চন্দ্রগ্রস্ত যাদুকর

নাজমুল আহসান ১৯ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ১০:৫৭:০১অপরাহ্ন সাহিত্য ২৭ মন্তব্য

বড় বোনের নাম আসমানী। আসমানীর সঙ্গে মিল রেখে তার পরের জনের নাম। জামদানী। তৃতীয়জনের জন্যে মিলের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। তার নাম পয়সা।

বইটার প্রথম দু'লাইন পড়ে  চমকে উঠলাম। খুব সাবলীল ভাষা, ছোট ছোট বাক্য! আমাদের পরিচিত গল্পগুলোর মতো নয়। পড়লেই এক ধরণের আরামবোধ চলে আসে।

তখন সম্ভবত সিক্স-সেভেনে পড়ি। পড়াশুনা ছাড়া বাকি সবকিছুতেই আমার প্রচন্ত আগ্রহ। নিয়ম করে ছবি আঁকি, দুর্দান্ত মার্বেল খেলি আর হরেক কিসিমের বই পড়ি। বই নিয়ে আমার বাছবিচার ছিল না। সামনে যা পাই, সেটাই পড়ি।

বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে আরও কয়েক বছর আগে। আমাদের রেল স্টেশনে সোহেল ভাইয়ের বইয়ের দোকান- রেলওয়ে বুকস্টল। দুই টাকায় ঠাকুর মা'র ঝুলি, গোপাল ভাঁড় আর বিভিন্ন রকমের ভুতের গল্পের বই পাওয়া যেত। বাজেটে কুলোয় না, তবু মাসে আটটা-দশটা বই কিনে ফেলি।

এরপর ধীরে ধীরে বইয়ের ধরণ পাল্টাতে লাগল। এলো দস্যু বনহুর, তিন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্র থেকে নজরুল, মানিক থেকে রবীন্দ্রনাথও হাতে নিতাম। রহস্য পত্রিকা, কিশোর কণ্ঠ কিংবা দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলোতে টুকটাক লিখতে শুরু করলাম।

আমার পরিচিত গল্প-উপন্যাসগুলো শুরু হতো একই ধাঁচে- "গ্রামের নাম শান্তিপুর। গ্রামের মাঝ দিয়ে একেবেকে বয়ে গেছে নদী..." -এই ধারার বাইরে, একেবারেই অ-কেতাবি, অপ্রচলিত ভাষায় আসমানীদের গল্প পড়ে তাই আমাকে চমকে উঠতে হল। এক বৈঠকে পড়ে ফেললাম বুকে হাহাকার তোলা গল্পটা। জমির আলীর তিন কন্যার গল্প। বইয়ের নাম আসমানীরা তিন বোন, লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদের নাম জানতাম। তখন টেলিভিশন বলতে বিটিভি আর বিনোদন মানেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক। কোথাও কেউ নেই কিংবা আজ রবিবার ততদিনে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমরা মতিকে চিনি, পাগলাটে বড় চাচাকে চিনি। চিনি বদি, মজনু আর বাকের ভাইকে। দুশ্চিন্তার প্রহর গুনি, বাকের ভাইয়ের কি সত্যি ফাঁসি হয়ে যাবে?

এর বাইরেও যে একজন হুমায়ূন আহমেদ আছেন, সেটা জানতাম না। আসমানীরা তিন বোন আমাকে হুমায়ূনের অদ্ভুত যাদুর জগতে নিয়ে গেল। আমি পরিচিত হলাম মিসির আলির সাথে, শুভ্র আর হিমুর সাথে। জরি আর পরীর সাথে, রূপার সাথে।

সেই শুরু। এরপর থেকে আমি হুমায়ূনের বই পেলেই গোগ্রাসে গিলেছি। ডানে-বামে অনেক বই-ই পড়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি কোনো সাহিত্যই আমাকে অতটা স্পর্শ করতে পারেনি, যেমন পেরেছে হুমায়ূনের লেখা। মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনা হুমায়ূন যতো নিপুণভাবে বলেছেন, তেমন কি আর কেউ বলতে পেরেছেন? বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাবে -এর চেয়ে বড় আতংক আর কোনো কাল্পনিক চরিত্র বাঙ্গালীকে দিতে পেরেছে?

ধানমন্ডির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কতদিন দখিন হাওয়ার সামনে গিয়ে থমকে গেছি। কলাবাগানের গলিতে চলতে গিয়ে মনে হয়েছে, হয়তো রূপা কোনো এক বারান্দায় নীল শাড়ি পড়ে হিমুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। নিদারুণ এক প্রেম! কী দারুণ এক ভালবাসা!

হুমায়ূন চলে গেছেন আজ সাত বছর। একেবারে কাছের আত্মীয়ের বাইরে এই একজন মানুষের মৃত্যুই আমাকে কাঁদাতে পেরেছে। আমি হু-হু করে কেঁদেছি। সমগ্র জাতি কেঁদেছে। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের যে ঢল আমি দেখেছি, আমি নিশ্চিত আমাদের প্রজন্ম এমন কিছু দেখার সুযোগ আর পাবে না। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তাঁর মৃত্যুর পর টানা কয়েকদিন লাল কালিতে যে শিরোনাম করেছে, এমন আর কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।

হুমায়ূনকে নিয়ে সমালোচনা আছে। তাঁর লেখা নিয়ে সমালোচনা আছে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে কেউ নন, কিন্তু যাঁরা হুমায়ূনের সমালোচনা করেছেন, তাঁদেরকেও আমরা চিনি। আমরা জানি কে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছে আর কে পারেনি। সময়ই ভালো-মন্দ নির্ধারণ করবে।

প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি চলে গেছেন, কিন্তু আপনি আছেন। আমরা আপনাকে ভালবাসি।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ