
আগের পর্বের লিঙ্ক- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২০)
পর্ব-২১
মূলতঃ ২ নাম্বার জোনের হাতের ডান দিকটা বিলে ঘেরা। বাঁ দিকে পুরাটা জুড়েই সালিম আলী মিউজিয়াম ও মনোরম বাগান। এই বাগানে হরেক রকমের ফলের গাছ ও ফুলের দেখা পেলাম। সালিম আলী নিজেই বাগান পরিচর্যা করতেন। এই বনটিকে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
আমি উনার গল্প শুনে ও বই পড়ে ২০০৪ সালে বার্ড ফটোগ্রাফী ও বার্ড কনজারভেশনের প্রতি আকৃষ্ট হই। সালিম আলী ভারতীয় অধিকাংশ আবাসিক পাখির নামকরনঃ করেছেন । বাংলাদেশের দু’জন অধ্যাপক শাহজাহান সর্দার স্যার ও অধ্যাপক রেজা আলী খান স্যার সালিম আলীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। রেজা খান ও শাহজাহান সর্দার স্যার আমাদের দেশীয় প্রায় ৮০ ভাগ পাখির নামকরনঃ করেছেন। তারমধ্যে শাহজাহান সর্দার স্যার ১৫০টি পাখির নামকরনঃ করেন। আমি বর্তমানে শাহজাহান সর্দার স্যারে সঙ্গে “বার্ড কনজারভেশন অব বাংলাদে “ নামক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শাহজাহান সর্দার স্যার ও মহাসচিব পদে চলতি দায়িত্বে আমি। যার নিজের হাতে গড়া ভরতপুরের এই কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক তাঁর সম্পর্কে কিছুটা ধারনা তুলে না ধরলে অকৃতজ্ঞ থাকতে হয়। তাছাড়া মরহুম সালিম আলী স্যার আমার অদেখা গুরু। পাঠক বন্ধুদের কাছে সালিম আলী স্যারের পরিচিতি তুলে ধরা নৈতিক কর্তব্য মনে করি।
সালিম আলী স্যার।
এক নজরে সালিম আলী স্যারের পরিচিতিঃ
==============================
সালিম মঈজুদ্দীন আব্দুল আলীর জন্ম: ১২, নভেম্বর ১৮৯৬ – মৃত্যু: ২৭, জুলাই ১৯৮৭। একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী। তিনিই প্রথম কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন যাঁরা ভারতের পাখিদের সম্বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জরিপ পরিচালনা করেন। তার পাখিবিষয়ক বইগুলি পক্ষীবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭-এর পর তিনি বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে গুরুত্বপূর্ণ আসনে জায়গা করে নেন এবং সংগঠনটির উন্নয়নে সরকারি সাহায্যের সংস্থান করে দেন। তিনি ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য (কেওলাদেও জাতীয় উদ্যান) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারই উদ্যোগে বর্তমান সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যান নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।
ভারত সরকার তাকে ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি ১৯৫৮ সালে রাজ্যসভায় সদস্যরূপে মনোনীত হন। পাখি বিষয়ে তার অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি “ভারতের পক্ষীমানব” হিসেবে পরিচিত।
মিউজিয়ামের সম্মুখ অংশ।
সালিম আলী ১৮৯৬ সালে ভারতের মুম্বইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) সুলাইমানী বোহরা গোত্রের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তার বয়স যখন এক বছর তখন তার পিতা মইজুদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন এবং তিন বছর বয়সে তার মাতা জিনাত-উন-নিসা মৃত্যুবরণ করেন। তার নিঃসন্তান মামা-মামী আমিরুদ্দীন তায়েবজী ও হামিদা বেগম তার লালন-পালনের ভার নেন। তার আরেক মামা আব্বাস তায়েবজী একজন প্রখ্যাত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ছোটবেলায় সালিম তার খেলনা এয়ারগান দিয়ে একটি অদ্ভুতদর্শন চড়ুই শিকার করেন আর সেই চড়ুইয়ের সূত্র ধরে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির তৎকালীন সচিব ওয়াল্টার স্যামুয়েল মিলার্ডের সাথে তার পরিচয় হয়। মিলার্ড চড়ুইটিকে হলদেগলা চড়ুই হিসেবে সনাক্ত করেন। তিনি সালিমকে সোসাইটিতে সংগৃহীত স্টাফ করা পাখির সংগ্রহ ঘুরিয়ে দেখান। তিনি সালিমকে পাখি সম্পর্কিত কিছু বই ধার দেন, তার মধ্যে ইহার কমন বার্ডস অব বোম্বে অন্যতম। সালিমকে পাখির একটি সংগ্রহ সৃষ্টির জন্য তিনি উৎসাহ দেন আর কিভাবে পাখির চামড়া ছাড়াতে হয় ও সংরক্ষণ করতে হয় সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। মিলার্ড ছোট্ট সালিমের সাথে নরম্যান বয়েড কিনিয়ারের পরিচয় করিয়ে দেন। কিনিয়ার ছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সর্বপ্রথম বেতনভোগী কিউরেটর। নিজের আত্মজীবনী দ্য ফল অফ আ স্প্যারোতে সালিম হলদেগলা চড়ুইয়ের ঘটনাটাকে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। সেই ঘটনাটাই তার পক্ষীবিদ হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। তখনকার দিনে ভারতের হিসেবে পেশাটি একটু অন্যরকমই বলতে হবে। অথচ জীবনের প্রথম দিকে তিনি শিকার সম্পর্কিত বইপত্র পড়তেন আর তার ঝোঁক ছিল শিকারের দিকেই। তার পালক পিতা আমিরুদ্দীনের শিকারের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তার আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই শিকার প্রতিযোগিতা হত। তার শিকারের অন্যতম সহচর ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা, যিনি নিজে খুব ভাল শিকারী ছিলেন।
মিউজিয়ামে পাখির মমি।
সালিম আলি তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন জেনানা বাইবেল মেডিকেল মিশন গার্লস হাই স্কুল থেকে। পরবর্তীতে তিনি বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তের বছর বয়স থেকে তিনি প্রায়ই মাথাব্যথায় ভুগতেন। সে কারণে তিনি স্কুলে অনিয়মিত ছিলেন। তার এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি সিন্ধুতে চলে যান। অনিয়মিত শিক্ষাজীবনের জন্য তিনি কোনমতে ১৯১৩ সালে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৩০ সালে সালিম আলী ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে এসে তিনি আবিষ্কার করলেন, তার গাইড লেকচারারের পদটি তহবিলের অভাবে বিলোপ করা হয়েছে। উপযুক্ত চাকরির অভাবে সালিম ও তাহমিনা মুম্বাইয়ের নিকটে কিহিম নামক একটি সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি দেশি বাবুইয়ের জন্ম ও প্রজনন প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান।
সালিমের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী তাহমিনা। ১৯৩৯ সালে এক ছোট অস্ত্রোপচারে তাহমিনা মৃত্যুবরণ করেন। তাহমিনার মৃত্যুর পর তিনি তার বোন কামু আর শ্যালকের সাথে বসবাস করতে শুরু করেন। এসময় বিভিন্ন ভ্রমণে তিনি কুমায়নের তেরাইয়ে নতুন করে ফিনের বাবুই আবিষ্কার করেন। তবে হিমালয়ী বটেরা (Ophrysia superciliosa) খুঁজে বের করতে তিনি ব্যর্থ হন, যার অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত অজানা।
পাখির চিত্রগ্রহণের ব্যাপারে সালিম আলী তার ধনকুবের সিঙ্গাপুরী বন্ধু লোকি ওয়ান থো’র মাধ্যমে উৎসাহিত হন। লোকির সাথে আলীকে পরিচয় পরিয়ে দেন জেটিএম গিবসন। গিবসন ছিলেন রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এবং বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির একজন সভ্য।
ভারতে পক্ষীবিদ্যার ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়েও সালিম আলীর বিরাট আগ্রহ ছিল। তার প্রথম দিকের কয়েকটি নিবন্ধতে ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসে মুঘল সম্রাটদের অবদান বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে একাধিক বক্তৃতায় তিনি বেশ জোরের সাথে ভারতে পাখি বিষয়ক গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
( “দ্য ফল অফ স্প্যারো” বই থেকে কপি করা)
সালিম আলীর আত্মজীবনী
আমাদের হাতে আরো দুই ঘন্টা সময় থাকায় ঝটিকা সফরে ৩ নাম্বার জোনের পথে ছুঁটলাম।
(চলবে)
২৯টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
সালিম আলীরা বেঁচে থাক
পাকি প্রেমীদের হৃদয় মন্দিরে।
আপনাকে ধন্যবাদ ওনার সম্বন্ধে তুলে ধরার জন্য।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
কৃতজ্ঞ।
ছাইরাছ হেলাল
সালিম আলী ও অধ্যাপক রেজা আলী খান কে সামান্য জানার সুযোগ হয়েছে।
আপনি অনেক সুন্দর করে বলাতে আরও ভাল লাগল।
সালিম আলী এ দেশে এসেছিলেন একবার?
শামীম চৌধুরী
জ্বী ভাইজান।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ১৯৭৮ সালে।
ছাইরাছ হেলাল
আরো পরে, উনি কী একবার ঢাকা ক্লাবের আমন্ত্রণে এসেছিলেন!!
স্মৃতি থেকে বলছি, ঠিক-ঠাক মনে নেই।
ইঞ্জা
সালিম আলির না। এই প্রথম জানলাম, উনি গুরুদের গুরু জেনে ভালো লাগলো ভাই, মিউজিয়ামে রাখা স্টাফড পাখি গুলো যেন জীবন্ত, দেখেই অবাক হয়েছি ভাই।
শামীম চৌধুরী
স্বশরীরে দেখলে আরো ভাল লাগতো ভাইজান।
ইঞ্জা
সত্যি তাই, আমি তো মুগ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াতাম।
আরজু মুক্তা
মমি পাখি দেখে আশ্চর্য হলাম। আর সলিম আলীকে সালাম। এরকম লোক আছে বলেই প্রকৃতিকে বেশি জানা হয়।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ মুক্তা আপু। শুভ কামনা রইলো।
ফয়জুল মহী
মনোমুগ্ধকর লেখা I মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ।
আলমগীর সরকার লিটন
নতুন এক ইতিহাস জানলাম সালিম আলি আমাদের পাখিদের নামকরণ করেছেন তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
জ্বি আপনাকেউ
মোঃ মজিবর রহমান
মিউজিয়ামে মমপাখি নয়ভিরাম।
সালিম আলি সমপর্কে জানলাম।
সুন্দর লিখনি শিখার আছে অনেক।
ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ সুহৃদ। শুভ কামনা রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল থাকুন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সালিম আলি সম্পর্কে জানা ছিলো না আজ তাই খুব ভালো লাগলো আপনার মাধ্যমে তার মতো গুণীজন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরে। অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আরো নতুন নতুন তথ্য পাবো আগামীতে এই কামনা রইলো
শামীম চৌধুরী
আপনিও ভাল থাকুন দিদিভাই। শুভেচ্ছা জানবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল থাকুন।
শামীম চৌধুরী
শুভকামনা।
তৌহিদ
স্যার সলিম আলী সম্পর্কে আজ জেনে সত্যিই ভালো লাগছে। এই পোষ্ট পড়ার আগে আমি তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতামনা ভাই।
পাখিগুলি সত্যি মমি? আমি ভেবেছিলাম মাটির রেপ্লিকা!! অসাধারণ পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভকামনা সবসময়।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ সুহৃদ। শুভ কামনা রইলো।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অজানা তথ্য জানলাম আজ।
কৃতজ্ঞতা জানাই দাদা এমন ভালো কিছু শেয়ার করার জন্য।
পাখিগুলো খুবি সুন্দর।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ দাদাভাই। আপনার জন্য রইলো প্রানঢালা শুভেচ্ছা।
খাদিজাতুল কুবরা
মমি পাখিগুলোর ছবি জীবন্ত লাগলো। স্যার সলীম আলীর মতো কিংবদন্তি সম্পর্কে প্রথম জানতে পেরে ভালো লেগেছে। আপনাকে ও স্যালুট পাখি নিয়ে এতো বিশদভাবে লেখার জন্য।
শামীম চৌধুরী
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রানিত হলাম। ভাল থাকবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আহ্ পাখির মমি। আমি জানতাম না।সালিম আলীর জীবনী পড়ে ভালো লাগলো। পৃথিবীটা এই অসাধারণ মানুষগুলোর জন্যই সুন্দর করে গড়ে ওঠে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের মত কমজ্ঞানীদের জ্ঞান-ভান্ডার সমৃদ্ধ করবার জন্য।
শুভ কামনা ভাই। ভালো থাকবেন।