
বড় বোনের নাম আসমানী। আসমানীর সঙ্গে মিল রেখে তার পরের জনের নাম। জামদানী। তৃতীয়জনের জন্যে মিলের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। তার নাম পয়সা।
বইটার প্রথম দু'লাইন পড়ে চমকে উঠলাম। খুব সাবলীল ভাষা, ছোট ছোট বাক্য! আমাদের পরিচিত গল্পগুলোর মতো নয়। পড়লেই এক ধরণের আরামবোধ চলে আসে।
তখন সম্ভবত সিক্স-সেভেনে পড়ি। পড়াশুনা ছাড়া বাকি সবকিছুতেই আমার প্রচন্ত আগ্রহ। নিয়ম করে ছবি আঁকি, দুর্দান্ত মার্বেল খেলি আর হরেক কিসিমের বই পড়ি। বই নিয়ে আমার বাছবিচার ছিল না। সামনে যা পাই, সেটাই পড়ি।
বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে আরও কয়েক বছর আগে। আমাদের রেল স্টেশনে সোহেল ভাইয়ের বইয়ের দোকান- রেলওয়ে বুকস্টল। দুই টাকায় ঠাকুর মা'র ঝুলি, গোপাল ভাঁড় আর বিভিন্ন রকমের ভুতের গল্পের বই পাওয়া যেত। বাজেটে কুলোয় না, তবু মাসে আটটা-দশটা বই কিনে ফেলি।
এরপর ধীরে ধীরে বইয়ের ধরণ পাল্টাতে লাগল। এলো দস্যু বনহুর, তিন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্র থেকে নজরুল, মানিক থেকে রবীন্দ্রনাথও হাতে নিতাম। রহস্য পত্রিকা, কিশোর কণ্ঠ কিংবা দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলোতে টুকটাক লিখতে শুরু করলাম।
আমার পরিচিত গল্প-উপন্যাসগুলো শুরু হতো একই ধাঁচে- "গ্রামের নাম শান্তিপুর। গ্রামের মাঝ দিয়ে একেবেকে বয়ে গেছে নদী..." -এই ধারার বাইরে, একেবারেই অ-কেতাবি, অপ্রচলিত ভাষায় আসমানীদের গল্প পড়ে তাই আমাকে চমকে উঠতে হল। এক বৈঠকে পড়ে ফেললাম বুকে হাহাকার তোলা গল্পটা। জমির আলীর তিন কন্যার গল্প। বইয়ের নাম আসমানীরা তিন বোন, লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের নাম জানতাম। তখন টেলিভিশন বলতে বিটিভি আর বিনোদন মানেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক। কোথাও কেউ নেই কিংবা আজ রবিবার ততদিনে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমরা মতিকে চিনি, পাগলাটে বড় চাচাকে চিনি। চিনি বদি, মজনু আর বাকের ভাইকে। দুশ্চিন্তার প্রহর গুনি, বাকের ভাইয়ের কি সত্যি ফাঁসি হয়ে যাবে?
এর বাইরেও যে একজন হুমায়ূন আহমেদ আছেন, সেটা জানতাম না। আসমানীরা তিন বোন আমাকে হুমায়ূনের অদ্ভুত যাদুর জগতে নিয়ে গেল। আমি পরিচিত হলাম মিসির আলির সাথে, শুভ্র আর হিমুর সাথে। জরি আর পরীর সাথে, রূপার সাথে।
সেই শুরু। এরপর থেকে আমি হুমায়ূনের বই পেলেই গোগ্রাসে গিলেছি। ডানে-বামে অনেক বই-ই পড়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি কোনো সাহিত্যই আমাকে অতটা স্পর্শ করতে পারেনি, যেমন পেরেছে হুমায়ূনের লেখা। মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনা হুমায়ূন যতো নিপুণভাবে বলেছেন, তেমন কি আর কেউ বলতে পেরেছেন? বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাবে -এর চেয়ে বড় আতংক আর কোনো কাল্পনিক চরিত্র বাঙ্গালীকে দিতে পেরেছে?
ধানমন্ডির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কতদিন দখিন হাওয়ার সামনে গিয়ে থমকে গেছি। কলাবাগানের গলিতে চলতে গিয়ে মনে হয়েছে, হয়তো রূপা কোনো এক বারান্দায় নীল শাড়ি পড়ে হিমুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। নিদারুণ এক প্রেম! কী দারুণ এক ভালবাসা!
হুমায়ূন চলে গেছেন আজ সাত বছর। একেবারে কাছের আত্মীয়ের বাইরে এই একজন মানুষের মৃত্যুই আমাকে কাঁদাতে পেরেছে। আমি হু-হু করে কেঁদেছি। সমগ্র জাতি কেঁদেছে। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের যে ঢল আমি দেখেছি, আমি নিশ্চিত আমাদের প্রজন্ম এমন কিছু দেখার সুযোগ আর পাবে না। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তাঁর মৃত্যুর পর টানা কয়েকদিন লাল কালিতে যে শিরোনাম করেছে, এমন আর কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।
হুমায়ূনকে নিয়ে সমালোচনা আছে। তাঁর লেখা নিয়ে সমালোচনা আছে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে কেউ নন, কিন্তু যাঁরা হুমায়ূনের সমালোচনা করেছেন, তাঁদেরকেও আমরা চিনি। আমরা জানি কে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছে আর কে পারেনি। সময়ই ভালো-মন্দ নির্ধারণ করবে।
প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি চলে গেছেন, কিন্তু আপনি আছেন। আমরা আপনাকে ভালবাসি।
Thumbnails managed by ThumbPress
২৭টি মন্তব্য
তৌহিদ
ছাত্রাবস্থায় কত যে লুকিয়ে হুমায়ূন পড়েছি সে হিসেব করা মুশকিল। আমার গল্প পড়ার প্রথম ভালোবাসা ছিলো তার লেখা বই। আমি কখনওই ব্যক্তি হুমায়ুন আর লেখক হুমায়ূনকে এক করিনি। কারণ লেখক সত্তার সাথে ব্যক্তিকে মেলায় বোকারা।
ধন্যবাদ নাজমুল, আজকের দিনে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
নাজমুল আহসান
সুন্দরের জয় হোক।
ভালো থাকবেন।
রাফি আরাফাত
যদিও নিজে থেকে হুমায়ুন আহমেদকে খুব একটা ভালো লাগে না তাও ভালো লাগতে বাধ্য৷ লেখা ভালো লাগছে ভাই।
ভালো থাকবেন
নাজমুল আহসান
আপনার প্রথম বাক্যটা বুঝিনি। কিছু মনে করবেন না, আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম!
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
রাফি আরাফাত
ভাই বুদ্ধি নিয়ে কেন কথা বললেন জানি না। আমি বলেছি নিজের থেকে হুমায়ুন আহমেদ কে আমার তেমন ভালো লাগতো না। কিন্তু তার লেখা পড়ার পর ভালো লাগতে বাধ্য। এটাই বলেছি। ধন্যবাদ
নাজমুল আহসান
আপনি দেখি সিরিয়াসলি নিয়েছেন! লিখেছেন “তাও ভালো লাগতে বাধ্য”, এটা যে আসলে লেখা ভালো লাগার কথা বলেছেন বুঝতে পারিনি।
আমার বুদ্ধি আসলেই কম, এবার বুঝলেন তো? 😀
রাফি আরাফাত
হুম বুজলাম।শুভ কামনা
জিসান শা ইকরাম
হুমায়ুন আহমেদ আমাদের মনে কতটা প্রভাব বিস্তার করে গিয়েছেন তা আমরা ভালোভাবেই উপলব্দি করতে পারি। তার ধারাবাহিক নাটকের জন্য অপেক্ষা করতাম। আপনি তা ভালোভাবেই বর্ননা করেছেন।
আমাদের বই পড়ার আগ্রহ তিনি তৈরি করেছেন। কোলকাতার লেখকদের একচেটিয়া প্রধান্য তিনি খর্ব করেছেন।
মানুষের মনে একজন লেখক কতটা স্থান করে নিয়েছেন উনি এর প্রমান পাওয়া যায়, এখনো তার বইয়ের চাহিদা দেখে।
তাঁর চলে যাওয়াতে আমিও কেঁদেছি। সমালোচকরা টিকে আছে তাঁর সমালোচনা করেন তাই।
তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।
মাঝে মাঝে লিখলে তো পারেন,
শুভ কামনা।
নাজমুল আহসান
হঠাৎ হঠাৎ যখন মনে কোনো ভাবের উদয় হয়, তখন লিখি। দুঃখের কথা হচ্ছে, সর্বমুখী চাপে ভাব কাছে আসার সময় পায় না! তবু আশা, আবার লিখব।
জিসান শা ইকরাম
ব্যস্ততা আমাদের দেয়না অবসর,
সবার জন্যই একই অবস্থা।
তবু আশায় থাকি।
সাবিনা ইয়াসমিন
হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে লেখা যেকনো লেখকের জন্যে দুঃসাহসীক ব্যপার। ব্যক্তি হুমায়ুন তার পরিচয় সব কিছুতে বিস্তৃত। গবেষক, যাদুকর, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা পিতা, রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান কত কত পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন। এগুলো ছাপিয়ে তিনি বাংলার সাহিত্যের প্রতিটি শাখাকে পরিপূর্ণ রুপ দিয়েছেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের পদ তার দখলে। চলচিত্র জগতে সম্মৃদ্ধি এনেছে তার নির্মিত সব কয়টা ছায়াছবি। শংখনীল কারাগার, শ্রাবণ মেঘের দিন,থেকে শুরু করে ঘেঁটু পুত্র কমলা সব ছবিই জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করেছে। তিনি লিখেছেন অসংখ্য শ্রুতিমধুর গান। যে গান গুলো এখনো মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে।
শ্রদ্ধেয় এই কথা সাহিত্যিকের আত্মার চির শান্তি প্রার্থনা করি।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, এইদিনে তাকে নিয়ে লেখার জন্যে। ভালো থাকুন। শুভ কামনা 🌹🌹
নাজমুল আহসান
হুমায়ূনরা অনেকদিন, শত বছর পরপর আমাদের কাছে আসেন। আবার নতুন কেউ আসবেন, আমাদের মধ্যবিত্ত দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ নিয়ে লিখবেন -আশায় থাকি। 🌹🌹
ছাইরাছ হেলাল
হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত না আমি, তাও তাঁকে যে ভাবে যতটুকু অনুভব করি
তা অন্য কাউকে করি কী না বলতে পারি না। তার অনেক বই না পড়লেও বেশ কিছু পড়েছি।
হিমু আমার খুব প্রিয়। এখন ও মনে পড়লে আনমনা হই।
বেঁচে-বর্তে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে ক্ষণজন্মা আমাদের এই প্রিয় লেখক।
যিনি একাই এক হাতে পাল্টে দিয়েছেন আমাদের পাঠ-জগৎ।
ভাল থাকুন আপনি, যেখানেই থাকুন না কেন।
এমন দিনে আপনার আবেগময় লেখাটি পড়ে পেছেনে ফিরে গেলাম।
নাজমুল আহসান
তিনি একাই এক হাতে পাল্টে দিয়েছেন আমাদের পাঠ-জগৎ। সহমত।
শিরিন হক
হুমায়ুন আহম্মেদ এর খুব ভক্ত না হলেও তার লেখা পরেছি অনেক। তার অবদান সাহিত্যে, মিডিয়ায় অতুলনীয়। মানুষের মন জয় করার জাদুকর তিনি।
শুভকামনা পনাকে।
নাজমুল আহসান
তিনি যাদুকর। চন্দ্রগ্রস্ত যাদুকর।
শিরিন হক
শুভ কামনা আপনাকে।
মনির হোসেন মমি
আমাদের সময়টাতে হুমায়ুন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলন ই ছিলেন রামান্টিক পারিবারিক সাহিত্যের জনক।অন্যরা আমাদের পাঠক হৃদয়কে তেমন ভাবে সাড়া জাগাতে পারেননি।আজ সে নেই।পড়ে আছে তার অসংখ্য স্মৃতি। ওপারে সে ভাল থাকুক এই কাম্য। লেখায় ১০০% মার্ক।
নাজমুল আহসান
হুমায়ূন আহমেদকে আমি কোনোভাবেই রোম্যান্টিক সাহিত্যের লেখক বলতে চাই না। মিলন সাহেবের ব্যাপার আলাদা।
শাহরিন
অনেক শ্রদ্ধার একজনকে নিয়ে লেখেছেন। লেখায় তার প্রতি আপনার ভালোবাসা না বোঝার মতো নয়। আমি বুড়ি হয়েই তার লেখা পড়েছি। কতো সহজ করেই মনের কত কথা লিখে ফেলতেন। অনেক দূরদর্শী চিন্তা ভাবনার এমন লোক অন্তত আমি দেখিনি। আপনার লেখা পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ।
নাজমুল আহসান
শুভ কামনা
সাবিনা ইয়াসমিন
মাঝে মধ্যে না লিখে আরেকটু বেশি লেখা দিলে কি হয়?
নাজমুল আহসান
দিলে তো ভালোই হয়। লেখার সময় বের করতে পারি না। ভাবছি একটা হেল্পার নেব, শ্রুতিলেখক। 😀
সাবিনা ইয়াসমিন
এখন তাহলে খুলেই বলি। আমার পেটে বেশিক্ষন কথা আটকে রাখতে পারিনা। গতকাল ব্লগে ঢুকে যখন আপনার এই পোস্টের শিরোনাম আর শিরোনামের নীচে লেখকের নাম দেখলাম, আমার চোখজোড়া মনের অজান্তেই দেয়াল ঘড়ির দিকে চলে গেছিলো।
কারন, নাজমুল আহসানের লেখা মানেই রহস্য গল্প। আর ঐ রহস্যের জট খুলতে খুলতে আমার মাথার চুলে জট পাকিয়ে যায়। তবুও জট সমেত মাথা নিয়েই পুরো লেখা গিলতে থাকি। এত সুন্দর লেখা কখনোই মিস করতে চাইনাতো!!
একটু বেশি বেশি লিখলে আপনার সময় একটু লস হয়, মানছি। কিন্তু আমাদের মত অ-লেখকদের লাভ হয় ষোলআনা। একটু একটু পড়ে শিখে লেখক হওয়ার সুযোগ কে মিস করতে চায়!!? 😀😀
নাজমুল আহসান
আরেকটা রহস্য গল্প মাথায় ঘুরছে কয়েকদিন ধরে। হঠাৎ একদিন ব্লগে এসে দেখবেন লিখে ফেলেছি। 🙂
রেহানা বীথি
হুমায়ূন আহমেদকে দিয়েই শুরু, তারপর আর থামিনি। এখন আমার দুই কন্যা তাঁর ভক্ত। চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। শ্রদ্ধা জানাই প্রিয় লেখককে।
নাজমুল আহসান
ধন্যবাদ।