আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে নুতন করে বলার কিছু নেই। যারা সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা সবাই তাঁকে জানি আমরা। প্রায় অজানা বা কম জানা একটি কবিতা সবার সাথে শেয়ার করছি। এই কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সনে। আমাদের দেশের একজন মহান নেতাকে নিয়ে। নেতা তখন কারারুদ্ধ। নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের ‘টেলেমেকাস’ কবিতা। নেতা তখনো পিতা হয়ে ওঠেননি জাতির। কিন্তু শামসুর রাহমানের কবিতায় এসেছেন পিতা হয়ে। একটু বড় হলেও কবিতাটি পড়ুন।

টেলেমেকাস
তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়
কখনো তোমার মুখ হবে না নাকি উদ্ভাসিত, পিতা,
পুনর্বার? কেন আজো শুনি নি তোমার পদধ্বনি?
এদিকে প্রাকারে জমে শ্যাওলার মেঘ, আগাছার
দৌরাত্ম্য বাগানে বাড়ে প্রতিদিন। সওয়ারবিহীন
ঘোড়াগুলো আস্তাবলে ভীষণ ঝিমোয়, কুকুরটা
অলিন্দে বেড়ায় শুঁকে কতো কী-যে, বলে না কিছুই।

নয়কো নগণ্য দ্বীপ সুজলা সুফলা শস্যশ্যাম
ইথাকার আমার ধনধান্যে পুষ্পেভরা। পিতা, তুমি
যেদিন স্বদেশ ছেড়ে হলে পরবাসী, ভ্রাম্যমাণ,
সেদিন থেকেই জানি ইথাকা নিষ্পত্র, যেন এক
বিবর্ণ গোলাপ। আমি একা কৈশোরের জ্বলজ্বলে
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কোন্‌ কাক-তাড়ুয়ার মূর্তি দেখে
ভুলে গেছি হাসি। ‘কেন আপনার ঠোঁটের দিগন্তে
হাসির হরিণ-শিশু পালিয়ে বেড়ায় অবিরত?’-
কখনো করেন প্রশ্ন ধীমান প্রবীণ সভাসদ।

বিদেশীরা রাত্রিদিন করে গোল ইথাকায়; কেউ
সযত্নে পরখ করে বর্শার ফলার ধার, শূন্য
মদের রঙিন পাত্র ছুঁড়ে ফেলে কেউ, লাথি ছোঁড়ে,
কেউ বা উত্যক্ত করে পরিচারিকাকে। মাঝে-মাঝে
কেবলি বাড়ায় হাত প্রোষিতভর্তৃকা জননীর
দিকে, যিনি কী-একটা বুনছেন সুচারু কাপড়ে
দিনে, রাতে খুলছেন সীবনীর শিল্পে। কোলে তাঁর
সুতোর বলের সাথে খেলা করে মোহন অতীত।
লুকিয়ে কাঁদেন তিনি ছড়িয়ে জলজ দৃষ্টি ধু-ধু
সমুদ্রের প্রতি, কালো বেড়ালের মতো নিঃসঙ্গতা
তাঁর শয্যা, অস্থিমজ্জা জুড়ে রয় আজো সর্বক্ষণ।

সবুজ শ্যাওলা-ঢাকা পুকুরেও ছুঁড়ে দিলে ঢিল,
সেখানে চকিতে ওঠে ঢেউ আর বাতাসের ডাকে
এমন কি পত্রহীন গাছও দেয় সাড়া, কিন্তু এই
আমার মুখের রেখা সর্বদাই নির্বিকার, তাই
পালিয়ে বেড়াই ভয়ে, পাছে কেউ জনসমাবেশে
পৌরপথে নানাবিধ প্রশ্নের পেরেক ঠুকে ঠুকে
আমাকে রক্তাক্ত করে। জানি, এ বয়সে প্রাণ খুলে
হাসাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ঘরে শক্র নিয়ে মুখে
হাসির গোলাপ-কুঁড়ি ফোটানো কঠিন। নানা জন
রটায় নানান কথা শুনি, তুমি নাকি মৃত, তুমি
সার্সির সবুজ চুলে বাঁধা পড়ে আছো, বলে কেউ।

কূলে একা বসে থাকি, কোথায় ভরসা? ঘুরে ঘুরে
প্রতিদিন ফিরে আসি অলক্ষ্যে বাড়ির সীমানায়;
দাঁড়াই যেখানে সিঁড়ি শব্দ করে জানায় চকিতে
এখন বয়স কতো বাড়িটার আর আমি নিজে
আনাচে কানাচে ঘুরি, নিরালম্ব, বিদেশীর মতো।
মনে হয়, ক্রমাগত সশব্দে আমাকে দিচ্ছে কারা
কবরে নামিয়ে শুধু; পাগুলো মাটিতে লেগে লেগে
কেমন নির্বোধ হয়ে রয়েছে তাকিয়ে, যেন ওরা
পৃথিবীতে বাস্তবিক হাঁটতে শেখেনি কোনোদিন।

তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল
বাসগৃহ আমাদের। কেউ পদাঘাত করে, কেউ
নিমেষে হটিয়ে দেয় কনুই-এর গুতোয় আবার
‘দুধ খাও গে হে খুকুমণি’ বলে কেউ তালেবর
দাড়িতে বুলোয় হাত। পিপে পিপে মদ শেষ, কতো
ঝলসানো মেষ আর শুয়োর কাবার, প্রতিদিন
ভাঁড়ারে পড়ছে টান। থমথমে আকামের মতো
সমস্ত ইথাকা, গরগরে জনগণ প্রতিষ্ঠিত
অনাচার, অজাচার ইত্যাদির চায় প্রতিকার।

আমিও বাঁচতে চাই, চাই পড়ো-পড়ো বাড়িটাকে
আবার করাতে দাঁড়। বাগানের আগাছা নিড়ানো
তবে কি আমারই কাজ? বুঝি তাই ঋতুতে ঋতুতে
সাহস সঞ্চয় করি এবং জীবন তুরঙ্গের
বর্ণিল লাগাম ধরে থাকি দৃঢ় দশটি আঙুলে।
কখনো এড়িয়ে দৃষ্টি ছুটে যাই অস্ত্রাগারে, ভাবি
লম্পট জোচ্চোর আর ঘাতকের বীভৎস তাণ্ডব
কবে হবে শেষ? সূর্যগ্রহণের প্রহর কাটবে
কবে? জননীর মতো চোখ রাখি সমুদ্রে সর্বদা।

ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার? 

পাদটিকাঃ  টেলেমেকাস গ্রীক পুরানের একজন অসহায়  সন্তান যিনি পিতৃহীন ছিলেন। ইথাকা নগরী অবরুদ্ধ ছিলো দখলদার বাহিনী দ্বারা, একজন বীরের অভাব বোধ করছিলেন ইথাকা নগরীর সবাই। টেলেমেকাস তাদেরই একজন, পিতাহীন অসহায় ছিলেন তিনি, তবে দখলদারদের প্রতি ঘৃনা ও ক্ষোভ ছিলো।

কবির বিখ্যাত কবিতা স্বাধীনতা তুমির আবৃত্তি শুনুন এখানে ক্লিক করে

স্বাধীনতা তুমি কবিতার গান
শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন

আজ ২৩ অক্টোবর কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।

 

বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাস। তাঁর সম্পর্কেও জানি আমরা সবাই। যা জানিনা তা হচ্ছে, জীবিত অবস্থায় কবির তেমন নাম ডাক ছিলো না। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র কবি তিনি যিনি মৃত্যুর পরে জনপ্রিয় হয়েছেন।
পারিবারিক জীবনে অসুখী ছিলেন তিনি। ধারনা করা হয়, আনমনে ট্রামের নীচে চাঁপা পরেছিলেন তিনি। আর এতেই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী তখন সিনেমা জগত নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।
জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন বা আবার আসিব ফিরে কবিতা কাব্য প্রেমীদের মুখে মুখে।

আমাদের এই ব্লগের নাম সোনেলা শব্দটিও এই কবির কোন এক কবিতা থেকে নেয়া।
আবৃত্তি এবং গানে কবির বিখ্যাত কবিতা:

আবার আসিবো ফিরে কবিতাটির  আবৃত্তি শুনুন প্রিয় আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টপাধ্যয়ের কন্ঠে

আবার আসিব ফিরে কবিতাটির গান শুনুন লোপা মুদ্রার কন্ঠে

গতকাল ২২ অক্টোবর ছিলো এই কবির মৃত্যু দিবস। কবির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।

গতকাল এবং আজ আমাদের মিডিয়া এই দুজন কবি সম্পর্কে নিরব। এমনটা এই প্রথম দেখলাম।

0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ