স্বাধীনতা সংগ্রামী মণীষা-২ : শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক

(অক্টোবর ২৬, ১৮৭৩-এপ্রিল ২৭, ১৯৬২)

[মণিষীরা বলেছেন “যে জাতি তার বীর সন্তানদের মূল্য দিতে পারে না সে জাতির কোনোদিন বীর সন্তান জন্ম নিতে পারে না।”আমরা আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামী আত্মদানকারী মণিষাদের সম্মন্ধে কত টুকুই বা জানি। যারা প্রবীণ তারা হয়তো কিছু কিছু জানে, কিন্তু আমাদের নবীন প্রজন্ম সেসব মণিষাদের সম্মন্ধে তেমন কিছুই জানে না।তাই সব শ্রেণির পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মণিষার জীবনী নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।]

-মাহবুবুল আলম 

বাঙালি জাতি যে কয়েক জন কৃতিসন্তান নিয়ে গর্ভবোধ করে থাকে; তাঁদের মধ্যে একজন শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি বাংলার এক দরদী সন্তান। আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি শেরে বাংলা নামেই অধিক পরিচিত। তিনি বাংলা হাজার হাজার কৃষককে ঋণমুক্ত করার জন্য ১৯৪০ সালে মহাজনি আইন পাস করেন। ১৯৪২ সালে ফজলুল হক অভিবক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শের এ বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলার এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। বাংলাদেশেকে এবং এদেশের রাজনীতিকে জানতে হলে, বুঝতে হলে শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হককে জানতে হয়। কেননা, বাংলাদেশের অতীত মানেই শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক। উনিশ শতকের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি। প্রায় সাত দশকের মত মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বাঙালি রাজনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট 'শের-এ-বাংলা' এবং 'হক সাহেব' নামে পরিচিত। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬ - ১৯৫৮) অন্যতম।যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুক হক ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুক হকের পূর্বপুরুষ আঠার শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পুটয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের কাজী মুর্তজা একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র কাজী মুহম্মদ আমিন। কাজী মুহম্মদ আমিনের পুত্র মুহম্মদ আকরাম আলী বরিশাল কোর্টে আইনব্যবসা করতেন। তার দুই পুত্র কাজী ওয়াজেদ, কাজী আবদুল কাদের ও পাঁচ কন্যা। কাজী ওয়াজেদের একমাত্র পুত্র ছিলেন এ. কে. ফজলুক হক। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৮৪৩ সালে চাখারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেন। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ গ্রাজুয়েট ছিলেন। ১৮৭১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি বি. এল. পাশ করে আইন ব্যবসা শুরু করেন। মুহম্মদ ওয়াজেদ রাজাপুর থানার সাতুরিয়া মিয়া বাড়ির আহমদ আলী মিয়ার কন্যা বেগম সৈয়দুন্নেছাকে (শেরে বাংলার মা) বিয়ে করেন। মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বরিশালে মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র ছিলেন। এ. কে. ফজলুক হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহশিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ফজলুল হক তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন।

শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুক হক ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। নিজের মেধার বলে ফজলুল হক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ. কে. ফজলুক হকের জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।

এ. কে. ফজলুক হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই.-এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুক হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেন। তাঁদের সন্তান এ. কে. ফাইজুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৭ সালে মারা যান।

১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুক হক । দুবছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালের ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এ সময়ই তিনি বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখার্জির অনুরোধে ওই কলেজে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। পূর্ব-বাংলার গভর্ণর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকুরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে দাঙ্গা বন্ধ হয়। জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন, পরবর্তী জীবনে এর প্রতিকার করতে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা হয়, তা তার জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। ১৯০৮ সালে এস.ডি.ও’র এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের সাথে বনাবনি না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দিলেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ।

শিল্প-সাহিত্যের সাথে এ. কে. ফজলুক হকের সান্নিধ্য ঘটে বরিশালে। কিশোর কিশোরীদের জন্য এ সময় তিনি নিজের সম্পাদনায় “বালক” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি “ভারত সুহৃদ” নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নবযুগ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রখ্যাত বামপন্থি রাজনীতিবিদ কমরেড মুজাফফর আহমেদের প্রস্তাবে এ. কে. ফজলুক হক নবযুগের প্রকাশনাতে সাহায্য করতে সমর্থ হন। নজরুলের আগুন ঝরানো লেখার কারণে “নবযুগ” হু হু করে বিক্রি হতে লাগলো। কলকাতা হাইকোর্টের ইংরেজ বিচারপতি টিউনন ফজলুল হক সাহেবকে নিজের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে বৃটিশ সরকার বিরোধী লেখার জন্য হুশিয়ার করে দেন। কিন্তু ফজলুল হক ভয় না পেয়ে টিউননের কাছ থেকে ফিরেই নজরুলকে খবর দিয়ে বলেন, “আরো গরম লিখে যাও, ইংরেজ সাহেবদের টনক নাড়িয়ে দাও”।

বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান অশ্বিনীকুমার দত্ত এ. কে. ফজলুক হককে কমিশনার পদে প্রার্থী হবার আহবান জানান। এ. কে. ফজলুক হক পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে সদস্য নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমেই এ. কে. ফজলুক হকের রাজনৈতিক জীবনে সূত্রপাত।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাংলার জনগন বিভক্ত হয়ে পড়লে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন দরকার। এই চিন্তা থেকেই ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। এই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব¡ লাভ করেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিল-এ। এই কনফারেন্সে নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন ও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১২ সালে এ. কে. ফজলুক হক মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু এই সংগঠনের সাথে সাংগঠনিক নানা বিষয়ে তার বিরোধ বাধে।  ১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ. কে. ফজলুক হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সার পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন। ১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষা বিভাবের ডি.পি.আই হর্ণেল সাহেব তখন ফজলুল হকের শিক্ষা বিষয়ক উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে বাংলার “বেন্থাম” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

১৯১৪ সালের ঢাকার আহসান-উল্লাহ-ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল বর্তমানে বুয়েট প্রাঙ্গনে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৮ সালে দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন।১৯১৪ সালে ফজলুল হক নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের নেতা হয়ে উঠেন। ১৯১৮ তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। এ. কে. ফজলুক হক খেলাফত আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ. কে. ফজলুক হক নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে এ. কে. ফজলুক হক খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন এবং নির্বাচিত হন।১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু-এর নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল স্বরাজ্যদল। ১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থকে তিনি পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এ সময় বাংলার গভর্ণর ছিলেন লিটন ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও মন্ত্রী নিয়োগ করেন। এই দলের অন্যতম কর্মসূচি ছিল আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে সরকারি নীতির বিরোধীতা সহ সরকারি বাজেট বা আয়-ব্যয়য়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। স্বরাজ্য পার্টি ১৯২৪ সালের বাজেটের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। এ সময় ১৯২৪ সালের ১ আগস্ট এ. কে. ফজলুক হক মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তাফা দেন।

ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্ধারণের লক্ষ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ড একটি গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধী এই বৈঠক প্রত্যাখান করেন। কিন্তু, মুসলিম লীগ সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করে।১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেয়ার পর থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েছিলেন কৃষকদের রাজনীতি নিয়ে। ১৯৩০-১৯৩১ সালের প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে ফজলুল হক বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলনে। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে বক্তৃতা দেন।১৯২৯ সালের ৪ জুলাই বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য কলকাতায় একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি দল গঠনের সিধান্ত হয়। বাংলার কৃষকদের উন্নতি সাধনই ছিল এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯২৯ সালেই নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। ঢাকায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। এই সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক সর্বসম্মতিক্রমে নিখিল বঙ্গপ্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ময়মনসিংহে বঙ্গীয় প্রজা সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সঙ্গীত এবং মরমী শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের গানের মধ্যে দিয়ে এ সম্মেলন শুরু হয়েছিল। এই প্রজা সমিতির মধ্য দিয়েই পরবর্তিতে কৃষক-প্রজা পার্টির সূত্রপাত ঘটে। ১৯৩১-১৯৩২ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কংগ্রেসও যোগ দেয়। এ বৈঠকেও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের সমাধান না হওয়ায় ভারতের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব¡ চলে যায় বৃটিশের হাতে। ১৯৩৫ সালে এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।

১৯৩৭ সালের মার্চে বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে পটুয়াখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে এ. কে. ফজলুক হক ও মুসলিম লীগের মনোনীত পটুয়াখালীর জমিদার ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিদ্বদ্বিতা করেন। মুসলিম লীগ প্রার্থী খাজা নাজিমুদ্দিনের নির্বাচনী প্রতীক ছিল “হারিকেন” আর হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিল “লাঙ্গল”। কৃষক প্রজা পার্টির শ্লোগান ছিল, “লাঙল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার”। পটুয়াখালীতে এ. কে. ফজলুক হক ১৩,০০০ ভোট পেয়েছিলেন। অপরদিকে, খাজা নাজিমুদ্দিন ৫,০০০ হাজার ভোট পেয়ে ৭,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ৩৯টি আসন ও মুসলীম লীগ ৩৮ টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতায় গিয়ে এ. কে. ফজলুক হক ১১ সদস্য বিশিষ্ট যুক্ত মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। মন্ত্রীদের মধ্যে তিনজন কৃষক প্রজা পার্টির, তিন জন মুসলিম লীগের, তিন জন বর্ণ হিন্দুর এবং দুই জন তফসিলী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল এ. কে. ফজলুক হকে নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী পরিষদ গভর্ণর এন্ডারসনের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন স্যার আজিজুল হক ও ডেপুটি স্পিকার হলেন জালালউদ্দিন হাশমী। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব¡ গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ. কে. ফজলুক হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রেই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। “বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ”-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে “ক্লাউড কমিশন” গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। ১৯৩৯ সালের “বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগবিধি” প্রবর্তন করে । মন্ত্রী পরিষদ মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ চাকুরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে। এ বছরেই “চাষী খাতক আইন”-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশী বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে “মহাজনী আইন” পাস করান। এ বছরই “দোকান কর্মচারি আইন” প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ জারী করেন। কৃষি আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাটচাষীদের নায্যমূল্য পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে “পাট অধ্যাদেশ” জারী করা হয়। ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবুল কাশেম ফজলুল হক দ্বিতীয় বারের মত মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। শরৎচন্দ্র বসু ও হিন্দু মহাসভার সহ-সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে প্রগতিশীল যুক্ত পার্টি গঠন করে তিনি সেই দলের নেতা হয়েছিলেন। ১৭ডিসেম্বর এই মন্ত্রী পরিষদ বাংলার গভর্ণর জেনারেল হার্বাটের কাছে শপথ গ্রহণ করেন।

 

নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের ওয়ার্কিং কমিটির অনান্য সদস সহ এ. কে. ফজলুক হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলীম লীগের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক ছিলেন এ. কে. ফজলুক হক। এই লাহোর প্রস্তাবই “পাকিস্তান প্রস্তাব” হিসেবে পরবর্তীকালে আখ্যায়িত হয়।১৯৪৬ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে বরিশাল অঞ্চল ও খুলনার বাগেরহাট অঞ্চল থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু, দলীয়ভাবে পরাজিত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনের পর দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু দলের সদস্য হিসেবে তিনি ছিলেন নীরব।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে হক সাহেব ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ. কে. ফজলুক হক সমর্থন দেন। ১৯৫৩ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তার বাস ভবনে কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দলের নাম থেকে প্রজা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ গঠন করা হয়। আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে এই পার্টির সভাপতির দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ. কে. ফজলুক হক।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ. কে. ফজলুক হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার জন্য এ সময়ে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’কে দৈনিক পত্রিকায় রুপান্তর করা হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠা সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৯ টি আসন লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ.কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রী সভা গঠন করেন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫ মে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

 

১৯৫৫ এর ৫ জুন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পুনরায় গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এ. কে. ফজলুক হক ছিলেন এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিরোধীদলের নেতা।১৯৫৬ এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও ২৩ মার্চ তা কার্যকরী হয়। এ সময় এ. কে. ফজলুক হক পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ৮৩ বছর বয়সে করাচি থেকে ঢাকা এসে ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গভর্ণরের পদ থেকে অপসারণ করে। এরপরই তিনি তার ৪৬ বছরের বৈচিত্রময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৫৮ এর ২৭ অক্টোবর আবুল কাশেম ফজলুল হককে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক “হেলাল-ই-পাকিস্তান” খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং তাকে হলের আজীবন সদস্য পদ প্রদান করা হয়। এই সংবর্ধনা সভার পর তিনি আর কোন জনসভায় যোগদান করেননি। ১৯৬২ এর ২৭ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তিনি প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন।১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে এ. কে. ফজলুক হক ৮৬ বছর ৬ মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

 

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ