
ঘুপুত ঘুক! সর্বনেশে পাখি শুধু রাতের আঁধার ছাপিয়ে ডাকে। তার ডাক শুনে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপে। না জানি, কি বিপদ আসে? ঐ পাড়ার ময়েন উদ্দিন ভাই পাখিটারে গালিগালাজ করে। শালা….! তার গালি শুনে পাখিটা চুপ করে থাকলেও, রাতের বুক চিরে আবার ডাকে “ঘুপুত ঘুক!” মনে হচ্ছে, মগজ ভেদ করে ছাড়বে। ঘুম আসে না।
কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছে আর্মি আসবে। যে যার মতো খাট, আলমারি, চেয়ার, টেবিল পুকুরে ডুবায় দেই। মাটি খুঁড়ে শোয়ার ব্যবস্থা করি। চাল, একটু ডাল, কখনো আলু সেদ্ধ, কখনো শাক ভর্তা, কখনো ফেন দিয়ে খাওয়া চলে।
আজ আবার সিদ্দিক চাচা, ওমর চাচা ওনাদের ফ্যামিলি নিয়ে আসছে। শহরের স্টেশনে জমা হয়েছে আর্মি। সিদ্দিক চাচার বাড়িতে একটা বন্দুকের গুলি লাগছে। টিন ফুটা হয়ে গেছে। কাল যে কি ঘটে, বোঝা মুশকিল।
ময়েন উদ্দিন ভাইয়ের ৫ ছেলে ৪ মেয়ে। এতোগুলোর মুখের আহার যোগানো কঠিন। ছোট ছেলের বয়স ২ বছর। পুষ্টির অভাবে দেহ কঙ্কালসার। গরমে মাটির নীচে থাকতে থাকতে পোলাটার শ্বাসকষ্ট শুরু হইছে। তার মায়ের দোয়া দরুদ চলছে। গুলির আওয়াজ শুনে নিজের কানে হাত না দিয়ে পোলার দুকান ঢাকে। ময়েন উদ্দিন ভাই চেঁচায়, শালির বেটি ! গুলির শব্দ শুনে কাঁন্দিস। আর্মি গো কাম নাই। তোর কুঁড়েঘর কামানের লক্ষ্য হইছে। তবুও জমিলার কাঁপুনি থামে না। বেকুপ মাইয়্যা। ময়েন উদ্দিন মুখে পটর পটর করলেও, গুলির আওয়াজ শুনে গতি বোঝার চেষ্টা করছে। শব্দটা কি আমাদের গ্রামমুখি? মরার পাখি এখনও ডাকতেছে।
সকালে উঠে শুনে, খলিলগঞ্জের উত্তর পাশটায় আগুন ধরাইছে। দোকানপাট, হিন্দুদের বাড়িঘর কোনটাই বাকি রাখেনি। অনেক হিন্দু ; পাকিস্তানি পতাকা ওড়ায়। তাও লাভ হয়নি। ভয়ে কেউ দিনের বেলাও বের হয়নি।
ছেলেটার শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। আম্মা, সরিষার তেলে সূরা ফুঁ দিয়ে দিছে। মালিশ চলছে। উন্নতি হয়। আবার ব্যথা বাড়ে। জমিলা খালি কাঁদে। এইভাবে কাঁদলে চোখের পানি আর থাকবে না।
আজ রাতেও পাখি ডাকছে। ঘুপুত ঘুক। হঠাৎ চিৎকার। ছোট ছেলেটার বুকের খাঁচা ওঠানামা করছে। নিঃশ্বাস বুঝি যায়। গুলির দুরুম দারুম শব্দে, কষ্টও বাড়ছে। জ্বরে বিলাপ বকছে। মা, ” ললিপপ, ললিপপ ! ” ওর মায়ের চোখের জল শুকায়ছে। খালি বকে এখন। ছেলেটার যেদিন জন্ম হলো, ওর বাবা তাড়াতাড়ি ওযু করে আযান দিয়েছিলো। আর আজ। কাঁদতেও পারেনা। বাবা হলেও বুকে পাষাণ বেঁধে রাখে। গাছের গুঁড়ির মতো শক্ত হয়ে থাকে।
ভাদ্র মাসের আকাল বৃষ্টিতে ছেলেটার প্রাণপাখি উড়ে গেলো। যুদ্ধ, বৃষ্টি, পানি, কষ্ট সব এক হয়ে গেলো। সেনারাও চলে গেলো। কারও বাড়িঘর ছারখার হলো, কারও হৃদয়। মাটি খোঁড়া চলছে। খুঁড়লেই শুধু পানি আর পানি। শুকনা জায়গা নাই। তবুও কোপানো চলছে। পাখির ঘুপুত ঘুক আওয়াজ আর কোপানোর শব্দ মিলেমিশে একাকার। আশ্চর্য এক কবর খোঁড়া চলছে। কাফনের কাপড় নাই। মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে কবর। মাথা আর পায়ের দিকে গিট দেয়া হয়েছে। বাবার কাছে ছেলের লাশ ভারি। কিন্তু বাচ্চাটার শরীর পাখির মতো হালকা।
কবর শেষে দেখি, আকাশ পরিষ্কার। হায় ! কী এক যুদ্ধ্ ! কী এক লাশ ! কী এক কবর! এক মায়ের বুক খালি করে আর এক মায়ের বুকে মিললো ঠাঁই।
২৩টি মন্তব্য
বোরহানুল ইসলাম লিটন
নিদারুণ দৃশ্য চিত্রায়িত।
শুধু রক্তের বিনিময়েই যেন এই স্বাধীনতা।
বেশ চিত্তছোঁয়া নিবেদন প্রিয়।
মুগ্ধতায় শুভেচ্ছা রেখে গেলাম একরাশ।
আরজু মুক্তা
প্রথম মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো।
শুভকামনা
আলমগীর সরকার লিটন
খুবি ভাল লেখেছেন গল্পটা পাঠে মন ছুঁয়ে গেলো মুক্ত আপু অনেক শুভেচ্ছা রইল
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এভাবেই কত শত ময়েন উদ্দিনের বুক খালি হয়েছে, রক্ত ঝরেছে তবুও সেই স্বাধীনতা আজ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতাকে নিয়ে এক ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে কিছু অসভ্য, জানোয়ারের দল। চমৎকার বর্ণনায় ঐ সময়ে ফিরে গেলাম। কবর দিতে গিয়ে মাটিও পায়নি অনেকে।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
আরজু মুক্তা
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচতে পারে। ধিক তাদের যারা মূল্য দেয় না।
শুভকামনা দিদি
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
দারুণ লিখেছেন গল্প খানি
শুভকামনা রইল প্রিয়
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ আপনাকে
রোকসানা খন্দকার রুকু
ইশ্ কি নিদারুন ছিল। অনুভব করলেই বুকটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। যুদ্ধ আর তার মর্যাদা রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুভ কামনা রইলো।❤️❤️❤️
আরজু মুক্তা
সেটাই। যুদ্ধ না দেখেও আমরা কেঁপে কেঁপে উঠি।
তৌহিদ
গল্প পড়ে আপ্লুত হলাম আপু। স্বাধীনতা এসেছে এরকম হাজারো হৃদয়দগ্ধ অনুভূতিগুলোকে বুকে পাথর বেঁধে লালনের মাধ্যমে। যারা হারিয়েছে তারাই জানে এর কস্ট।
অনবদ্য লেখা পড়লাম। ভালো থাকুন।
আরজু মুক্তা
হারানোর বেদনা তো সেই বোঝে, যে হারিয়েছে।
সুন্দর কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ।
শুভকামনা
সাবিনা ইয়াসমিন
সব যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। অনেক জীবন্ত করে লিখেছেন। চোখের সামনে নিজ সন্তানের মৃত্যু দেখার পর ঐ চোখে আর কিছু ভাসে না। পানি শুকিয়ে যায়, স্বপ্ন উচ্ছেদ হয়।
চমৎকার গল্প। শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
যুদ্ধ পরিবার পরিজন পরিবেশ দেশ সবকিছু মিলে।
আপনার দারুণ মন্তব্যে আমি উৎসাহিত।
ধন্যবাদ আপনাকে। আর শুভকামনা সবসময়।
মোঃ মজিবর রহমান
অনবদ্য একখানি লিখা। সুন্দর সুচারু রুপ। মায়ের কান্দন শব্দ হয় কিন্তু বাপের কান্দন হৃদয় পুড়ে ছারখার হয় বলতে পারেনা।
ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপনাদের দারুণ দারুণ কমেন্ট আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
ধন্যবাদ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
ধন্যবাদ মুক্তা আপু
প্রদীপ চক্রবর্তী
করুণ কাহিনী।
.
স্বাধীনতা এমনি এমনি করে আসেনি।
এসেছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে। কতশত মায়ের কোল খালি হয়েছে।কত পিতা হারিয়েছে তার সন্তানকে কত বোন হারিয়েছে তার আদরের ভাইকে।
.
লেখনীর সাথে অবয়ব চিত্র যেন ফুটে উঠেছে।
ভালো থাকুন, দিদি।
আরজু মুক্তা
দারুণ মন্তব্যে চমৎকৃত।
প্রতিটি মানুষ, তাদের ত্যাগ যেটা দেশের জন্য।সেটা ছোট করে দেখবার নয়। আর এই ছোট ছোট আত্মত্যাগ এনে দিয়েছে স্বাধীনতার সাদা পায়রা।
শুভকামনা সবসময়
খাদিজাতুল কুবরা
“ভাদ্র মাসের আকাল বৃষ্টিতে ছেলেটা প্রাণপাখি উড়ে গেলো। যুদ্ধ, বৃষ্টি, পানি, কষ্ট সব এক হয়ে গেলো”
“কবর শেষে দেখি, আকাশ পরিষ্কার। হায় ! কী এক যুদ্ধ্ ! কী এক লাশ ! কী এক কবর! এক মায়ের বুক খালি করে আর এক মায়ের বুকে মিললো ঠাঁই।”
এমন জীবন্ত গল্প বহুদিন পড়িনি। আমার দাদীর মুখে শোনা গল্পের সাথে হুবহু মিল। যেন আমি দেখতে পাচ্ছি।
খুব ভালো লাগলো।
আরজু মুক্তা
গল্পের ৬০ ভাগ সত্যি। মায়ের কাছে শোনা। বাকিটা কল্পনা করে লেখা। আর এজন্য এতো জীবন্ত। যুদ্ধের বাস্তব কাহিনী গুলো একই। শুধু মানুস আর পরিবেশ আলাদা।
বাস্তব মেশানো গল্প সবসময় হৃদয় ছোঁয়া হয়।
শুভকামনা সবসময়
জিসান শা ইকরাম
৭১ এর দিনগুলোর কথা মনে পরে গেলো।
কি এক দুঃসহ দিন যাপন করেছি আমরা বাঙ্গালীরা। ভাবতেও এখন গা শিউড়ে ওঠে।
গল্পের প্লট অত্যন্ত সুন্দর,
এক মা থেকে অন্য মায়ের কাছে চলে যাওয়া, চির বিদায়।
লেখায় পরিপূর্ণতার ছাপ স্পষ্ট।
শুভ কামনা।
শুভ ব্লগিং।
আরজু মুক্তা
পড়া লেখা বুঝা। এভাবেই চলছে। পরিপূর্ণতা এখনও বুঝিনি। তবে সবাই পড়ে যে কমেন্ট করে, তাতেই ভালো লাগে।
যুদ্ধ দেখিনি, মায়ের মুখে শুনেছি। গল্পের কিছুটা মায়ের মুখেই শোনা।
শুভকামনা সবসময়।
শুভ ব্লগিং।