"ছোটবেলা বলতে আমি তেমন ভাবিনা কারন আমি মনে করি, এখনো আমি বড় হয়নি। আমি বাবা মায়ের সেই ছোট আলিফ আছি"

আব্বু চাইতেন অন্তত আরেকটা প্রমোশন হোক তবে সেটা যোগ্যতায়, উপরের মহলকে ঘুষ দিয়ে নয়।

রমজান মাস সকাল ৮ টায় আমার মায়ের জুড়ে ছোট পরী জন্ম নিলো নাম রাখা হলো আলিফ। ওই দিনের আব্বু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রমোশন পেলেন,সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে আমি চিহৃিত হলাম, পরিবারে তৃতীয় সন্তান।

আমার পরিচয় হলো ইউএনও সাহেবের মেয়ে এটা অনেক আনন্দের,গর্বের জায়গা ছিলো। আমি ছোটবেলা থেকে ময়মনসিংহ শহরে থাকি। তাই ঈদের বা রোজার আনন্দ গুলো সব সময় চার দেয়ালের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবো।

৪-৬বছর বয়সে রোজার মানে বুঝতাম না,তবে সেহেরি খেতে হবে এটা বুঝতাম। আব্বু আম্মু সাথে সেহেরি খাইয়ে তারপর ঘুমাতে দিতেন।

৭-৯ বছরে বুঝতে পারলাম রোজার মানে। বন্ধুরা শখ করে রোজা রাখে, তো আমাকেও রোজা রাখতেই হবে।আব্বুর কাছে বায়না ধরলাম রোজা রাখবো তিনি বুঝালাম সারাদিনে যতবার খাব তত গুলো রোঝা হবে।এই বিশ্বাস মনে রেখে আলহামদুলিল্লাহ্ জীবনের প্রথম রমজানে ৯০টা রোজা পূর্ণ করলাম, আর ঈদের দিন আব্বুর কাছ থেকে দামী গ্রিফ্টও পেলাম 😍।সেই ঈদটা হয়তো জীবনের খুব বেশি স্পেশাল হয়ে রইল।

১০-১৩ বছর আমার বয়সের তুলনায় স্বাস্থ্যটা কম ছিলো। তাই আম্মু,আব্বু চেষ্টা করতেন আমার স্বাস্থ্য বাড়াতে কিন্তু নিজেকে বড় বলে দাবী করতাম এবার রোজা রাখবোই।অবশেষে দাদু বললেন আচ্ছা রোজা রেখে অভ্যাস করুক সমস্যা কি.?

আল্লাহ্ ভরসা চেষ্টা করতে করতে ৭ তম রোজাটা রাখার সিদ্ধান্ত হলো। সারাদিন ফোনে সবাইকে জানালাম আমি রোজা, এটা নিয়ে খুব গর্ব হচ্ছিল। সারাদিন আম্মুকে বললাম কি কি ইফতারিতে খাব তার লিস্ট জানালাম আব্বু, আম্মু আবার আমাদের খুব স্নেহ করেন তাই লিস্ট অনুযায়ী সব রান্না করলেন। বিকাল ২ টা বাজে ইফতারের শেষ সময় সন্ধ্যা ৬.২০ মিনিট দেওয়াল ঘড়ি দেখতে দেখতে সময় যেন আর শেষ হচ্ছিল না।

ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শয্যা নিলাম।শরীরে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলে,উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। বাসায় কান্নার বিলাপ শুরু হলো। আব্বুকে অফিসে ফোন দেওয়া হলো তিনি বাসায় ফিরে দেখলেন।আমি শুধু সবাইকে চেয়ে দেখতে পারি কথা বলার অবস্থায় নেই।তাড়াতাড়া হাসপাতালেে নেওয়া হলো, স্যালাইন, সুচ ছোটবেলা থেকেই ভয় পাই তারপর রোজা ট্যাবলেট খেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে! শরীরের সর্বত্র শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আব্বু আমি সুস্থ আছি প্লীজ স্যালাইন দিও না।

ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন ইউএনও সাহেব সন্তানদের স্নেহে পাগল হয়ে গেছে সুস্থ মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। আমাকে সুস্থ থেকে সবাই খুশি হলো, বাসায় নিয়ে ফিরল তখন আনুমানিক ৫.৪০বাজে।আমাকে দাদুর রুমে শুইয়ে দিল যাতে গল্প করে সময়টা কেটে যায়। সময় ভালোই যাচ্ছে শরীরের কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছি।

বাসায় টিভি অন করা ইফতারের আগের সময়টা কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে আমি জেগে জেগে সব শুনছি।এর মধ্যেই কাজের মেয়েটা এসে দাদুর রুমে ইফতার এনে বিছানায় সাজাতে লাগলো।জিঙ্গাস করলাম সুমি আম্মু কোথায় রে? খালাম্মা রান্না করতেছে অপনি অসুস্থ তো তাই,আজ সবাই দাদুর রুমে ইফতার করবে।শোনে খুব খুশি হলাম, কারন এতক্ষন শুয়ে শুয়ে মন খারাপ হচ্ছিল আমি অসুস্থ বলে হয়ত আব্বু,আম্মু, আপু,ভাইয়া সবাই একসাথে ইফতারি করবে।সামনে এত্তো ইফতারি আয়োজন বার বার মনে হচ্ছিল কখনো আজান হবে! ইফতার করবো লোভ হচ্ছিল। দাদু বয়স্ক মানুষ কানে কম শোনেন, তিনি এত ইফতারি দেখে ভাবলেন হয়ত আজান হয়েগেছে। রোজা খোলার দোয়া বলেই খেজুর, সরবত খেয়ে ইফতারি করলেন, আলিফ ইফতার করো আমিও সরবত খেয়ে নিলাম,খেজুর খাচ্ছি।

আম্মু কোন কাজে রুমে আসছিলেন তিনি হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছিলেন না। দাদু আম্মুকে দেখেই বললেন সারাদিন কি করো ইফারের সময় চলে যাচ্ছে! এখনো কড়াই হাতে ঘুরছো কেন? আম্মু হাতের কড়াইটা চেয়ে দেখে বললেন মা, বুট গুলো গরম করছিলাম।দাদু আম্মুকে আরো তাড়া দিলেন যাও আজিজকে বলো ইফতারের জন্য আমি ডাকছি।

আম্মু চুপচাপ চলে গেলেন আমরা দুজন মিলে প্রায় ইফতারি শেষ করে ফেলতেছি, রুমে ভাইয়া ঢুকলো সর্বনাশ আম্মু কোথায় তুমি? আমি হেসে বললাম ভাইয়া আমার ১ রোজা করেছি।বড় আপ্পি দেখে হাসছে!ছোট বোনটা দৌঁড়ে আসলো আমাকে রেখে সবাই ইফতার করে ফেলছো ম্যা ম্যা ম্যা করে কান্না জুড়ে দিল।আব্বু টিভির সামনে মোনাজাত ধরবেন তারপর আজান শুনে টিভি বন্ধ করে ইফতার করতে দাদুর রুমে আসবেন।

কিন্তু দাদুর রুমে হৈ চৈ শুনে কান্ড কি দেখতে আসলেন, তখনো ইফতারের ৫ মিনিট বাকী মা আজান হয়নি তো! আম্মু থামিয়ে দিয়ে বললেন টিভির দিকে তাকালে আশেপাশের কিছু শোন? আব্বু বোকা হয়ে গেলেন। শোন টিভিতে আজান দিতে দেরি হয়, আমাদের মসজিদে আজান হয়েছে মা ইফতার করছেন সমস্যা নেই।দাদু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন রোজাটা রক্ষা পেল।আম্মু টিভি বন্ধ করে দিলেন যাতে আজানের আগে ইফতার করেছেন দাদু তা বুঝতে না পারেন।আব্বুকে আড়ালে বুঝালেন দাদু বয়স্ক মানুষ, আমি বাচ্চা মানুষ আল্লাহ্ নিশ্চয় রোজা কবুল করে দিবেন।

আমরা সবাই ইফতার করলাম জীবনের প্রথম রোজা রেখেছি এই বিশ্বাসটা পরবর্তী দু-বছর ছিলো। হঠাৎ একদিন রাগ করে বড় আপ্পি বললেন তোমার রোজা হয়নি, আম্মুর কাছে সত্যিটা জানলাম খুব হাসি পেল তবে রোজা ভাঙ্গার বোকামীর জন্য আক্ষেপ রয়ে গেল।

১৪ বছরের পর আব্বু, আম্মু নিষেধ করলেও রোজা রাখলাম।আব্বু অনেক সৎ মানুষ ছিলেন তাই অনেক উচ্চপদে চাকরি করেও আমরা সাধারন ভাবে জীবনযাপন করতাম।খুব বিলাসিতা আব্বু,আম্মু পছন্দ করতেন না, তবে রমজান ঈদে, কুরবানী ঈদে সার্ধমতো আমাদের নতুন জামা দিতেন।

২০০৫ সাল, বাসায় ফ্রিজটা প্রায় ৩ মাস নষ্ট ছিলো, নতুন ফ্রিজ কিনার কথা তারা ভাবেই না। যখন হাতে বেশি টাকা আসবে তখন কিনবেন। লোন বা কিস্তি সুদ এমন অফার গ্রহন করবেন না। কারন সৎ কর্মজীবনে এক টাকা ঘুষ খাননি তাই কাউকে সুদ দিবেন না।

সেই রমজান মাসে আম্মু অনেকটা কষ্ট করে রান্না করতেন, ফ্রিজের অভাবে সব সদ্য রান্না করতে হতো, ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করলেও পেতাম না। এটা নিয়ে আব্বুর কাছে আম্মুর কোন অভিযোগ ছিলো না।কিন্তু আব্বু বুঝতে পারতেন আম্মু রাজকীয় জীবনযাপনে অব্যস্ত এই পরিবারে তার কষ্টে হয় কিন্তু সংসারের মায়ার সব মেনে নেন।

ছোটবেলা থেকে প্রতি ঈদে নতুন কাগড় পেয়ে আসছি, হঠাৎ আব্বু আমাদের সব ভাই,বোনকে  ডেকে বললেন এবার রমজান ঈদে তোমাদের কাউকে নতুন কাপড় দিব না।আমাদের সবার কিছুটা মন খারাপ হলো তবে আমার একটু বেশি, কারন আমি সাঁজতে খুব ভালোবাসি। আম্মু আমাদের বুঝালেন বাবা হয়ত টাকাটা কোন দরকারে খরচ করবে,তাই

সবাই আব্বুর সিদ্ধান্ত মেনে নিল।রমজান ঈদের আর ৫ দিন বাকি নতুন জামা পাইনি বলে খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে সবাই মিলে অনুসন্ধান করতে ব্যস্ত আব্বু টাকায় দিয়ে কি করবেন কোন সুরাহা পাচ্ছিলাম না।

আব্বু তখন কিশোরগঞ্জ চাকরি করেন সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বাসায় আসেন শনিবারে চলে যান।ঈদের ছুটিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টা আব্বু বাসায় ফিরছিলেন না। আম্মু,দাদুর টেনশন বেড়ে গেল, এতরাতে অফিসে কেউ নেই তখন মোবাইলের যোগাযোগ কম ছিলো।

ভাগ্যিস কল দিয়ে অফিসের পিয়নকে পেলাম,তিনি জানালেন মামনি, স্যার আজ কিশোরগঞ্জ একটা ফ্রিজের শোরুমে গিয়েছেন।

১৪সেপ্টি একটা ফ্রিজ কিনেছেন, বিকাল ৪টায় আমি স্যারকে ট্রেনে তুলে দিয়েছি ম্যাডামকে চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। স্যার রাত ৯ টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁচ্ছবেন, আর মামনি স্যার ফ্রিজ বিষয়টা আপনাদের সারপ্রাইজ দিবেন, তাই কারো কাছে বলবেন না।আমার খুশিটা অনেক কষ্টে আটকে রাখলাম, আম্মুকে জানালাম আব্বু ট্রেনে আসছে, সবাই চিন্তামুক্ত হলো।

রাত ১০টা আব্বু বাসায় ফিরলেন ফ্রিজ দেখে সবাই খুশি, নতুন জামার কষ্ট ভুলে গেলাম।আব্বু বললেন তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম তাই আগে বলি নাই।আম্মু সকালে বললেন সবাই রেডি হও আমরা মার্কেটে যাব, সবাই অবাক হলাম টাকা নেই তো!আম্মু মাস খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে ফ্রিজের জন্য ১৩ হাজার টাকা জমিয়ে ছিলেন তা আব্বুর হাতে তুলে দিলেন। যাও বাচ্চাদের নিয়ে ঈদের শপিং করো, আব্বুর চোখে সেদিন প্রথম পানি দেখেছিলাম আম্মুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন।তোমার মতো স্ত্রী প্রতিটা ঘরে থাকলে সংসারে অশান্তি বলে কিছু থাকতো না, আমরা খুশি মনে মার্কেটে গেলাম।সবার পছন্দ মতো কাপড় কিনলাম, আব্বুর পছন্দ করে আম্মুর জন্য কাপড় কিনলেন।এই ঈদটাও জীবনের সারপ্রাইজ হয়ে রইল।

২০১৮ সাল বয়স ২৪ চলছে কিন্তু মন মানসিকতা সেই ১৪ বছরেই আটকে আছে। ছোটবেলা জনতাম আম্মু মাস্টার্স পাশ মনে মনে গেঁথে নিলাম পড়াশোনা করে মাস্টার্স পাশ করবো।পড়তে বসলে আঁকাআঁকি বেশি করতাম, গল্প,কবিতা লিখতাম,পড়তে ইচ্ছে করতো না। সবাই টেনশন করতো আমি হয়ত পাশ করতে পারবো না।আব্বু বলতেন মায়ের মতো পড়াশোনা করতে হবে! ২০১৮ সালে আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দিলাম,১৪ আগস্ট নিজেই রেজাল্ট নিলাম Ist Classe পেলাম।

সর্ব প্রথম আব্বুকে ফোন দিয়ে জানালাম আব্বু খুব খুশি হলেন।রমজান মাস আব্বু কখনো জন্মদিনে উৎসব পছন্দ করেন না, ১৭ আগস্ট আমার জন্মদিন ছিলো আব্বু নিজেই কেক আনলেন, ধুমধাম করে বুড়ি মেয়ের ভালো রেজাল্ট আর জন্মদিনের সারপ্রাইজ দিলেন এবং জীবনের প্রথম গ্রামে গিয়ে আমরা সবাই ঈদ করলাম, আত্মীয়স্বজন সবাই আসলেন, অনেক আনন্দ করলাম, দিনটা জীবনে স্বরণীয় খাতায় চলে গেল....!

আমি এখনো ঈদে প্রচুর সাজগোজ করি,বাচ্চাদের মতো সারা বাসা ঘুরে বেড়াই।

#অনেক কিছু লেখা হয়নি তবু লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেল, কারন আমি আমার পুরো আমিত্বটা তুলে ধরতে চেয়েছি।

বাবা মায়ের ভালোবাসার কোন তুলনা হয়না ওনারের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ নির্ভেজাল,নিরাপদ আশ্রয়।

আমার পৃথিবীর সেরা দুজন মানুষ আম্মু,আব্বু। স্যালুট জানাই তোমাদের আদর্শকে,সততাকে,ভালোবাসা রইল আজীবনের জন্য তোমাদের জন্য।

আলিফ।

0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ