অচেনা সন্ন্যাস

হালিম নজরুল ২৬ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ০১:০৩:০২পূর্বাহ্ন গল্প ৩৫ মন্তব্য

চারদিকে রঙবেরঙের ফুল আর কাগজের সমারোহ।আবালবৃদ্ধবনিতার চোখেমুখে আনন্দের বান।এমনই রঙিন সময়ে ক্রমশ শব্দের প্রখরতা বাড়িয়ে স্টেশনে এসে থামলো সকলের কাঙ্খিত সেই আন্তনগর ট্রেন "মিতালী এক্সপ্রেস"।এই স্টেশনে নতুন এই ট্রেনটির আজই প্রথম উদ্বোধন।প্লাটফর্মে থামতেই মুহুর্মুহু উচ্ছ্বাস জনতার।চারদিকে হাসির ঝিলিক।শুধু হাসি নেই সন্ন্যাসের মুখে।এমন আনন্দের মুহূর্তেও যেন তার চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ,চাপা কান্নার বিষণ্নতা।ভিজে যাওয়া চোখের জলে চিকচিক করছে স্বজন হারানো বেদনার প্রতিচ্ছবি।সে জানে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একবুক যন্ত্রণা দান করে চলে যাবে অনাবিল আনন্দ বয়ে নিয়ে আসা ট্রেনটিও;চলে যাবে ঠিক মালোতীর মত।
মালোতীর চলে যাবার দৃশ্যটি আজ আবার বুকের ভেতর প্রচণ্ড একটি ঝড় তুলছে,চোখে নিয়ে আসছে অশ্রুর বান।মালোতীর অসহায় মুখমণ্ডলটি বারবার ভেসে উঠছে সন্যাসের মানসপটে।
অমাবশ্যা আসতে তখনো কদিন বাকী।কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে চারদিকে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার।ক্ষয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আলোর বড্ড অভাব,দূরে দণ্ডায়মান ক্ষয়িষ্ণু ল্যাম্পপোষ্টেটার মত।যেটুকু আলো আছে তাও মেনে নিতে চায় না ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অর্বাচীন মানুষেরা।এমন অন্ধকার রাতেও চায়ের চুলো জ্বালিয়ে শেষ ট্রেনটার জন্য অপেক্ষায় আছে সন্ন্যাস।ট্রেনটা এলে দু' দশ টাকা বিক্রি হলে সেটাই বা কম কিসে।
হুইসেল বেজেছে বেশ কিছুক্ষণ।কিন্তু ট্রেনটি আসছেনা কেন!এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়।এটা ওটা ভাবতে ভাবতে কেটলীটা সরিয়ে চুলোর আগুনটা একটু নাড়াচাড়া দিল সন্ন্যাস।দূরে ঘেউঘেউ শব্দ।কয়েকটা কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে হেঁটে গেল পরিত্যক্ত গোডাউনটার দিকে।সন্ন্যাসের মনটা কেমন যেন খচ করে উঠলো।বছর তিনেক আগে এমনই এক রাতে পরিত্যক্ত ঐ গোডাউনটাতেই লাশ পড়েছিল অতি আদরের ছোটবোন মল্লিকার।ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিল কতগুলো নরপশুর নৃশংসতার ছবি।কিছু ভয়, কিছু সংশয়,কিছু ক্ষোভ,কিছু অভিমান নিয়ে সামনে পা বাড়ায় সন্ন্যাস।
ট্রেনটির ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়ায় স্টেশন অবধি পৌঁছতে পারেনি।অন্য ইঞ্জিন আসতে হয়তো সকাল হয়ে যাবে।অন্ধকার রাত।ক্ষুধার যন্ত্রণা আর চোর-ডাকাতের ভয়ে আর সবার মত মালোতীও নেমে পড়ে ট্রেন থেকে।হাঁটতে থাকে স্টেশনের দিকে।বেশী দূর নয়।আরেকটু হাঁটলেই স্টেশন।পুরণো বটগাছটা পেরোতেই সামনে এসে দাঁড়ায় তিনটে জানোয়ার।জাতে মানুষ,স্বভাবে কুকুর।একটা অমানুষ হাত চেপে ধরে মালোতীর।মালোতী চিৎকার করার চেষ্টা করতেই ওর মুখ চেপে ধরে অন্যজন।মালোতীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পরিত্যক্ত গোডাউনটার দিকে।হটাৎ একটা আলো এসে পড়ে ওদের ওপর।টর্চ হাতে ট্রেনটার দিকে এগচ্ছিল সন্ন্যাস।এই দৃশ্য দেখেই চিৎকার করে এগিয়ে যায় মালোতীর দিকে।চিৎকারে লোকজন ছুটে আসে।মালোতী বেঁচে যায় এক চরম কলংকিত অধ্যায় থেকে।দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলেও সন্ন্যাসকে হত্যার হুমকি দিয়ে যায়।এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বখে যাওয়া ছেলেগুলো হুমকি দিয়ে গেলেও অগত্যা পরবর্তী ইঞ্জিন না আসা পর্যন্ত সন্ন্যাসের চা দোকানকেই মনে করা হল নিরাপদ আশ্রয়।
অন্ধকারে কুপীর আলোয়ও বোঝা যাচ্ছে অসম্ভব সুন্দরী তরুনী মালোতী।শহরের শিক্ষিত প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে হলেও আজ তার চোখেমুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব।জীবনের এই স্টেশনে আজকের নায়কের নাম সন্ন্যাস,এক চা দোকানদার।সামান্য আগের অপরিচিত কোন এক সন্ন্যাস হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনজন।জীবনটা এমনই।জীবনের এই কথোপকথনেই রাত কেটে ভোর আসে।চলে আসে আরেকটা ইঞ্জিন।মন না চাইলেও ট্রেনে উঠতে হয় মালোতীকে।পড়ে থাকা অচল ট্রেনটিকে হুইসেল বাজিয়ে স্টেশন ছেড়ে দ্রুত টেনে নিয়ে যায় অন্য শহরের দিকে।ট্রেনের সাথে সাথে এগিয়ে চলে চোখের জল,মালোতী নামের অবশ লাশ।আর ল্যাম্পপোষ্টের মত স্টেশনে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে এক বটবৃক্ষ,এক অচেনা সন্ন্যাস।

0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ