মধ্য রাতের ট্রেন

কামাল উদ্দিন ১৮ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ০৩:৪৭:২৪অপরাহ্ন অন্যান্য ৩১ মন্তব্য

চট্টগ্রাম মেইলটা নরসিংদী স্টেশনে আসে রাত সাড়ে এগারটা থেকে বারটার মধ্যেই। ভোর রাতের মধ্যে কসবা পৌছার জন্য এই ট্রেনটা একেবারে পারফেক্ট। নরসিংদী স্টেশনে রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই পৌছে গেছি। রেল স্টেশন আমার খুবই প্রিয় জায়গা। এই স্টেশন গুলোতে যেন দুনিয়ার সব রকম লোকের দেখা পাওয়া যায়। স্টেশনের হকারদের মন ভোলানো হাঁকডাক। এদের মধ্যে কেউ ঝালমুড়ি, কেউ লেবু পানি আর আচার বিক্রেতা। এছাড়া প্রতারক আংটি ব্যবসায়ী ছাড়াও রয়েছে নানা রকম ধান্ধাবাজ, হেন কোন লোক নাই যে এখানে মিলবে না। স্টেশনে গেলে এসব আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি।

ব্রিটিশদের নির্মিত সিমেন্টের ভাঙ্গা বেঞ্চিগুলো ইতি মধ্যেই ভবঘুরেদের দখলে চলে গেছে। এক ঝাক মশার প্রহরায় কেউবা নাক ঢেকে ঘুমোচ্ছে, অন্য কোথাও আবার কয়েকজন বসে আড্ডা মারছে, এমনকি তাদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না বলে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে হচ্ছে। ওয়েটিং রুমের যা তা অবস্থার কথাটা নাইবা বললাম। স্টেশন মাষ্টার প্রথম বলেছিল রাত ১২টার মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে। ঘুরে ঘুরে বাদাম চানাচুর খাচ্ছিলাম আর মাঝে মাঝে মোবাইল স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে টাইম দেখে নিচ্ছিলাম। পৌনে বারটার দিকে স্টেশন মাষ্টার জানিয়ে দিলো আজ ট্রেন লেট হবে, মানে হলো ১২টায়ও আসছে না। চোখের পাতা এবং পা দুটোই বেশ ভারি হয়ে আসছিল। কোথাও বসে একটু চা খেতে পারলে চোখ আর পায়ের বিশ্রাম হতো। কিন্তু স্টেশনের ভাসমান চা বিক্রেতাদের কাছে লাল চা খেতে পারলেও বসার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

যেহেতু ট্রেন আসতে লেট হবে ভাবলাম একটু হেটে স্টেশনের বাহির থেকে গাভির দুধের চা খেয়ে আসি। প্লাটফরম থেকে নেমে রেল লাইন ধরে সোজা একটু হাটতেই পেয়ে গেলাম একটা চা দোকান। এখান থেকে স্টেশন যেহেতু দেখাই যায় সুতরাং চা খাওয়ার উছিলায় একটু আয়েস করে সময় কাটানো যাবে ভালোই। কয়েকজন লেবার শ্রেণীর লোক বসে চা খাচ্ছে বা নিজেদের সাংসারিক আলাপ করছে। একটা বেঞ্চিতে অল্প একটু যায়গা খালিই ছিলো যাতে আমি লোক গুলোর গা ঘেষে গাদাগাদি করে বসতে পারলাম। গরুর দুধের চায়ের অর্ডার দিলাম। দোকানি বেশ বয়স্ক মানুষ, আর পোষাকেও দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। অনেক সময় নিয়ে আমাকে চা বানিয়ে দিলেন, আমার ও তো কোন তাড়া নাই। চা খেতে খেতে দোকানীর সাথে কিছুটা আলাপ জমানোর পরই উনি বললো অমাবশ্যার রাতে ট্রেন ভ্রমণ ভালো নয় বাবা।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এই দোকানটা ছাড়া আর কিছুই নাই। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে প্লাটফরম থেকে যখন মাটির রাস্তায় নামি চাঁদের আলোয় রাস্তা চকচক করছিলো। মোবাইলের কোন আলো না জ্বালিয়েই আমি এখানে এসেছি। ভাবলাম হয়তো মেঘে চাঁদ ঢেকে গেছে। কিন্তু ধাক্কাটা খেলাম যখন স্টেশনটাকে দেখতে পেলাম না। অথচ এখানে বসে চা খেতে খেতে আমি অনেক বার স্টেশনের আলোগুলো দেখেছি। বিল মিটিয়ে তাড়াতাড়ি স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম। একটু আগানোর পরই স্টেশনের লাইটগুলো আবার দেখতে পেলাম। কিন্তু স্টেশনে পৌছে মনে কেমন যেন খটকা লাগলো। লোকজন এতো কম কেন? স্টেশন মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করলাম চট্টগ্রাম মেইল কখন আসবে? ওটা তো চলে গেছে ঘন্টাখানেক আগেই। এটা কি করে সম্ভব! আমি তো ট্রেন লাইনের পাশেই বসে চা খাচ্ছিলাম! কসবা যাওয়া আজ আর হবে না বুঝে গেলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।

পরের দিন ভোরেই খবরের হেড লাইনে দেখলাম চট্টগ্রাম মেইলের সঙ্গে মহানগর গোধূলি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই ট্রেনের চালক সহ ১২ জন নিহত। সকালেই আমি ছুটে গেলাম দূর্ঘটনা স্থল দেখতে। একেবারে ভয়াবহ অবস্থা। একটা ট্রেন অন্যটার ভেতরে ঢুকে গেছে। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে ফেরার পথে ভাবলাম চাচার দোকান থেকে একটা দুধ চা খেয়েই যাই। কিন্তু ওখানে গিয়েই খেলাম বড় ধাক্কাটা। ওখানে তো কিছুই নাই একেবারে ফাঁকা যায়গা। ভাবলাম ভুল করছি, তাই স্টেশনে গিয়ে আবার ফিরে এলাম, নাহ আমার কোন ভুল নাই। মহা ফাপড়ে পড়ে গেলাম এবং রাতের সবগুলো ঘটনা আবার রিভার্স দিলাম। স্টেশন মাষ্টারের ভুল বলা, পাশ দিয়ে ট্রেন যাওয়ার পরও না দেখা, এক সময় এই দোকান ছাড়া আর কিছুই না দেখা! সব কিছু যেন স্বপ্নের অংশ মনে হচ্ছে। কাছাকাছি আরশি নগরের এক মধ্য বয়স্ক দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই ওখানে তো একটা চা দোকান ছিল, সেটা কোথায়? কেউ কি ওটা দেখেছে? লোকটা আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো। মানে কি? লোকটা বললো মানে হলো নিশ্চয়ই গত রাতে কেউ ঐ দোকানটা দেখেছে। আর তারই ফলাফল হলো এই ট্রেন দূর্ঘটনা। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।

তখন মানুষ ঢাকা যাতায়াত করতো পায়ে হেটে। বৃটিশরা এসে এই ট্রেন লাইন সৃষ্টি করে। ট্রেন লাইন হওয়াতে এলাকার মানুষের সুবিধা হয়, এবং খুব অল্প সময়েই স্টেশনটা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তখন এই এলাকায় একটা মাত্র দোকান ছিল যেখানে কিছু খাবার দাবার আর চা বিক্রি হতো। এক দিন সন্ধ্যার ট্রেন আসতে খুব লেট করছিলো। শোনা যায় যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে আসতেই ওর দেরি হচ্ছিল। যখন ট্রেনটা আসে তখন প্রায় মধ্য রাত। বিপরিত দিক থেকেও তখন অন্য ট্রেনটি চলে এসেছিল, তখন সিগন্যাল গুলো হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। কোন কারণে সিগন্যাল ম্যান অনুপস্থিত ছিলো বা বিপরিত দিক থেকে লেট করে আসা ট্রেনটির কথা ভুলে গিয়েছিল। ফলাফল মুখোমুখি সংঘর্ষ। সেই সংঘর্ষের সময় পাশেই থাকা দোকানে কয়েকজন রেল শ্রমিক চা খাচ্ছিল বা আড্ডা মারছিল। একটা ইঞ্জিন ছিটকে এসে ঐ দোকানে চলে আসে, আর ওখানে থাকা শ্রমিক এবং দোকানি ইঞ্জিনের গরম কয়লায় পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই লোকজন মধ্য রাতে ঐ দোকানটা দেখে। আর যেদিন দেখে সেদিন কোথাও ও না কোথাও ট্রেন দূর্ঘটনা নিশ্চিৎ। এটা অনেক পুরোনো কিন্তু সত্য কথা, দোকানি আমাকে বলল।

শির দাড়া বেয়ে একটা শিতল স্রোত নেমে গেল আমার। বলে কি লোকটা! তাহলে গত রাতে আমরা সেই শত বর্ষ পুরোনো দোকানে বসে চা খেয়েছিলাম! লোকগুলো শতবর্ষি পুরোনো, আর দুধ চা টাও নিশ্চয়ই সেই সময়কারই! কতো যায়গায়ই তো আমরা সেলফি তুলি, ওখানে একটা সেলফি তুললাম না কেন??

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ