ইকরাম
আল্লাহ্ আপনার দোয়া কবুল করুক,
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
মনির হোসেন মমি
সোনেলাকে জড়িয়ে কত স্মৃতিই না পড়ে আছে হৃদয়ে হৃদয়ে।মেঘপরীরা পরপারে ভাল থাকুক এই কামনা।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ মনির ভাই,
মেয়েটিকে ভুলতে পারছি না,
ওর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমি, নইলে ছবি দিতাম ওর, এত্ত সুন্দর পরীর মত মেয়েটা আর বেঁচে নেই ভাবতেই খারাপ লাগে।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
এখানে ভাষা নীরব। ভালোবাসা অফুরান তার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ আপনাকে আরজু মুক্তা।
শুভ কামনা।
শিপু ভাই
ভাল থাকুক মেঘ পরী মেঘেদের দেশে
জিসান শা ইকরাম
আমীন………
ধন্যবাদ শিপু,
শুভ কামনা।
হৃদয়ের কথা
পোষ্ট পড়েই মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। কি মন্তব্য করা যায় এমন লেখায়? স্বর্গের মেঘ পরী পরীর দেশে ভালো থাকবে অবশ্যই।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ মেঘ পরীর জন্য এমন দোয়া করার জন্য।
শুভ কামনা।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
‘স্বর্গের মেঘ পরি’ নামটির মাঝেই লুকিয়ে আছে অজানা কিছু রহস্য। এমন নাম সে কেন বেছে নিয়েছিলো জানা থাকলে জানাবেন প্লিজ।
পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহ ওর নামটা স্বার্থক করুক!