পোষা পাখি তিলা মুনিয়া (২য়-পর্ব)

শামীম চৌধুরী ২৩ নভেম্বর ২০২০, সোমবার, ০৫:৩৬:৫৬অপরাহ্ন পরিবেশ ২৫ মন্তব্য

প্রথম পর্বের লিংক দিয়াবাড়ির পাখি লাল মুনিয়া- (১ম পর্ব)

তিলা মুনিয়াঃ

ফটোগ্রাফীর শুরু দিকে যে পাখির ছবিগুলি প্রথমে তুলেছিলাম তারমধ্যে মুনিয়া প্রজাতির তিলামুনিয়া প্রথম পাখি ছিল। তিলা মুনিয়া ছাড়া সে পর্যন্ত আর কোন মুনিয়া পাখির ছবি তোলা হয়নি। সময়টা ছিলো ২০০৯ সাল। প্রথম তিলামুনিয়া তোলা হয় ঢাকার শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন জুড়ে ছিমছাম একটা পরিবেশ ছিলো । ছোট্ট পরিসরে ছাত্রদের গবেষনার জন্য প্রায় ৫ বিঘা জমির একটি মাঠে কৃষির আবাদ হতো। ধান, গম, ভূট্টা, তিল, সরিষা থেকে শুরু করে হরেক জাতের ফসল আবাদ হতো। মূলতঃ এটা ছিলো কৃষি অনুষদের ছাত্রদের ব্যাবহারিক ক্লাশ ও গবেষনা। সেই সময় বার্ড ফটোগ্রাফীর প্রতি বাচ্চাদের খুব একটা জোক ছিল না। হাতে গোনা কয়েকজন বার্ড ফটোগ্রাফী করতো। অবসর সময়ে প্রায়ই আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখির ছবি তুলতে যেতাম। সেই সময় আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে ২৫ প্রজাতি পাখির ছবি তোলা ছিলো। পাখিদের অভয়ারণ্য বললেও ভুল হবে না। এখন আর সেখানে পাখির কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। প্রায়ই পাখি শূন্য। তার মূল কারন হচ্ছে, আধুনিক প্রযুু্ক্তির ছোঁয়া আজ মাঠেও পড়েছে।
পরবর্তীতে গত ৬ বছর ধরে ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়িতে নিয়মিত মুনিয়া প্রজাতি পাখির ছবি তুলে আসছি।
তিলা মুনিয়া বাদামি রঙের Estrildidae (ইস্ট্রিল্ডিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Lonchura (লঙ্কুরা) গণের অন্তর্গত এক প্রজাতির ছোট ছটফটে তৃণচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ১১.৫ সেমি ডানা ৫.৬ সেমি, ঠোঁট ১.৩ সেমি, পা ১.৫ সেমি, লেজ ৩.৮ সেমি ও ওজন ১৩.৬ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো পিঠ জলপাই-বাদামি। কোমরে সাদা ডোরা থাকে। লেজ-উপরি ঢাকনি লালচে-কমলা। লেজ খাটো ও সূচালো এবং লালচে-কমলা রঙের। থুতনি কালচে। বুকের উপরের অংশ তামাটে এবং দেহতল সাদা। বগলে ও পেটে কালো আঁশের মত তিলা থাকে। এর ত্রিকোণাকার ঠোঁট স্লেট কালো। চোখ কমলা-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট রঙের। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা একই রকম; তবে পুরুষ পাখির দেহতল ও থুতনি স্ত্রী পাখির তুলনায় গাঢ়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ বাদামি; দেহতল লালচে-পীত ও হালকা পীত বর্ণ। ঠোঁট শিঙ বাদামি ও চোখ বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের অনেকসময় অপ্রাপ্তবয়স্ক কালোমাথা মুনিয়া বলে মনে হয়।
 
তিলা মুনিয়া ফসলের খেত, মাঠ, নলখাগড়ার বন, বাগান ও ঝোপে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করে। মাঝে মাঝে ১০০ বা তারও বেশি পাখির ঝাঁক দেখা যায়। মাটি, ঘাস বা ধানের মধ্যে এরা খাবার খোঁজে। এদের ঠোঁট খাটো ও বেশ শক্ত। ধান বা অন্যান্য শস্যদানা মুখে রেখেই তা থেকে শক্ত খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারে। এছাড়া ঘাসবীচি, রসালো ফল ও কীটপতঙ্গও খায়। অন্যান্য মুনিয়া ও বাবুইয়ের সাথে দল বেঁধে এরা ঝোপ, আখখেত বা ঘাসবনে রাত কাটায়। সচরাচর শ্রুতিকটু স্বরে ডাকে: কিটি-কিটি-কিটি....., কিটি-ইইইইই...., কি-কি-কি-কি-কি-টিইই...., চিক্, ট্র্যাট-ট্র্যাট।
 
মে-সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। খেজুরগাছের পাতার আড়ালে, লতার ঝোপে, বাবলা, ঝাউ, কেয়া, কান্তা, দেবদারু বা অন্যান্য ঝোপাকৃতির গাছে ২ থেকে ৫ মিটার উঁচুতে গোলাকৃতির বাসা বোনে। ঘাস-লতা-ধানের পাতা, পালক ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর, নরম ও তুলট বাসার ভিত্তি রচনা করে। কাশফুল দিয়ে চারপাশটা মুড়ে নেয়। বাসার ভেতরে থাকে কাশফুলের গদি। বাসায় ঢোকার জন্য গোপন সরু পথ বানায়, যেন শত্রুরা না দেখে। এছাড়া কার্নিশের নিচে বা খালি কার্টনেও বাসা করে। স্ত্রী মুনিয়া চার থেকে দশটি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ১.৬ × ১.১ সেমি। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৩ থেকে ১৬ দিন তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাবা-মা উভয়ে মিলে ছানাদের পরিচর্যা সহ সংসারের যাবতীয় কাজ করে থাকে। ছানাগুলি উড়তে শিখলে বাবা-মা’র দায়িত্ব পালন শেষ হয়।
শহুরে মানুষের কাছে পোষা পাখি হিসেবে তিলা মুনিয়া বেশ জনপ্রিয়। খাঁচাবন্দী মুনিয়া রাস্তাঘাট ও পোষা পশুপাখির দোকানে বিক্রি হয়। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিক্রেতারা এদের গায়ে নীল, হলুদ, সবুজ বা উজ্জ্বল রং লাগিয়ে দেয়, যা গোসল করালেই উঠে যায়। বাংলাদেশে গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এদের জাল দিয়ে ধরে টঙ্গী, ঢাকার কাঁটাবন ও অন্যান্য স্থানে প্রচুর সংখ্যায় বিক্রি করা হয়। সেজন্য বর্তমানে বাংলাদেশে এদের অবস্থা বেশ খারাপ।
বাংলা নামঃ তিলা মুনিয়া
ইংরেজী নামঃ Scaly-breasted Munia
বৈজ্ঞানিক নামঃ Lonchura punctulata
ছবিগুলি ঢাকার দিয়া বাড়ি ও শেরে বংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা।
0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ