জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...

প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হবার পর শমশেরনগর এ.এ.টি.এম হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। আমাদের শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন মওলানা স্যার। আমার জীবনের প্রথম একজন জঘণ্য শিক্ষক। যার প্রতি একফোঁটা সম্মানও নেই আমার। তবে সেদিন আমি জেনেছি পৃথিবীতে এমন টাইপ শিক্ষকও আছে। প্রথম দিন ক্লাশ। তার কিছুদিন আগে আমার মাথায় মারাত্মক এলার্জিতে সব চুল ফেলে দিতে হয়েছিলো। বাগানে রঙ খেলায় কেউ আমার মাথায় রঙ দিয়েছিলো বুঝিনি। স্নানের সময় দেখা যায় প্রচুর রঙ যাচ্ছে। তারপর তো পুরোই এলার্জি। ডাক্তার বললেন চুল ফেলে দিতে হবে। যাক মাথায় স্কার্ফ প্যাঁচিয়ে স্কুলে গেছি। মাওলানা স্যার রোল কল শেষ করেই উঠে আমার সামনে এলেন। মুখ ভরা পান চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
---"তুমি নি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইছো?"
---জ্বি স্যার।
---আইচ্ছা দেখমুনে পারোনি ক্লাশ এইটোত বৃত্তি আনতে। মাথাত ইতা কিতা?
---স্যার এটা স্কার্ফ।
একটানে স্কার্ফটা খুলে দিলেন। সারা ক্লাশ জুড়ে হাসির রোল। বুকে আমার খুব যন্ত্রণা। চোখের জল পড়েনা কেন? টিফিন পিরিয়ডে টিউবয়েল থেকে জল খেতে গেছি, শ্যামলী নামের মেয়েটি সেদিন আমায় সঙ্গ দিয়েছিলো। সেই স্কুলে যতদিন ছিলাম, ততোদিন আমার পাশে পাশে ছিলো। যেদিন চলে আসি সেদিন খুব কেঁদেছিলো। আরেকদিন বড়ো্মামা আমার জন্য ঢাকা থেকে একটা ক্যাসিও ঘড়ি এনে দিয়েছিলো। স্যার ওটাকে নিয়েও বিদ্রূপ করেছিলেন, খেলনা ঘড়ি পড়ে এসেছি। মামা যখন জানলো ওসব, বাপি সেদিনই স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে এলো আমায়। ওই মাওলানা স্যার অনেক ক্ষতি করেছিলো আমার মনের। সত্যি বলতে কি আমার উচ্চশিক্ষার প্রতি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন উনিই। তবে ওই স্কুলে স্বল্পদিনের ছাত্রজীবনে কয়েকজন শিক্ষকের কথা না বললেই নয়। শৈলেশ স্যার আমাদের অঙ্ক করাতেন। মুখ ভরা পান, প্রচন্ড কড়া হলেও উনার মধ্যে একটা আবেগ ছিলো। স্যার অন্যায়কারীকে কখনো প্রশ্রয় দিতেন না। সিংহ স্যার আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন। স্যারের হাসি ভালো লাগতো। আর উনার পড়ানো আমার কাছে ভালো লাগতো। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ স্যারকে সেভাবে জানা হয়নি।

হাইস্কুল থেকে সরিয়ে নিয়ে আমায় ভর্তি করানো হয় শমশেরনগর গার্লস হাইস্কুলে। ওই স্কুলে মামনি চাকরী করতো। আমাদের প্রধান শিক্ষক বশির আহমদ স্যার। প্রচন্ড মাত্রায় রাগী এবং যথেষ্ট কড়া। তবে একটা কথা না বললেই নয়, উনার মধ্যে স্বজনপ্রীতি ব্যাপারটা নেই। যদিও এ শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছি অনেক অনেক পরে। মাওলানা স্যারের অমন ব্যবহার মানসিকভাবে আমাকে এতোটাই আতঙ্কিত করে রেখেছিলো যে বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে মাত্র তেত্রিশ পাই। হেডস্যার আমায় ডাকলেন, অভিভাবকদেরকেও। তখন সব জানলেন স্যার, বললেন কোনো শিক্ষক যদি এমন ব্যবহার করে কখনো, আমি যেনো প্রতিবাদ করি। তারা শিক্ষক না, শিক্ষকতার কলঙ্ক এরা। আমি যেনো কথাটি মনে রাখি।

১৯৮৫ সাল, হঠাৎ ক্লাশে আমাদের প্রধান শিক্ষক বশির আহমেদ স্যার নিজে এসে আমায় ডেকে নিলেন উনার রুমে। ক্লাশে ঢুকতেনই একসাথে দুটো বেত নিয়ে। যাক বেশ ভয়, কোনো অন্যায় কি করেছি? খুঁজে পেলাম না। অনেক শান্তশিষ্ট ছিলাম। তার দুটো কারণ সেভাবে কারো সাথে মিশতে পারতাম না, আর মামনি ছিলো আমাদের স্কুলের টিচার। যাক আমি গেলাম, আমাদের দপ্তরী মন্নাফকে ডাকলেন স্যার, "এই যা তো এম.আর.ডি ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে আয়।" আমার অবস্থা তো আরোও খারাপ। কি করেছি এমন যে মামনিকেও ডাকছেন স্যার? আবার নিজেকে বলছি কোনো খারাপ কিংবা অন্যায় করিনি, ভয় কিসের? যাক মামনি আসার পর স্যার বললেন, "ম্যাডাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। স্কুল থেকে আমি নীলাকে পাঠাতে চাই। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?" মামনি হেসে ফেললো, "স্যার ছাত্রী আপনার, আমি কেন না করবো?" আসলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাই নাকি অনুমতি চেয়েছিলেন স্যার। পরে বলেছিলেন আমার স্পষ্ট সব মনে আছে। "ম্যাডাম আমি জানি আপনারা কি মনের, তবু এটা আমার ডিউটি। যে মেয়ে মসজিদ দেখেও সালাম করে, কাদের থেকে এ শিক্ষা পেয়েছে, সেটা জানি আমি।"  ওসব শুনে আমার যে কি গর্ব মামনি-বাপিকে নিয়ে! অবশেষে প্রতিযোগিতা প্রথমে থানা পর্যায়ে। আমি প্রথম হলাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের "খেয়াপারের তরণী" কবিতা আবৃত্তি করে। এই আবৃত্তি আমায় বাপি শিখিয়েছে। আবৃত্তি আমার ভালো হবার কারণ ছিলো যে শব্দগুলো বুঝতাম না, বাপি সেগুলো বুঝিয়ে দিতো। তাতে আবেগের পূর্ণতা থাকতো। যাক তারপর জেলা পর্যায়ে গিয়েই ঝামেলা হলো। তখন আমাদের জেলা ছিলো সিলেট। ওখানে আবৃত্তি করলাম কবি ফররুখ আহমেদের "পাঞ্জেরী" কবিতা। আমায় বিচারকেরা ডেকে নিয়ে বললেন, "মা তুমি অনেক ভালো আবৃত্তি করেছো। কিন্তু তারপরেও তোমায় প্রথম স্থান দিতে পারছিনা, কিছু সমস্যা আছে।" আমার সাথে ছিলেন আমাদের বশির আহমেদ স্যার। উনি জানতে চাইলেন কারণ কি? একটাই কারণ আমি অন্য ধর্মের। স্যার তো ক্ষেপে একেবারে আগুণ। কোথায় লেখা আছে অন্য ধর্মের কেউ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেনা? স্যার বলতে শুরু করলেন "আপনি কি কখনো কোনো মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে ভেবেছেন? এই মেয়ে মসজিদ দেখলেই হাত তুলে সালাম করে।" তারপর বাধ্য হয়ে বিচারকমন্ডলী দুটো সনদ দিলেন আমায়। একটি বিশেষ প্রশংসাপত্র, যেখানে লেখা ওইটুকু বয়সে আমি পাঞ্জেরীর মতো কবিতা আবৃত্তি করেছি গভীর আবেগ নিয়ে। আরেকটি সনদ দিলেন দ্বৈতভাবে প্রথম হবার। দ্বৈতভাবে দেয়ার কারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে আমায় পাঠানো হবেনা। স্যারকে বোঝালেন উনারা যে ওখানে গেলে আমার মন ভেঙ্গে যাবে। প্রথমেই প্রতিযোগীতা থেকে বের করে দেবে। স্যার কিছুতেই রাজি হলেন না। অবশ্য আমার সাথে বাপিও গিয়েছিলো। বাপিও স্যারকে বোঝালেন। সিলেট থেকে ফিরে এলাম। আমায় নিয়ে স্যারের খুব গর্ব ছিলো। আমি কি না কি জানি হবো!

স্যারকে নিয়ে আরোও অনেক গল্প আছে যা পরের পর্বে বলবো। এই স্কুলেই আমি পেয়েছি আত্তর আলী স্যার, মুকুল স্যার, আপামনি, ইমাম স্যার, সায়েক আহমদ হিমু স্যার। আত্তর আলী স্যারের কাছে আমি ঋণী, যা শোধ হবে না কখনো।

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
৯ জুলাই, ২০১৬ ইং।

যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন (প্রথম ভাগ)

0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ