আগামী ১'লা অক্টোবর ২০১৯ থেকে দেশের সব বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হবে। এটি দেশের জন্য গৌরবের বিষয়। আমাদের আর বিদেশী স্যাটেলাইট কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হবেনা, দেশের টাকা দেশেই থাকবে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড (বিসিএসসিএল) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে।

যদিও বিসিএসসিএল সরকারেরই একটি প্রাইভেট কোম্পানী তবুও আপনারা জানেন কি সরকার নিজ তত্ত্ববধানে এই কাজটি কেন করলোনা? এর কারন হচ্ছে- কাজের গতি এবং পরিধিকে সচল রাখা। উদাহরণ হিসেবে- সরকারি ব্যাংক এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকের সার্ভিসের কথা চিন্তা করুন তাহলেই বুঝতে পারবেন। প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে যেকোন নিজেদের স্বচ্ছতা এবং দক্ষ জনবলের চৌকস কর্মদক্ষতা দিয়ে কোম্পানীগুলি এসব দুরূহ কর্মপদ্ধতি সবসময় সম্পাদন করে আসছে। তাই পৃথিবীর সব দেশের সরকারই স্যাটেলাইট পরিচালনার এমন জটিল বৈজ্ঞানীক কাজগুলিকে অভিজ্ঞ প্রাইভেট কোম্পানীগুলির দ্বারা সম্পাদন করে।

এখন প্রশ্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত যে কোম্পানী বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পরিচালনার মাধ্যমে দেশের প্রাইভেট চ্যানেলগুলির সাহায্যে আকাশ বিনোদনকে ক্যাবল অপারেটরদের দ্বারা জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর দায়িত্ব পেয়েছে মানে বিসিএসসিএল- তাদের নীতিমালা জনবান্ধব কিনা? সরকার আইন করেছেন- দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলিকে তাদের সম্প্রচার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমেই করতে হবে। তাহলে সেই নীতিমালায় দেশের প্রাইভেট চ্যানেল কোম্পানীগুলি এখনকার থেকে বেশী সুবিধা পাবে কি?

পূর্বে বিদেশী স্যাটেলাইট ব্যবহারের জন্য দেশের প্রাইভেট চ্যানেলগুলিকে অনেক টাকা গুনতে হতো। যার কারনে নিজেদের লোকসান পুষিয়ে নিতে চ্যানেলিগুলিতে বিজ্ঞাপন প্রচার হতো বেশী। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,অনেকসময় বিদেশী স্যাটেলাইট ভাড়ার সেই ঘাটতি পোষাতে কিছু চ্যানেল কম বাজেটের নিম্নমানের অনুষ্ঠান পরিচালকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে সেটাতে লাভের মুখ দেখতে তাদের চ্যানেলগুলিতে বেশি বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হতো এবং এখনো হচ্ছে। ফলে মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার না হবার এটাও অন্যতম কারন। দেশের স্যাটেলাইট ব্যবহারের ফলে এই ঘাটতি পূরণ হবে আশা করা যায়। চ্যানেলগুলিতে ভালোমানের বিনোদন প্রচারের এই বাঁধা এখন অনেকাংশেই লাঘব হবে।

বেসরকারী চ্যানেলগুলি দেশীয় স্যাটেলাইট ব্যবহার করার পরেও যদি তাদের পূর্বের এই অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের ধারাবাহীকতাকেই বজায় রাখে তাহলে কিন্তু আমাদের মানসম্মত বিনোদনের সেই জায়গাটাতে ঘাটতি থেকেই যাবে। নিজেদের লাভের টাকা গুনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের বিনোদন শিল্প এবং ব্যাহত হবে আমাদের বিনোদন পরিষেবা। আশাকরি বিষয়টি বোধগম্য হয়েছে আপনাদের?

এখন আমরা যারা সাধারণ দর্শক তারা পাড়ার ক্যাবল অপারেটর বা ডিশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে দেশের চ্যানেলগুলি দেখতে পাচ্ছি। চ্যানেল সম্প্রচারের জন্য ক্যাবল অপারেটরদের কিন্তু চ্যানেলগুলিকে কোন টাকা দিতে হচ্ছেনা, তারা বিনা পয়সায় আমাদের দেখাতে পারছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলে বিসিএসসিএল এর কাছ থেকে ক্যাবল অপারেটরদেরকে এখন থেকে নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে তার বিনিময়ে সম্প্রচার প্যাকেজ কিনতে হবে। তাহলে সেই টাকার অঙ্কটা কিন্তু আমাদের সাধারণ জনগনের কাছেও ভাগে পরবে। ফলে মাসিক যে টাকার বিনিময়ে আমরা এখন ক্যাবল বা ডিশ পরিষেবা পাচ্ছি সেই টাকার অঙ্কের পরিমানটা স্বাভাবিকভাবে কিছুটা হলেও বেড়ে যাবে।

গত ১৯ মে থেকে বিসিএসসিএল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পুরোপুরি বাণিজ্যিক সেবা দিচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের সব টিভি চ্যানেল আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম সার্ভিস সুবিধাও দেবে বিসিএসসিএল।

আমাদের দেশের বেক্সিমকো গ্রুপ অফ কোম্পানীর মালিকাধীন বেক্সিমকো কমিউনিকেশন্স এই ডিটিএইচ সার্ভিস পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এই সার্ভিসের মাধ্যমে ১৩০ টি চ্যানেল প্রচারের সুবিধা দিচ্ছে বেক্সিমকো। এটি ক্যাবল অপারেটররা ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানায় বাসা কিংবা অফিসে সাধারণ জনগনও ব্যবহার করতে পারবেন। এই ডিটিএইচ পরিষেবাটি 'আকাশ' নামকরণ করেছে বেক্সিমকো কমুউনিকেশন্স। ডিটিএইচ 'আকাশ' কিনতে আপনাকে গুনতে হবে এককালীন সাত হাজার টাকা প্রায়। আর মাসিক প্যাকেজ খরচ পড়বে ৩৯৯ টাকা। বর্তমানে ১০০ টি সাধারণ চ্যানেল এবং ২০ টি এইচডি চ্যানেল সুবিধা দিচ্ছে 'আকাশ' সেবাটি।

 

বেক্সিমকো কমিউনিশন্স লিঃ এর ডিটিএইচ সেবা- আকাশ

দেশের শুধুমাত্র একটি কোম্পানী বেক্সিমকো কমিউনিকেশন্সকেই এই ডিটিএইচ টেলিকাস্টিং এর স্বত্ত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের মাধ্যম হয়েই ক্যাবল অপারেটরদের ডিটিএইচ সম্প্রচারসত্ত্ব নিতে হচ্ছে এখন। নিশ্চিত এতে ক্যাবল অপারেটরগুলিকে অনেক টাকাও গুনতে হবে। কিন্তু এই সার্ভিস বিকেন্দ্রীকরণ হলে বেক্সিমকোর একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন প্রতিযোগীতার বাজারে বিনোদন সেবার মান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি টাকার অঙ্কটাও কমে আসবে বৈকী।

তাই বাংলাদেশে ডিটিএইচ সেবা দেয়া কোম্পানীর অনুমোদন সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত সরকারের। আর তা না হলে নিজেদের সাধ আছে সাধ্য নেই অবস্থার মাঝে জীবনযাপন করা নিম্ন মধ্যবিত্তরা কিঞ্চিত হলেও মাসিক বাজেটে ঘাটতি অনুভব করবেন তাতে সন্দেহ নেই। কারন আমি অনেক পরিবার দেখেছি পাঁচ টাকা দামের একটি দৈনিক পত্রিকা মাসে একশত পঞ্চাশ টাকা বিল দিতে হয় বলে পত্রিকাওয়ালার কাছে থেকে পত্রিকা নেয়াই বন্ধ করেছেন। তাদের ভাষ্য- টিভিতে সংবাদ দেখলেই সব খবর জানা হয়ে যায়। অযথা পত্রিকা না কিনে পত্রিকা কেনার সেই টাকা দিয়েই ডিশের বিল পরিশোধ করে তারা। ক্যাবল অপারেটররা যখন বাড়তি দাম ধরবেন আমাদের কাছ থেকে, তখন কি হবে নিম্নবিত্তের- দায়িত্বশীলরা কি ভেবেছেন এই বিষয়টি ?

এ বিষয়ে সরকারকে এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী কোম্পানী বিসিএসসিএল এর মাধ্যমে যারা চ্যানেল পরিষেবা দেবে তাদেরকেই নজরদারী জোরদার করতে হবে। কারন নিজেদের লাভের মুখ সবাই দেখতে চাইবে সে সরকার হোক, প্রাইভেট চ্যানেলগুলি আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ডিটিএইচ কোম্পানী বেক্সিমকোই হোক। সাথে ক্যাবল অপারেটররাতো আছেই। দেশের জনবান্ধব সরকারেরই উচিত এমন ধোঁয়াশা বিষয়গুলি জনগনের সামনে খোলাসা করা। এতে জনমনে অনেক ভ্রান্ত ধারনা দূর হয়ে যাবে।

স্বনির্ভর বাংলাদেশে যাদের টেলিভিশনই হচ্ছে বিনোদনের একমাত্র এবং অন্যতম মাধ্যম সেই দেশীয় জনগোষ্ঠী- আমরা বিনোদন উপভোগ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ি, আমাদের সরকার নিশ্চয় এমন চাইবেননা। গতিশীল এবং স্বাচ্ছন্দ্য নীতিমালা প্রনয়ন করে প্রয়োজনে আইনের মাধ্যমেই তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাহলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত বিনোদন সেবায় সংযুক্ত সকল মাধ্যমেই কার্যকরী ফলাফল আসতে বাধ্য।

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ