ইডিপাস রেক্স

আরজু মুক্তা ২৪ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ০৮:১৮:২২অপরাহ্ন বুক রিভিউ ২৬ মন্তব্য

সৃষ্টিকর্তা  ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কি খণ্ডন করা যায়? একে গ্রিক মাইথলজিতে বলা হয়েছে বিশ্ববিধান। বিশ্ববিধানে মানুষের হাত নেই।নিয়তি যেভাবে মানুষকে নিয়ে খেলবেন, মানুষ সেভাবেই খেলবে।  এখানেই মানবজীবনের ট্র্যাজেডি নিহিত। শেক্সপিরিয়ান ট্র্যাজেডিতে মানুষের কর্মই তার নিয়তি।   এই পৌরাণিক কাহিনীর বিশ্বাসকে ধারণ করে বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার সোফোক্লিস তাঁর বিশ্ববিশ্রুত নাটক ‘ ইডিপাস রেক্স’  লিখেন।

সোফোক্লিস গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। তখনকার সময়ে এথেন্সে একটি আইন প্রচলিত ছিল যে, সন্তান হত্যা একটি মস্ত বড় অপরাধ ও মহাপাপ। সোফোক্লিস এই অপরাধটির চিত্র নাটকে রূপায়িত করার জন্য প্রচলিত লোকবিশ্বাসকে অবলম্বন করে রচনা করেন ‘ ইডিপাস রেক্স।’

পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘ইডিপাস রেক্স ' নাটকের মূল কাহিনী নিম্নরূপ :

থিবিসের রাজা লেয়াস। জোকাস্টা তার স্ত্রী। বহুদিন সন্তান না হওয়ার কারণ জানতে রাজা লেয়াস একাকী ডেলফির মন্দিরে যান। দৈববাণী শোনা গেল যে, তার এই সন্তান না হওয়ার দুর্ভাগ্যকে তার আশীর্বাদ মনে করা উচিত। কেননা জোকাস্টার গর্ভজাত এবং তার ঔরসজাত সন্তান কালে তার হত্যাকারী হবে। সে জোকাস্টাকে কোনো কথা জানাল না, বরং সে জোকাস্টা থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগল। জোকাস্টা তাকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে সন্তানবতী হলো। নয় মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র লেয়াস ধাত্রীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মেষপালকের হাতে দিল তাকে মারার জন্য মিথায়েরন পর্বতে। নবজাতকের পা দু’টো লোহার শিক দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো যাতে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পারে।

কিন্তু বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। নিয়তির নির্দেশে নবজাতকের মৃত্যু হলো না। পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক তাকে কুড়িয়ে পেলো এবং তার নাম দিলো ইডিপাস। কেননা তার পা দু’টো পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করার ফলে ফুলে গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ইডিপাস শব্দের অর্থ পা ফোলা। মেষপালক তাকে করিনথে নিয়ে এলো। সে সময় রাজা পলিবাস করিনথে শাসন করছিলেন এবং তারা নিঃসন্তান। তাই তারা ইডিপাসকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করতে লাগলো।

একদিন করিনথের এক যুবক ইডিপাসকে এই বলে বিদ্রুপ করলো যে, সে দেখতে তার পিতামাতার মতো নয়। ইডিপাস সন্দিগ্ধ হয়ে ডেলফির মন্দিরে গেল। দৈববাণীতে তার প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেল না, বরং বলা হলো যে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং মাতাকে বিয়ে করবে। এটা তার নিয়তি। চরম হতাশা ও মর্মের বেদনায় বেদনার্ত ইডিপাস আর করিনথে ফিরে না গিয়ে ফোসিস নামে এক জনপদের কাছাকাছি একটা তে-রাস্তার মোড়ে এলো । সে সময় এক বৃদ্ধ রাজা কয়েকজন অনুচরসহ রথে করে যাচ্ছিলেন। ইডিপাসকে রাস্তা থেকে সরে যাবার হুকুম দেয়া হলো। ইডিপাস সরে না দাঁড়ালে রাজা রথ চালাবার হুকুম দিলেন। রথের একটি চাকা ইডিপাসের পা থেঁতলে দিলো এবং রেগে গিয়ে ইডিপাস রাজা এবং তার অনুচরদের হত্যা করলো। একজন মাত্র অনুচর কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গিয়ে থিবিসে জানাল যে, রাজা অনুচরসহ নিহত হয়েছেন দস্যুদের হাতে। ইডিপাস জানতেও পারলো না যে, দৈববাণীর প্রথম অংশ তার জীবনে ঘটে গেল। অর্থাৎ সে তার পিতাকে হত্যা করলো।

রাজা লেয়াস ডেলফির মন্দিরে যাচ্ছিলেন এই জানার জন্যে যে, কী করে স্ফিংকসের হাত থেকে থিবিসবাসীকে রক্ষা করা যেতে পারে। সে সময় স্ফিংকসের অত্যাচারে থিবিসবাসীর জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। একাকী পথচারীকে পেলে স্ফিংকস একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো এবং উত্তর দিতে না পারলে তাকে হত্যা করতো ।

লেয়াসকে হত্যার পর ইডিপাস থিবিসের দিকে যাবার পথে নগরপ্রান্তে স্ফিংকসের কবলে পড়ে। ধাঁধার উত্তর ইডিপাসের জানা ছিল। ধাঁধার উত্তর শুনে স্ফিংকস পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। কেননা এটা হলো তার নিয়তি।

স্ফিংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে থিবিসবাসী ইডিপাসকে রাজারূপে বরণ করে নিল। ইডিপাস রাজা হয়ে ; রাজার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করলো। কারণ সে তো জানতেই পারলো না লেয়াসের বিধবা স্ত্রী তার গর্ভধারিণী মা।

এরপর সুদীর্ঘ পনেরোটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। থিবিসের প্রজাভক্ত রাজা হিসেবে ইডিপাস পরম কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে।  পারিবারিক জীবনেও সে জোকাস্টাকে নিয়ে সুখী। তার চারটি সন্তান- দু’টি ছেলে, দু’টি মেয়ে। ইডিপাস জানতে পারেনি দৈববাণীর দ্বিতীয় অংশটিও তার জীবনে বহুপূর্বেই সফল হয়েছে।

এটাই হলো ‘ ইডিপাস রেক্স’ নাটকের পূর্বসূত্র।  এরপর থিবিস রাজ্যজুড়ে নেমে এলো মহামারী ও দুর্ভিক্ষ।  ভীত-সন্ত্রস্ত নগরবাসী এলো ইডিপাসের কাছে মুক্তির আশায়।

ইডিপাস প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশায় চিন্তিত হলো। সে রাজ্যশ্যালক ক্রিয়নকে এপোলোর মন্দিরে পাঠালো দেবতার নির্দেশ জানার জন্যে। ক্রিয়ন সবার সম্মুখে দৈববাণী জানাতে ইতস্তত করতে লাগলো। কিন্তু সে ইডিপাসের কথায় বললো, রাজ্যের মধ্যে এক মহাপাপকে লালন করা হচ্ছে। এ পাপ মোচন করতে পারলে রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে।

কী সেই পাপ? ভূতপূর্ব রাজা লেয়াসকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ হত্যাকারীর শাস্তিবিধান করা হয়নি। আর হত্যাকারী এ রাজ্যেই আত্মগোপন করে আছে। দেবতার নির্দেশ তাকে নির্বাসনে দিতে হবে। ইডিপাস নগরবৃদ্ধদের ডেকে লেয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য তাদের সহযোগিতা চাইল। তারা জানালো ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসই এর সমাধান দিতে পারবে। টিরেসিয়াসের কাছে ইডিপাস লেয়াসের আততায়ীর সন্ধান জানতে চাইল। সে ইডিপাসকে সত্য কথা বলতে চাইল না। এতে ইডিপাস উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমি এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। এই অন্যায় অভিযোগ শুনে টিরেসিয়াস ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বলে ইডিপাসই রাজা লেয়াসের হত্যাকারী। শুধু তাই নয়, সে তার নিকটতম আত্মীয়ের সাথে পাপের মধ্যে বসবাস করছে। এই অবিশ্বাস্য কথা শুনে ইডিপাসের মনে সন্দেহ হলো, ভাবল হয়তো ক্রিয়ন রাজ্যের লোভে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।

এরপর ক্রিয়নের সঙ্গে ইডিপাসের বাকবিতণ্ডতা শুরু হয়। কেউ শান্ত হতে চায় না। এমন সময় রাণী জোকাস্টা এসে সব কথা শুনে বলল, এতে ইডিপাসের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সত্য হয় না। যদি তাই হতো তবে আপন সন্তানের হাতে লেয়াসের মৃত্যু হতো। কিন্তু তাতো হয়নি। তিনদিনের শিশুকে নির্জনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আর সকলেই জানে ফোসিস নামে এক জনপদের কাছে রাস্তার মোড়ে দস্যুদলের হাতে লেয়াসের মৃত্যু হয়েছে।

এই কথা শুনে ইডিপাস চমকে উঠলো এবং লেয়াসের মৃত্যুর ঘটনা তার অন্তরে এক অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করলো। লেয়াসের চেহারা কেমন ছিল, কয়জন লোক তার সঙ্গে ছিল। সব কিছু সে জিজ্ঞেস করে যখন মিলে গেল, তখন সে বুঝতে পারল, সে-ই লেয়াসের হত্যাকারী এবং বেঁচে যাওয়া অনুচরকে খুঁজে বের করলো বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্যে।

এমন সময় করিনথে থেকে এক বৃদ্ধ এসে খবর দিল যে, রাজা পলিবাসের মৃত্যু হয়েছে এবং সেখানকার জনগণ ইডিপাসকে রাজা হিসেবে পেতে চায়। ইডিপাস জানে, সে পলিবাসের সন্তান। পলিবাসের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অতএব দৈববাণী মিথ্যা প্রতিপন্ন হতে দেখে সে এবং জোকাস্টা আনন্দিত হয়। তবু ইডিপাসের আশঙ্কা, তার মা মেরোপী বেঁচে আছে। তাই করিনথে ফিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেনি সে।

করিনথের রাজদূত ইডিপাসের মনের শঙ্কা দূর করতে চাইলো। সে বলল, ইডিপাস রাজা পলিবাস মেরোপীর আপন সন্তান নয়। এক মেষপালক শিশু ইডিপাসকে কুড়িয়ে পায় এবং সে নিঃসন্তান রাজা-রাণীর হাতে তাকে তুলে দেয়। তারা তাকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করে। কিন্তু তারা ইডিপাসের আপন পিতামাতা নয়।

ইডিপাস মেষপালকের সন্ধানে লোক পাঠায়। এই মেষপালকের কথা জোকাস্টা ইতঃপূর্বে ইডিপাসকে বলেছে। সব ঘটনা শুনে জোকাস্টা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং ইডিপাসকে ক্ষান্ত হতে অনুরোধ করে। কিন্তু ইডিপাস কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না। সে তার জন্ম-রহস্য উদঘাটন করবেই।

কিন্তু জোকাস্টার কাছে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। সে অস্থির উন্মাদনা নিয়ে চলে যাবার আগে বলে গেল, ‘অন্ধ, তুমি অন্ধ। হায়রে অভাগা। তুমি যেনো কখনো না জানো তুমি কে।’

জোকাস্টার এরূপ ব্যবহারে ইডিপাস ভাবলো হয়তো কোনো নীচু ঘরের সন্তান সে। তবু সে জন্ম-রহস্য জানার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। মেষপালক এলে দেখা গেল এই একই লোক ফোসিস থেকে পালিয়ে এসে লেয়াসের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিল। প্রথমে সে কোনো কথা বলতে চাইল না। কিন্তু ইডিপাসের শাস্তির ভয়ে সে সব কথা খুলে বলল। ইডিপাস তার জন্ম ও জীবনের নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি হয়ে এক  অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল। রাজপ্রাসাদের  থেকে ভেসে এলো জোকাস্টার হৃদয়ছেদী নিদারুণ আর্তচিৎকার। কিছুক্ষণ পর, এক অনুচর এসে জানালো  জোকাস্টা আত্মহত্যা করেছে। আর ইডিপাস তারই পোশাক থেকে একটি কাঁটা খুলে নিজের চোখ নিজেই উপড়ে ফেলেছে।

পথ হাতড়ে বেরিয়ে এলো অন্ধ ইডিপাস। নিজের শাস্তি নিজেই মাথা পেতে নিল। স্বদেশ থেকে দূরে বহুদূরে নির্বাসনই তার একমাত্র শাস্তি। বালিকা কন্যার হাত ধরে বেরিয়ে যায় হতভাগা ইডিপাস।

‘ইডিপাস’ এক আশ্চর্য জীবন্ত চরিত্র। পরিণামে যাই ঘটুক না কেন, কলঙ্কিত অতীত জানতে পেরে আত্মগ্লানি ও অনুশোচনায় মুহ্যমান ইডিপাস। কিন্তু নিয়তির কাছে হার মানেনি সে। এমন প্রাণবন্ত চরিত্র কেবল গ্রিক নাট্যসাহিত্যে নয়, বিশ্বনাট্য সাহিত্যে বিরল।

সোফোক্লিস এ নাটক নির্মাণে সবিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশ্বনাট্য সাহিত্যে তাই অতুলনীয় এক ট্র্যাজেডির নাম ‘ইডিপাস রেক্স।'

 

 

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ