আমাদের সবচেয়ে প্রিয় দিবসটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই দিনে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সাথে নয়মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিল। তাই ১৬ই ডিসেম্বর এই এদিনটি সারাদেশে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে অতি প্রিয়, অতি আনন্দের একটি দিন বা দিবস। যা প্রতিবছর ইংরেজি ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে মহা সাড়ম্বরে পালিত হয়। নারায়ণগঞ্জেও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে এই মহান বিজয় দিবস পালন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বিজয়ের আনন্দ উল্লাস করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় আয়োজন করা হয় নানারকম খেলাধুলা-সহ সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের। এসব এলাকার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইলের পানির কল এলাকায় অবস্থিতি বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা হলো একটি।

এই সংস্থাটি পাট আমদানি রপ্তানি-সহ গুদামজাত ও পাটা বেলিং করার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সংস্থা। যা বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ) বা সংক্ষেপে কো-অপারেটিভ নামে নারায়ণঞ্জবাসীর কাছে পরিচিত। এই সংস্থাটি শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে নারায়ণগঞ্জ পানি শোধনাগার (পানির কল) এলাকায় অবস্থিত। এখানে পাটের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলাশহর থেকে নদীপথে এবং স্থলপথে পাট আসে। সেই পাট যাচাই-বাছাই করে প্রথমে জুট প্রেসে (বেলিং মেশিন) ৮৫ কেজি করে বেল আকারে তৈরি করা হয়। এরপর পাটের বেল গুলি হয়তো গুদামজাত, নাহয় সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এভাবে বছরের বারোমাস এই সংস্থায় পাট যাচাই-বাছাই ও পাট বেলিং করা এবং পাট আমদানি করা হয়।

যাঁরা এখানে পাটের কাজ করে তাঁদের বলে পাট শ্রমিক। সংস্থার অভ্যন্তরে পাট শ্রমিকদের এবং সংস্থার কর্মচারীদের বসবাস করার ভিন্ন ভিন্ন কোয়ার্টার আছে। শ্রমিক কর্মচারীদের ছেলেপেলে আছে। সংস্থা অভ্যন্তরে মসজিদ আছে। আগে খেলার মাঠ ছিল। ভেতরে একটি বিশাল পুকুরও আছে। আগে দুইটি পুকুর ছিল। এখন একটি। এই পুকুরে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের যেকোনো সময়ে বরশি দিয়ে মাছ শিকারের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তা এখনো হয়। একটা টেক্সটাইল মিলও ছিল। টেক্সটাইল মিলটির নাম ছিল, "মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল"। ১৯৮৬-১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই মিলে আমি কর্মরত ছিলাম। এরপর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত চলে যাই। ভারতে প্রায় দেড়বরের মতো থেকে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে অবশেষে খালি হাতপা গুটিয়ে আবার নিজ দেশে চলে আসি।

ভারত থেকে এসে আবার এই মিলের সাথে একই এলাকায় অবস্থিত "গাজী টেক্সটাইল মিল" এ যোগদান করি। আমি আলাদা মিলে কাজ করলেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে যায় বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার অভ্যন্তরে থাকা, আর মহিউদ্দিন টেক্সটাইল মিলের সকল শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে। যদিও আমি বর্তমানে অন্য এলাকায় বসবাস করি, তবুও বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা অভ্যন্তরের সকল শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে আমার আজও সেই অনেক দিনের সুসম্পর্ক থেকেই যায়। এই সুসম্পর্ককের মধ্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কেবলমাত্র একজনের সাথে। সেই ব্যক্তিটির নাম মোহাম্মদ শাজাহান মিয়া। মোহাম্মদ শাজাহান মিয়াও কোনোএক সময় মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে আমার সহকর্মী ছিল। তবে তাঁর ধর্ম ইসলাম, আমার ধর্ম সনাতনী হিন্দু। বন্ধুত্বের মাঝে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই, তা চিরসত্য। আমাদের দুইজনের মাঝে আজ পর্যন্ত ধর্ম নিয়ে কোনপ্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘটেনি। তাই মনে হয় আমরা দুইজন কোনও এক জনমে একই মায়ের গর্ভে ধরা আপন দুই ভাই ছিলাম। এখনও আমরা দুইজন একসাথে হাঁটলে এলাকার লোকে বলে জোড়া কবুতর।

বন্ধু মোহাম্মদ শাজাহান মিয়া। তাঁর কোলে বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার একজন পাট শ্রমিকের শিশুকন্যা।   

বর্তমানে সংস্থার অভ্যন্তরে থাকা যেকোনো শ্রমিক কর্মচারীদের বিয়েসাদী, মুসলমানী-সহ ঘরোয়া এবং রাষ্ট্রীয় সব দিবসের অনুষ্ঠানে  নিমন্ত্রণ মোহাম্মদ শাজাহান মিয়ার তরফ থেকেই পেয়ে থাকি। তাঁদের নিমন্ত্রণ পেলে শত কাজের মাঝেও আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমাকে ছুটে যেতে হয়, বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার অভ্যন্তরে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। যাক সেই কথা। ফিরে আসি বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবস নিয়ে খুটিনাটি বিস্তারিত আলোচনায়।

বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থাটি বিশাল এলাকা জুড়ে হলেও, বর্তমানে এখানে কোনও খেলার মাঠ নেই। খেলার মাঠ যা-ই ছিল, পাটের আমদানি রপ্তানি বেশি হওয়ার কারণে খেলার মাঠেও পাট রাখার গুদামঘর নির্মাণ করে সংস্থা কর্তৃপক্ষ। সেসব গোডাউনে সারাবছর পাট গুদামজাত করে রাখা হয়। তাই সংস্থার অভ্যন্তরে থাকা শ্রমিক কর্মচারীদের ছেলে- মেয়েদের খেলাধুলা পরিত্যক্ত বাড়ির আঙিনা বা উঠোনের মতো খালি জায়গায়। নাহয়, সংস্থার বাইরে থাকা কোনও-না-কোনও মাঠে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি, মহরম, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের খেলাধুলা যা-ই হয়, তা সংস্থার ভেতরেই করা হয়।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও গত হওয়া ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার অভ্যন্তরে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। আমি বন্ধু মোহাম্মদ শাজাহান মিয়া থেকে নিমন্ত্রণ পেলাম ১৫ই ডিসেম্বর রাতে। পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের সূচনা লগ্নে বন্ধু মোহাম্মদ শাজাহান মিয়া আমাকে ফোন করে বলল তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি আমার অফিসের কাজ ফেলে রেখে একটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চলে গেলাম, বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থায়। সংস্থার সামনে যেতেই শোনা যাচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ, "এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। শোনা যাচ্ছে, বিজয়ের গান, "জয় বাংলা বাংলার জয়"। বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার ভেতরে গিয়ে দেখি খেলায় অংশগ্রহণকারী ছেলে- মেয়েদের নাম সাদা কাগজে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার ভেতরে যেসব খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছিল, তা নিম্নরূপ:
১। মেয়েদের দড়ি খেলা। চারজন করে তিন ধাপে।
২। মেয়েদের সুঁই-সুতা গাঁথা। একসারিতে কোলজন।
৩। মেয়েদের চেয়ার বসা। একসাথে দশজন।
৪। মেয়েদের লংজাম্প। অংশগ্রহণকারী পঁচিশজন।
৫। মেয়েদের বিস্কুট খেলা। একসাথে পনেরোজন।
৬। ছেলেদের লংজাম্প। পঁচিশজন।
৭। ছেলেদের দাইড়া খেলা।
৮। ছেলেদের মোরগ লড়াই। একসাথে ছয়জন করে।
৯। ছেলেদের দৌড় খেলা। ছোট এবং বড় দুইভাগে।
১০। ছেলেদের ব্যাটমিন্টন খেলা। তা হবে সন্ধ্যার পরে।
১১। ছেলেদের হাঁস ধরা প্রতিযোগিতা। তা হবে পুকুরে।
সবশেষে যেমন খুশি তেমন সাজ।

https://m.youtube.com/watch?v=OzJmO-hMm4Q&t=178s

এই ভিডিওতে মাত্র তিনটি খেলার ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। তারপর নিজের মোবাইলে আর চার্জ ছিল না। 

বিজয় দিবসের দিনে আমার হাতে তেমন সময় ছিল না। নিজের ব্যবহারিক মোবাইল ফোনেও চার্জ ছিল না। অল্প কিছু সময় সেখানে ছিলাম। কয়েকটা খেলা দেখলাম। মোবাইলে যতটুকু চার্জ ছিল, তা দিয়েই দুই-তিনটা খেলার ছবি ওঠালাম। একটি ভিডিও করলাম। এর মাঝেই ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা দেখে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে গেলাম নিজের ছোটবেলার স্মৃতিতে। এসব খেলা নিজেও একসময় খেলেছি। কোনোএক সময় স্কুলজীবনে বিজয় দিবসের সময় নিজেও এসব খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। আজ বন্ধু শাজাহান মিয়ার নিমন্ত্রণে এখানে আমন্ত্রিত হয়ে ক্ষণিকের জন্য বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থায় অনুষ্ঠিত এবারের ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের সাক্ষী হয়ে থাকতে পেরে ধন্য হলাম। তাই বন্ধু শাহজাহান মিয়া-সহ বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার সকলকে এবং সোনেলা উঠোনের সবাইকে বিজয় দিবসের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। বারবার  ফিরে আসুক আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বিজয় দিবস। জয় হোক বাংলার মেহনতী মানুষের।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ