মাহবুবুল আলম //

 বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে এন্ড্রু কিশোর এক অপ্রতিদ্বন্দ্বি নাম।  গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের গানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। এন্ডু কিশোরের গাওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় গান মানুষের মুখে মুখে। উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহীতে বেড়ে ওঠা এই গায়ক আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন।  ৪ নভেম্বর, ১৯৫৫ জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর-এর জন্ম রাজশাহীতে । দেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।  সেখানেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশর। এক সময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। অচেনা এই শহরে শুরু হয় তার গানের যুদ্ধ। ক্লান্তিময় পথ পেরিয়ে নিজেকে তিনি একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। একে একে অনেক কিছুই তার কাছে ধরা দিয়েছে প্রথম হয়ে।  তিনি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ,"আমার বুকের মধ্যে খানে" প্রভৃতি।এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের "অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ" গানের মধ্য দিয়ে। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের "ধুম ধাড়াক্কা"। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রতীজ্ঞা চলচ্চিত্রের "এক চোর যায় চলে" গানে প্রথম দর্শক তার গান শুনে এবং গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের "ধুম ধাড়াক্কা"। তিনি অন্যান্য প্লেব্যাক গান রেকর্ড করেন যেমন 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে', 'ভালবেসে গেলাম শুধু' এর মত জনপ্রিয় সব গান। ১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তার অন্যতম গান হলো জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প।

এন্ড্রু কিশোর আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সঙ্গীত পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। তার প্রথম গাওয়া গান হল আলম খান সুরারোপিত চলচ্চিত্র 'প্রতীক্ষা', সিনেমা থেকে 'এক চোর যায় চলে'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান শ্রেণী রাজশাহী বেতার সঙ্গে তালিকাভূক্ত ছিল। কিশোর এছাড়াও টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার উত্পাদন করে যা তার প্রবাহ মিডিয়া নামের একটি প্রোডাকশন হাউস কাজ করেন। এন্ড্রু কিশোর এছাড়াও একজন ব্যবসায়ীও ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর, দিদারুল আলম বাদল, শামসুল ইসলাম নান্টু সাথে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান 'প্রবাহ' শিরোনামে উদ্বোধন করেন। কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় সিনেমা সমূহ: • ১৯৯২ - শঙ্খনীল কারাগার • ১৯৯৪ - সুজন সখি• ১৯৯৪ - অন্তরে অন্তের • ১৯৯৫ – দেনমোহর চলচ্চিত্রে নিয়মিত প্লেব্যাকের পাশাপাশি সম্প্রতি শেষ হওয়া সঙ্গীতবিষয়ক রিয়েলিটি শো বাংলাদেশী আইডলের বিচারক ছিলেন এ জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী।

গত বছরের ৯ সেপ্টেস্বর শরীরের নানা জটিলতা নিয়ে সিঙ্গাপুর চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন তিনি। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তার শরীরে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। ছয়টি ধাপে তাকে মোট ২৪টি কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সেখানে কয়েক মাস আটকে থাকার পর ১১ জুন রাতে একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আনা হয়েছে তাকে। ঢাকায় ফেরার দুদিন পরই রাজশাহীতে চলে যান তিনি। প্রথম দফার চিকিৎসা শেষ হলেও চেকআপের জন্য তিন মাস পর পর তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে যেতে হবে। তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা সহায়তা করেছিলেন।

মাত্র একদিন আগে এন্ড্রু কিশোরের ভগ্নিপতি ডা. প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, দাদার অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এখানে আমাদের বাসা ও ক্লিনিক একসঙ্গে। তাই এখানেই অক্সিজেন দিয়ে রেখেছি। এখন কথা বলার মতো অবস্থায় আমরা নেই। এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে কোনো ধরনের গুজব না ছড়াতে অনুরোধ করেন বিপুল। তিনি বলেন, ভালো-মন্দ যাই ঘটুক, আমরাই জানাব। আমরা মানসিকভাবে এমনিতে ভালো নেই, কোনো গুজব ছড়াবেন না প্লিজ। এদিকে এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যু নিয়ে অনেকে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকে। এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে তার পরিবার।

দীর্ঘ দিন ক্যান্সারে ভুগে অবশেষে ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়েছেন দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। সোমবার ০৬ জুলাই ২০২০ সন্ধ্যায় মারা গেছেন এই খ্যাতিমান শিল্পী। এর আগে কষ্ট সইতে না পেরে দ্রুত নিজের মৃত্যু কামনা করেছিলেন তিনি। এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী সোমবার সন্ধ্যার আগে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এ তথ্য জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।’ লিপিকা লিখেছিলেন, ‘ক্যানসারের শেষ ধাপে খুব যন্ত্রণাদায়ক। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।’ তিনি আরও লিখেছিলেনন, ‘আমার মনে হল, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত শ্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’

এন্ড্রু কিশোরের দুটি সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয় জনের নাম সপ্তক। অস্ট্রেলিয়ায় থাকা এন্ডু কিশোরের দুই ছেলেমেয়ে দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশেষ ফ্লাইটের টিকিট পাওয়াটাও বেশ কষ্টসাধ্য। সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন এন্ড্র কিশোরের দুই সন্তান। টিকিট পাওয়া মাত্রই তারা দেশে ফিরবেন। তারপরই হয়তো তার সৎকার করা হবে।

এন্ডু কিশোরের সাথে একটুকরো স্মৃতি স্মরণ করে শেষ করছি।মানুষের জীবন কত সংকীর্ণ!! সেই ধারায় বাংলাদেশের সংগীত জগতের কিংবদন্তীতুল্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর চলে গেলেন ওপারের ডাকে। কি বা এমন বয়স হয়েছিল তার। এন্ড্রু কিশোরের   জন্ম: ৪ নভেম্বর, ১৯৫৫। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। ২০১০ সালে অমর একুশের গ্রন্থমেলায় আড্ডা শেষে চলে যাওয়ার মুহূর্তে তিনি নিজ থেকেই-বলেছিলেন আসুন একটি ছবি  তোলি। এই সেই স্মৃতিময় ছবি। বাম দিক থেকে: এন্ড্রু কিশোর, আমি ও আমার স্ত্রী রোকেয়া চৌধুরী। ছবিটি তোলেছিলেন- ছড়াকার, কবি ও শিশুসাহিত্যিক আসলাম সানী ভাই।

পরমেশ্বর এন্ডু কিশোরের বিদেহী আত্মাকে চিরশান্তিতে রাখুন!!

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ