মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-৯)

শামীম চৌধুরী ৭ আগস্ট ২০২০, শুক্রবার, ০৫:০১:৩৬অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৬ মন্তব্য
বাঘের ছবি তোলার জন্য মূলতঃ আমার ভারত সফরে “মামাকে দেখতে যাওয়া” শিরোনামের গল্পটি গত ১৫ জুনের পর আর সামনের দিকে বাড়াতে পারিনি। ৮ পর্ব লেখার পর আমার অগ্রজ ভাইয়ের করোনায় আকস্মিক মৃত্যুই ছিলো মূল কারন। উনার অকাল মৃত্যুতে আমাদের গোটা পরিবার শোকে মুহ্যমান হয়ে মানসিক ভাবে ঙেঙ্গে পড়ে। যার ধাক্কা সহ্য করে নিজেকে দাঁড় করাতে বেশ কিছুটা সময় নেয়। উনার মৃত্যুর পর আমার ব্যাক্তিগত সব কাজ-কর্ম করোনার মতনই থমকে যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম ভ্রমন কাহিনীটি শেষ করা দরকার। অনেকটা দেরী করার জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আশা করি আমার পাঠক বন্ধুরা নিজ গুনে ক্ষমা করে দিবেন।
 
যত বেশী বনায়ন হবে, তাত বেশী বন্যপাখি সংরক্ষন করা যাবে। মানুষও থাকবে সুস্থ্য। কারন বন ফুসফুসের অক্সিজেন। চারিদিক সবুজে ঘেরা, হাওড়ের মতন লেক, ছোট ছোট খাল,উঁচু উঁচু গাছ, ছোপ ছোপ জঙ্গল, সবুজ ঘাসে আবৃত ঘন মাঠ ও কিছু কৃত্রিমভাবে বানানো পাখিদের প্রজননের বাসা গোটা কেওলাদেও পার্কটিকে দৃষ্টিনন্দন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঢেঁকে রেখেছে। দেখলে যে কোন প্রকৃতিপ্রেমিক ভ্রমন পিপাসুর মন কেঁড়ে নিবে। আর যদি সেই ভ্রমনকারী ফটোগ্রাফার হয় তবে একবার ভাবুন তাঁর জন্য গোটা বনটাই একটা নৈস্বর্গিক স্বর্গ। কি নেই এই পার্কে। শুধু হিংস্র প্রাণী বাঘ ও সিংহ ছাড়া।
 
সেদিন ছিলো আমাদের সফরের চতুর্থ দিন।
প্রথম দর্শনেই কেওলাদেও পার্কটির প্রেমে পড়ে গেলাম। শুনশান নীরবতা। নেই কোন যান্ত্রিক কলোরব। নেই মানব কলোহল। কোন কল-কারখানার চালিত যন্ত্রের শব্দ নেই । ভাড়ায় নেওয়া রিক্সার ঘন্টির ক্রিং ক্রিং শব্দও নেই। এমনকি কারো পায়ের শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। পাঠক বন্ধুরা, একবার ভাবুন,একটি পিনঃপতন শব্দহীন পার্কের ভিতর আমরা সবাই। আমার অনুভুতিটা কেমন ছিলো? আর পাখি কনজারভেশন বা সংরক্ষনের জন্য এমন পরিবেশ অপরিহার্য।
 
হরেক প্রজাতির পাখির কিচির-মিচির শব্দে গোটা কেওলাদেও বনটি মুখরতি। শীতকাল বলে সেখানে হাঁস প্রজাতির পাখির সংখ্যা বেশী। এদের ৯৫ ভাগই পরিযায়ী। হাঁস প্রজাতির পাখিরা হাওড়ের মতন বিলে জলকেলী করছে। কেউবা তাদের সকালের খাবারের সন্ধানে গোটা বিলের পানি উলোট-পালোট করছে। নিজ চোখে এমন দৃশ্য না দেখলে অনুভূতিটা শুধু কল্পনার তৃপ্তিতে মেটাতে হবে। তারপরও আমার বিশ্বাস পাঠক বন্ধুরা আমার সঙ্গেই সেই কেওলাদেও পার্কের ভিতরে নানান ভঙ্গিতে পক্ষী-নৃত্যের সঙ্গেই কল্পনায় নয়, স্ব-শরীরেই আছেন।
 
মূল প্রবেশ দ্বারের ভিতরেই প্রায় ১০০০ বর্গমিটার জুড়ে অফিস পাড়া। সঙ্গে একটি পর্যটক বিপনী বিতান। আছে পর্যটক ও ফটোগ্রাফারদের জন্য চা-পানের স্টল, গাইড সহ ভাড়ার রিক্সা স্ট্যান্ড। নিজ দায়িত্বে চালিত সাইকেল স্ট্যান্ড। পানি পানের সুবিধার জন্য মিনারেল ওয়াটারের মেশিন ঘর ও টিকিট ঘর। সবই এই ১০০০ বর্গমিটারের ভিতরে। আমরা বিদেশী পর্যটক বলে পাসপোর্টের ফটো কপি জমা করে ভিতরে প্রবেশের টিকিট সংগ্রহ করলাম। জনপ্রতি ভারতীয় ৬৫০টাকা। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ৫০ টাকা। সেক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয় পরিচয় পত্র দেখাতে হবে। সুতারাং আপনি যতই ভাল হিন্দি ভাষার পারদর্শী হোন না কেন ৫০ টাকায় টিকিটি সংগ্রহের কোন সুযোগ নেই। আমরা সবাই অফিসিয়াল কাজগুলি শেষ করে চায়ের স্টলে গিয়ে গরম গরম মাটির খোড়ায় আদা ও গরম মশলার এক খোড়া দুধ চা ও বিস্কিট খেলাম। নিমিষের মধ্যে ঠান্ডার রেশটা কেটে গেল। শরীরটাও বেশ চাঙ্গা হলো। যার প্রয়োজন ছিল তিনি ওয়াশরুমে গিয়ে কাজটা সেরে নিলেন।
 
প্রথমদিন আমরা ৩টি রিক্সা ভাড়া নিলাম। প্রতি ঘন্টা ১৫০ রূপী। রিক্সা ভাড়া নেওয়ার মূল কারন হলো গাইডের সুবিধা পাওয়া। প্রথমতঃ আমরা নতুন ও প্রথম সফর কিওলাদেও বনে। তাই রাস্তা ও পাখির লোকেশন আমাদের অচেনা। আমরা দুইজন করে রিক্সায় বসলাম। রিক্সাচালক নিজেই গাইড। আমারা রিক্সায় যাত্রা শুরু করলাম। ২০০ গজ সামনে চেক পোষ্ট। সেখানে আমাদের টিকিট চেক করে ছেড়ে দিলো। গাইড তার স্বভাব সূলভ হৃদয়ে হিন্দিতে কেওলাদেও বনের ইতিহাস ও কোন পাখির কোন জায়গায় অবস্থান এবং কি কি প্রজাতির পশু-পাখি আছে তার একটা ব্যাখ্যা বক্তবাকারে বললো। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথাগুলি মুখস্থ করে নিলাম। পরের দিন যেন কাজে লাগাতে পারি।
 
আমরা অনেকটা ভিতরে চলে আসলাম। কেওলাদেও বন ঘন কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা। সূর্য্য উঠার কোন লক্ষন নেই। রিক্সা চলছে আর ঠান্ডা বাতাস গায়ে জড়াচ্ছে। হাতের আঙ্গুলে বরফ ঠান্ডা অনুভব করছি। কেউ যদি আঙ্গুল কেটেও ফেলে তারপরও কোন অনুভূতি পাবার নয়। এমনটাই মনে হচ্ছে। যাত্রার সময় বনের চারিদিকটা ভাল করে দেখে নিলাম। আমাদের মাথার উপর দিয়ে বেশ কিছু ঈগল প্রজাতির পাখি উড়ে গেল। কিন্তু পর্যাপ্ত আলো না থাকায় আমাদের কিছুই করার ছিল না। ফটোগ্রাফীতে একটি প্রবাদ আছে-
“চিত্র শিল্পী ছবি আঁকে রং তুলি দিয়ে
আমরা ছবি তুলি আলো দিয়ে”।
সুতারাং আলোই যদি না থাকে তবে ফটোগ্রাফারের হাতের উপর পাখি বা সাবজেক্ট থাকলেও দু’চোখ ভরে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমার দীর্ঘ ১৬ বছরের ফটোগ্রাফী জীবনে অনেকবার এমনটি হয়েছে। যার জন্য আমার ভিতরে কোন আফসোস বা হতাশা কাজ করে না। আমি জানি দেরীতে হলেও সূর্য্য উঠবে। আর এই পাখিগুলি এখানেই থাকবে। সুতারাং এদের ছবি ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করতে পারবো।
 
২ কিলোমিটার পথ ভিতরে আসার পর দেখা পেলাম ভারতের পাখী গবেষক ও ৩৫০ প্রজাতি পাখির নামকরনঃ পক্ষী বিশারদ আমার গুরু জনাব সলিম আলীর মিউজিয়াম। যিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ভারতবর্ষে পাখি নিয়ে গবেষনা করেছেন । বাংলাদেশ থেকে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যার অধ্যাপক আলী রেজা স্যার উনার অধীনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে রেজা স্যার বাংলাদেশে প্রায় ১৫০ প্রজাতি পাখির নামকরনঃ করেন। তাই সলিম আলী স্যারের নামের সঙ্গে আলী রেজা স্যারের নামটা চলে আসে।
মিউজিয়ামে প্রবেশ না করে আমরা সামনে দিকে আগালাম। দেখা পেলাম বিশাল বোর্ডে চিহ্নিত করা গোটা কেওলাদেও বনের একটা ম্যাপ। কোন জায়গায়, কত নাম্বার লেকে বা বিলে, কোন কোন পাখির অবস্থান সবই বোর্ডে দেখানো আছে। ভারতীয় ফটোগ্রাফারদের কাছে সবই জানা। তাই তারা সাইকেল ভাড়া নিয়ে বনের ভিতর চলাফেরা করে। ম্যাপে দেখলাম উত্তর আমেরিকা থেকে আসা ফ্লেমিংঙ্গো পাখি ৬ নাম্বার জোনে। আমাদের বহন করা গাইডকে বললাম আগে সেখানে যাবার জন্য। রিক্সা দূর্বার গতিতে আমাকে নিয়ে ছুটে চলছে ৬ নাম্বার জোনে। ততক্ষনে আমার শরীরের ভিতর উত্তেজনা বেড়ে চলছে। জীবনের প্রথম নিজ চোখে ফ্লেমিংঙ্গো পাখির দেখা মিলবে।
(চলবে)
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ