ভুতুরে বিল বনাম সরকারি সেবা ?

সুপায়ন বড়ুয়া ১৩ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ১২:৩৩:৩২অপরাহ্ন সমসাময়িক ২২ মন্তব্য

ভূতুরে বিল মানেই অস্বাভাবিক বিল যার কোন ভিত্তি নেই কিংবা অযৌক্তিক। যা মানুষ দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বা অযথা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর এই করোনা কালে তা জটিল আকার ধারণ করেছে।  ভুতুরে বিল শুধু বিদুৎ বিভাগে সীমাবদ্ধ নয় এটা পানির বিলের বেলায় ও প্রযোজ্য। মানুষের অসচেতনতা কিংবা সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে একধরনের সুযোগ সন্ধানী বা অসৎ মিটার রিডার যুগের পর যুগ তা করে আসছে। মানুষকে ঠকিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে। এতে শুধু মিটার রিডার একা নয় কিছু সুযোগ সন্ধানী গ্রাহক ও এ সুযোগ নিতে কার্পণ্য করে না।

আর সরকারি সেবা বলতে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে মানুষের মনে। এই আতঙ্ক বা ভীতি মানুষের মনে এক ধরনের গেঁথেই আছে। এই মনোজগতের ভীতি কাটানোর জন্য মানুষ কোনদিন এগিয়ে এসেছে বলে মনে হয় না। আর এই সরকারি সেবা যারা দেয় তারা কিন্তু আমার বা আপনাদের মতো মানুষ। তারা কিন্তু মঙ্গল গ্রহ থেকে আসে নি। তাদেরকে আমরাই লোভী কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলি আর পরে তাদের মা বাপ তুলে গাল দিই। আর সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি।

আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমিও এই ভুতুরে বিলের শিকার। তা থেকে কিভাবে উদ্ধার পেলাম তা পাঠকদের শেয়ার করাটাই আমার উদ্দেশ্য। তার আগে মানুষ কিভাবে ভুতুরে বিলের শিকার হয়। দুটি কেস স্টাডি তুলে ধরছি।

কেস নং ১.

কয়েকজন বন্ধু মিলে ফ্লাট বানাবে যথারিতি পিডিবির দালাল হাজির। আমি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেব স্যার বড় স্যারদের ম্যানেজ করে এক সপ্তাহের মধ্যে। বন্ধুরা যাচাই বাছাই না করে দালালের সাথে দফারফা করলেন। বড় স্যারদের ঘুষের কথা বলে ১০ গুন বেশী দামে। সপ্তাহ দূরে থাক চোরা লাইনে কাজ হল শুরু সেটা ও দফা রফায়। মাস শেষে লাইন এলো কমার্শিয়াল বিদুৎ লাইন।বিদুৎ বিল স্বাভাবিক কারণে বেশী আসবে সেখানেও দফা রফা।  মিটার চলে আপন গতিতে বিল আসে মিটার রিডার আর মালিকের ইচ্ছে মতো। বিল্ডিং কাজ হলো শেষ , মিটার রিডার গেল বদলে। বিল আসলো লাখ টাকার উপরে বকেয়া বিল সহ এখন নতুন করে দফারফা অর্ধেক দামে ৫০ হাজার টাকার ঈদ বকশিশের বদলে।

কেস নং ২ :

বন্ধুর বাসায় পানির মিটার রিডার এসে হাজির। বন্ধুকে মিটার রিডিং দেখিয়ে বললেন স্যার আপনার পানির বিল আসবে লাখ টাকা। কারণ এতদিন কম বিল দিয়ে আসছেন। বন্ধু মিটার দেখে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। যথারীতি মিটার রিডার ত্রাণ কর্তা, স্যার চিন্তা করবেন না। আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিলেই ঠিক করে দেব। বন্ধু ধার্মিক মানুষের দোহাই দিয়ে এত টাকা দিতে অপরাগতা জানালেন। নিজের পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন।  মিটার রিডার নাছোড় বান্দা ৪০, ৩৫, ৩০, ২৫ করে শেষে ২০ হাজার টাকায় রাজি হলেন।

কেস নং ৩ :

সর্বশেষ আমার ঘটনা দিয়ে শেষ করব বন্ধুর বাসায় দুই মাস ধরে শূন্য রিডিং ধরে ২২৫ টাকা বিদুৎ বিল আসাতে অস্থির। পরে বকেয়া বিল সহ বেশী আসবে বলে। যথারীতি ত্রাণ কর্তা মিটার রিডার এসে হাজির। বন্ধু আমাকে ফোনে ধরে দিলেন মিটার রিডারকে।

স্যার আপনার মিটার নষ্ট আমি ঠিক করে দেব।  নাম্বার রিডিং বিল সব ঠিক হয়ে যাবে।

কত লাগবে? বললো ১০ হাজার টাকা।

জিজ্ঞেস করলাম মিটারের দাম কত ?

স্যার ১৫০০ টাকা।

তবে এত বলছেন কেন?

সব ঠিক হয়ে যাবে আমার কিছুই থাকবে না।  আমাকে আপনি খুশী হয়ে যা দেন।

আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। বন্ধুকে বললাম আমরা ডিপিডিসি অফিসে যাব।

যথারীতি ৮ই নভেম্বর ২০২০ আমরা গিয়ে হাজির ১২টা বাজে।  সরাসরি ইঞ্জিনিয়ারের সামনে তিনি সাদরে বসতে বলেন। হাসি মুখে আমাদের সমস্যাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।

তিনি বিলটা দেখে বলেন ফ্রন্টডেস্ক থেকে অভিযোগ ফরম নিয়ে পুরন করে বিল আর NID কপি সহ দুই সেট কপি করে ওনার কাছে নিয়ে যেতে।  আমরা দুই সেট নিয়ে যখন ওনার টেবিলে গেলাম ওনি  তখন মিটিং এ চলে গেলেন। পাশের ভদ্রলোক বলেন অপেক্ষা করতে।আমরা দেরি হবে মনে করে ফ্রন্ট ডেস্কে গেলাম তখন ওনি জমা দিয়ে নামাজ আর লাঞ্চের পর আসতে বলেন। তখন ঘড়িতে ১২.৪৫ মিনিট।

আমরা আবার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের টেবিলে গিয়ে অপেক্ষা করছি। এলেন ১.১৫ মিনিটে। আমাদের বসা দেখে দু:খ প্রকাশ করে তাড়াতাড়ি ফরম নিজে পূরণ করে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে পাঠালেন। তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করে সুপারিশ পূর্বক আজকে মিটার লাগানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন।

আমরা আবার ইঞ্জিনিয়ারের টেবিলে এলাম তিনি নিজ দায়িত্বে সমস্ত কাজ করে একটা ১০৫০ টাকার বিল বানানোর ব্যবস্থা করে যখন সব রেডী তখন ঘড়ির কাঁটা ২ টা। তিনি ঘড়ি দেখে আমাদের তাড়াতাড়ি এক মাইল দুরে সোনালী ব্যাংকে টাকাটা জমা দিয়ে আসতে বলেন। এও বলেন তিনি যদি না থাকেন স্টোরে গিয়ে ফাইলটা নিয়ে যেতে। ওনি ফোন করে সেটাও ব্যবস্থা করে গেলেন।

আমরা ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে সরাসরি ইঞ্জিনিয়ারের টেবিল থেকে ফাইল নিয়ে সরাসরি স্টোরে যাওয়ার পথে দেখি কর্মচারীরা সবাই লাঞ্চ খাচ্ছে দল বেঁধে ঘড়ির কাঁটা তখন ৩ টা। সৌভাগ্যক্রমে স্টোরকিপারের রুমে গিয়ে দেখি শ্বেত শুভ্র ধার্মিক যুবক কাজে ব্যস্ত। আমাদের দেখে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি আমাদের ফাইলটি সাদরে নিয়ে ১২০০ টাকার বিনিময়ে একটি মিটারের ব্যবস্থা করলেন। সাথে আমাদের বসতে বলে সব ইঞ্জিনিয়ারের সাক্ষর সংগ্রহ করে মিটার সহ একজন মিস্ত্রি পাঠিয়ে দিলেন লাগিয়ে দেয়ার জন্য।  মিটার রিডারের দাবীকৃত ১০০০০ টাকার দুই নম্বরী কাজ সর্বসাকুল্যে ২২৫০ টাকায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পদ্ধতিতে  আমাদের নতুন মিটার সংযোজিত হল একদিনেই।

বন্ধু আমার সরকারি কর্মকর্তাদের সেবায় অভিভূত। তার কারণ জানার প্রবল কৌতূহলে বললাম। লক্ষ্য করেছেন কিনা এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বললেন আমরা ছাড়া সারাদিন একজন ভদ্রলোক ও অফিসে আসে নি। তারা স্বাভাবিক কারণেই আমাদের পেয়ে খুশী। তারা সারাদিন কোন ভদ্রলোকদের সাথে কথা বলার সুযোগ পায় না। মানুষের নীতি নৈতিকতার এত অধ:পতন দালাল আর মিটার রিডার দিয়ে কাজ করান ঘুষের বিনিময়ে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের টেবিলে যতগুলি ফাইল দেখেছেন সব ফাইল গুলি মিটার রিডার আর দালালেরা নিয়ে তদবির করছেন। এমনকি একজন মিটার রিডার নিয়ে আসলেন মিটার টেম্পার করা কেস নিয়ে।

তাই এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বললেন মানুষ একটু সচেতন হয়ে নিজের কাজ নিজে করলে ঘুষ দুর্নীতি গুলো কমে যায়। মিটার রিডার আর দালালের খপ্পর থেকে মুক্তি পায়।

 

ছবি নেট থেকে

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ