-বাবা, বাবা। বাবা তুমি কোথায়?
-তোর বাবা একটু কাজে বেরিয়েছে মা। বিকেলেই চলে আসবে।
প্রচণ্ড অভিমানে আবারও লেপের নিচে মুখ লুকিয়ে ফেলে শায়লা। কি করে তাঁর বাবা আজকের দিনটিকে ভুলে যেতে পারলো! “ওহ্‌, একটু বড় হয়েছি বলে বাবার আর আমার কথা মনেই থাকে না” আর মা ! সেও তো এখনো কিছু বলল না! এই ভেবে বাচ্চাদের মতো মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।
ঘড়ির কাটা ১০ টা ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু শায়লার দেখাই নেই। নাহ্‌… ও তো এতোক্ষন শুয়ে থাকার মেয়ে নয়। এইভেবে শায়লার মা ছুটে গেল শায়লার ঘরে। ওমা! মেয়ে যে এখনো লেপের নিচেই মুখ লুকিয়ে আছে। বড্ড অভিমানী মেয়েটা। সব বুঝতে পেরেও শায়লার মা কিছু না বোঝার ভান করে ডাকতে লাগলো ওকে-
-শায়লা, শায়লা…
-কি হয়েছে? যাও আমি ঘুমুচ্ছি।
গলায় কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে শায়লার উত্তর। শায়লার মা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হো হো করে হেসে মেয়ের মুখের উপর থেকে লেপটা সরিয়ে দিলেন। লেপ সরিয়ে যা দেখলেন তাতে তো তিনি অবাক! এতো বড় মেয়ে এই সামান্য কারণে কেঁদে কেটে একসার ! মা শায়লাকে বুকে জড়িয়ে বললেন-
-ধুর পাগলী! আমরা কি ভুলে যেতে পারি আজকের দিনের কথা! আমার শায়লা মায়ের জন্মদিনের কথা!
চোখ মুছতে মুছতে শায়লা বলতে থাকে-
-তাহলে বাবা আমাকে কিছু না বলেই সকালে চলে গেল যে! একবার আমায় ডাকও দিলো না। আমি লেপের নিচে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম।
-তোর বাবা আমায় বলল এই যাবে আর এই আসবে, এরপরে তোর সঙ্গে একত্রে নাস্তা করবে। এইতো এখনি চলে আসবে দেখিস। তুই উঠে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে পর মা। অনেক বেলা হয়েছে।
-না, বাবা না ফিরলে আমি কিছুই খাবো না। আমি বাবার সাথে খাবো।
-পাগলামি করিস না মা। তোর পছন্দের পায়েস করেছি।
-না, আমি বাবা ফিরলে বাবার হাত থেকে খাবো।
যেই কথা সেই কাজ। কিছুতেই খাবে না সে।ওদিকে সকালের কোমল সূর্যের আভাটা ধীরে প্রখর রোদের উত্তাপে পরিণত হতে লাগলো। কিন্তু শায়লার বাবা ফিরছে না। তাই শায়লা সেই সাথে শায়লার মা কিছুই মুখে দেয় নি।
বাইরে কিসের একটা গোলমালের শব্দ পেলো শায়লা। জড়িয়ে ধরলো মাকে। দেশের অবস্থাও ভালো না। মিলিটারিরা যাকে যেখানে পাচ্ছে গুলি করছে, সাথে মিরপুরের এই এলাকাতে বিহারীদের অত্যাচারও বেশী। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে লাগলো। শায়লার বাবা ফিরলো না।
-শায়লার মা, শুনছোনি শায়লার মা…
পাশের বাড়ির ফরিদ মিয়ার স্ত্রী কেমন একটা অদ্ভুত কণ্ঠে ডাকলো শায়লার মাকে। কেমন যেন ভয় মিশে আছে তাঁর কণ্ঠজুড়ে! ভেতর থেকে ছুটে আসলো শায়লার মা।
-কি হয়েছে! কি হয়েছে আপা!
-বইনরে সর্বনাশ হইয়া গেছে। মিলিটারিরা নাকি রাস্তা থেকে অনেক জোয়ান ব্যাটাছেলেরে ধইরা নিয়া গেছে। সকলের চোখে কালা কাপড় আর হাত দড়ি দিয়া বানছে। তোমার ভাইয়ে তো এখনো আসে নাই। শায়লার বাপে কি বাসায়?
চারিদিক অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো শায়লার মায়ের। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল তাঁর চোখের সামনে একটা রক্তমাখা দেহ! গলগলয়ে রক্ত পরছে দেহটির মাথা থেকে। ওমা! এটা তো ফরিদ মিয়ার স্ত্রীর লাশ। এই মাত্র কথা বলছিলেন তিনি! তাঁর মাথায় বুলেটের চিহ্ন। কেউ একজন রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করলো শায়লার মাকে। মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করলো সে, অন্ধকার চারিদিকে, চিৎকার, হায়নার চিৎকার…
-চল শালী… বহত বাড় বাড় গিয়া, চল হামারি সাথ!
-হায়নাবেশী একজন লোক শক্ত করে চেপে ধরেছে শায়লার মায়ের বাহু।
চিৎকারের আওয়াজ শুনে ছুটে আসলো শায়লা।ভয়ে তাঁর সমস্ত শরীরে নাড়া দিয়ে যায়।
-ইয়ে শালী তো বহত কচি আছে।উসকো ভি গাড়িমে উঠালো।
কুকুরের মতো লালা ঝরাতে ঝরাতে কথাগুলো বলতে থাকে সরাফত নামের এক পাকি মেজর।

লাল কার্পেট! হ্যাঁ ঐরকমই তো লাগছে!কিন্তু লালটা কেমন যেন অন্যরকম। ঠিক রক্তের মতন।এতো চিৎকার কিসের দেয়ালের ওপাশে। বাবার কণ্ঠ মনে হচ্ছে! ইস, লোকটা আমার হাত ছাড়ছে না কেন! ভাবছে শায়লা। ওর মাকেও একই ভাবে ধরে রাখা হয়েছে। সেখানে আরও অনেকেই আছে শায়লাদের পরিচিত।
-চল শালী মেরি সাথ
এইবলে শায়লার মাকে হেঁচকা টানে নিয়ে গেলো একজন লোক।
-না, আমার মাকে মেরো না
-তুমহারা মা! ইয়ে তুমহারা মা! তো দেখ তোমহারা মাকো কিস হালাদ কারদুঙ্গা…
এইবলে কুৎসিত ভাবে হাসতে লাগলো লোকটি।
-না, আমার মায়ের সাথে তোমরা এমন করো না। আমরা কিছুই করি নি। আমার মাকে ছেড়ে দাও…
কেউ শায়লার কথায় কান দেয় না।পৈশাচিক উল্লাস করতে করতে শায়লার মায়ের শরীর থেকে খামচে খুবলে খুলে নেয় সব কাপড়।সহ্য করতে না পেরে ছোট্ট হাতে চোখ লুকায় শায়লা। কিন্তু মায়ের চিৎকারে কি করে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে সে ! একজন নয়, দু জন নয় সাত জন হায়না মিলে তাঁর মায়ের পবিত্র দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এতেও ক্ষান্ত হয় না ওরা। বেয়ানট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে তাঁর সমস্ত শরীর। চিৎকার করতে করতে একসময়ে থেমে যায় শায়লার মায়ের মুখের ধ্বনি। নিস্তব্ধ চারিদিক। শায়লার মা আর নেই!

রক্তবর্ণের সেই লাল কার্পেট! কার্পেট মারিয়ে কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে একটা লোক এগিয়ে আসছে শায়লার দিকে। লোকটার পায়ে কার্পেটের লাল রঙগুলো লেগে যাচ্ছে, অদ্ভুত! লোকটার পকেটের উপরে নেমপ্লেটে ইংরেজিতে লেখা “সরাফত আলী খান”। লোকটা এগিয়ে আসছে শায়লার দিকে…
সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছে শায়লা।অনেক ভারী কিছু একটা চেপে আছে তাঁর উপর। সে কানে শুনতে পাচ্ছে-
-ইয়ে শালী তো বহত কচি আছে!
এই বলে বেয়ানট হাতে নিলো সরাফত। ভোগের উপযোগী করে নিতে বেয়ানটের খোঁচায় খানিকটা কেটে নিলো শায়লার যোনিপথ! নিমিষেই শায়লার পুরো দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। মা বলে তাঁর গগনবিদারী চিৎকার… একে একে আরও ৩ জন পশুর মতো খামচে খুবলে খেলো ১২ বছরের মেয়েটিকে।
এরপরে ফেলে রেখে গেলো মাটিতে। প্রায় ৩ ঘণ্টা সে মরার মতো অজ্ঞান হয়ে পরে থাকে সেখানে। সামান্য জ্ঞান ফিরে আসলে সে এবার স্পষ্ট দেয়ালের ওপাশটা দেখতে পাচ্ছে। সেই লাল কার্পেটটাও দেখতে পাচ্ছে সাথে।খুব পরিচিত একটা গলার আওয়াজ শুনছে সে। কান্নার আওয়াজ। অনেকটা তাঁর বাবার মতো!লাল কার্পেটের উপর এসব কি! কেমন যেন একেবারে টুকটুকে লাল রক্তের মতো তরল কিছু একটা দেখা যাচ্ছে! সেই কান্নার আওয়াজটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না।
এটা কি দেখছে সে! একটা মাথা! এটাতো শায়লার বাবার মাথা!! এরপরেই জ্ঞান হারায় সে।জ্ঞান ফিরে বুঝতে পারে খুব ভারী কিছুর নিচে চাপা পরেছে সে। খুব ভারী। কিন্তু কিসের নিচে পরে আছে সে?

0 Shares

৪৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ