আমার একেকটা ছবি একেকটি গল্পঃ

শামীম চৌধুরী ৩০ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০৭:২৭:৫৮অপরাহ্ন পরিবেশ ২০ মন্তব্য

আমরা আকাশ-মেঘ,নদী-নালা,পাহাড়-পর্ব্বত,সাগর-সমুদ্র,গাছ-পালা ও ফল-মূলকেই প্রকৃতি মনে করি। যদিও এরা সবই প্রকৃতির অংশ। তারপরও কিছু প্রানী আছে যারা প্রকৃতিতেই বাস করে। মানুষ দ্বারা বা প্রকৃতির যে কোন নিষ্ঠুর আচরন তারা সহ্য করতে পারে না। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে তাদের জীবন-যাত্রার মান, খাবার-দাবার, বাসা বানানো থেকে শুরু করে প্রজনন পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশী বাঁধার সম্মুখীন হয় বংশ বিস্তার। তারমধ্যে বণ্যপ্রানীরা অন্যতম। যে কোন বন্য পশু-পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রকৃতি। তারাই প্রকৃতির অলংকার। আর যারা প্রকৃতির এই অলংকারকে ভালবাসেন তারাই প্রকৃতিপ্রেমী।

করোনাকালে দীর্ঘ ৪ মাসের অধিক পুরা বিশ্বে আমাদের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম থেমে যায়। থেমে যায় মানুষের জীবন-যাত্রা সহ নানাবিধ শখ-আহ্লাদ। প্রকৃতিপ্রেমীদের ঘরে বন্দী থেকে দিনানিপাত করতে হয়। এই বন্দীদশা থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা মুক্ত হবার যারপরনাই অপেক্ষা করতে থাকেন। অদৃশ্য ভাইরাসের কারনে মানুষের ভিতর অস্থিরতা ও আতংক দিন দিন বাড়তেই থাকে। তার মূল কারন মানুষ এই পরিবেশে অভ্যস্ত না। যার ফলে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়, কি করে এই পরিবেশ থেকে উত্তরন পাওয়া যায়।

দীর্ঘ চার মাস মানুষের পদচারনা না পড়ায় প্রকৃতি নুতন রূপে সারা বিশ্বে তার হারানো যৌবন ফিরে পায়। মাঠ-প্রান্ত থেকে শুরু করে আকাশ-মেঘ তার বর্ণিল শোভা বসুন্ধরায় ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সাঁজে সবুজাবরনে। যে দিকে দুই চোখ চায় শুধু সবুজ গালিচায় মোড়ানো মাঠ-প্রান্তর ও গাছ-পালার সৌন্দর্য দেখা যায়। প্রকৃতির অলংকারেরা নিজেদের বিলিয়ে দেয় সবুজের মাঝে। এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যার্থ হয় প্রকৃতিপ্রেমীরা।

ধীরে ধীরে মানুষ এই বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করে জীবিকার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমেই দেখতে পায় প্রকৃতির নতুন যৌবন। যা দেখে মানুষ আপ্লুত হয়ে পড়ে। প্রকৃতির প্রতি নীরেট ভালবাসার জন্ম নেয়। এখন আমাদের উচিত হবে প্রকৃতির হারানো যৌবনকে ধরে রাখতে। নইলে আমরা আবার সব হারাবো।

গত শনিবার ২৫’জুলাই বিশেষ কাজে ঢাকার কেরানীগঞ্জে যাই। বহুদিন পর ঘর থেকে বের হচ্ছি ভেবে ক্যামেরা সঙ্গে নেই। চিরচেনা কেরানীগঞ্জের প্রবেশ মুখ হারিয়ে ফেলি। চারিদিকে শুধু পানি আর সবুজের আস্তর। প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের গন্তব্যে পৌছি। কাজ শেষ করে ছবি তোলার জন্য বের হই। হরেক প্রজাতির দেশীয় পাখির কলতানে মুগ্ধ হয়ে বেমালুম ছবি তোলার কথা ভুলে যাই। বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির ছবি তুলি। যদিও সব পাখির ছবি আগেই তোলা ছিল। তারপরও ভাল শটের লোভে ছবি তুলতে হয়। বহুদিনের সাধনা ছিল Common Hoopoe বা সোলায়মান পাখি বা হুদহুদের মাথার ক্রাউন বা তাজ মেলে ধরার একটা শট নেওয়ার। স্বভাবতঃ এই পাখি আতংকগ্রস্থ বা বিপদের সম্মুখীন হলে এবং উড়ে যেয়ে কোথাও বসার সময় মাথার তাজ মেলে ধরে। সেদিন হুদহুদের ক্রাউন মেলে ধরার ছবি তুলে সেই শখটিও পূরন করলাম।

চারিদিকে ঘন ঝোপ-ঝাড়। পিনঃপতন। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। সুন-সান এলাকা। বহুবার কেরানীগঞ্জে গিয়েছি। এমন পরিবেশ কখনই দেখিনি। রীতিমত ভয় পাচ্ছিলাম। ভাবলাম বাসায় ফিরে যাই। এমন সময় চোখ গেল একটি বাঁশ ঝাড়ে। দেখা পেলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দের পাখি Indian roller বা নীলকন্ঠের। বাঁশের একটি কঞ্চির উপর বসে আছে। নিজেকে পাখির দৃষ্টির আড়াল করে সামনে আগালাম। দীর্ঘদিন পাখির ছবি তোলা ও পাখির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কীয় অভিজ্ঞতা থাকায় জানতাম যে, পাখিটি এক সময় উড়াল দিবে। তাই ক্যামেরায় সেটিংস ঠিক করে বেশ কয়েকটি ক্লিক করলাম। ক্যামেরার ফ্রেমে নীলকন্ঠ বন্দী করে চলে আসলাম।

এই পাখিটি  আমার স্বপ্নের পাখি। বার্ড ফটোগ্রাফী শুরু করার পর দুটি পাখির উপর আসক্ত ছিলাম। দুধরাজ ও নীলকন্ঠ। ২০১২ সালে প্রথম এই পাখিটির ছবি তুলেছিলাম পুরাতন বিমানবন্দর থেকে। সঙ্গে ছিলেন আমার মরহুম বড় ভাই হান্ডালা হামীম। উনার একান্ত ইচ্ছা ও সহযোগিতায় পাখিটির ছবি তুলতে পেরেছিলাম। তার মূল কারন ছিলো পুরাতন বিমানবন্দরের ভিতরে জনসাধারনের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেহেতু তিনি সেই সময় উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসে জিএসও-২ পদে কর্মরত ছিলেন। যার জন্য অনুমতি নেওয়া উনার জন্য সহজ ছিলো। আমরা দুই ভাই টানা সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পাখিটির পিছনে সময় ব্যায় করেছিলাম। উনি বার্ড ফটোগ্রাফী করতেন না। উনি ছিলেন প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফার। পাঠকদের সুবিধার জন্য বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গটি আনতে হলো। এক সময় ধৈর্য্যচ্যুতি হলে উনাকে বলি চলেন চলে যাই। উনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন এই পাখির একটি ভাল শট আমার দরকার। আর সেটা তুমিই আমাকে দিবে। পাখিকে বিরক্ত না করে কি করে ছবি তুলতে হয় সেটা উনার কাছ থেকেই শিক্ষা নেয়া। সেদিন ছবি তোলার পর নীচের কথা গুলি আমাকে বলেছিলেন। নীচের এই নীলকন্ঠ পাখিটি ২০১০ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছিল।

ছবি বাছাই করার সময় আমার বড় ভাই মরহুম হান্ডালা হামীমের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথম যে বার বড় ভাইয়ের সঙ্গে পুরতান বিমানবন্দর থেকে নীলকন্ঠের ছবি ফ্রেম বন্দী করি তখন তিনি মেমোরী কার্ড নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ৫০০ অধিক তোলা ছবি থেকে একটি ছবি রেখে সব ছবি মুছে দিয়ে বলেছিলেন, জীবনে বহুবার নীলকন্ঠের ছবি তুলবা। কিন্তু এটার মতন শট কোনদিন পাবা না। তার চেয়ে ভাল হবে,
তারচেয়ে....তারচেয়ে... তবে কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলাতে পারবে না। আর এটাই হচ্ছে ফটোগ্রাফীতে ছবির বিবর্তন। কোনটার সঙ্গে কোনটার মিল নেই। আর এই বিবর্তন আছে বলেই ফটোগ্রাফাররা একই বিষয়বস্তু বা সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করার আগ্রহ পায়।

আজ ছবি দেখে বড় ভাইয়ের কথাগুলি মনে পড়ে গেল। খুব ভাল করে খেয়াল করলাম। বড় ভাইয়ের সঙ্গে তোলা নীলকন্ঠের ছবির সঙ্গে আজকের ছবির কোন মিল নেই। বাকিটা বিচারের দায়িত্ব আমার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।

সবাই ভাল থাকুন।
সবাইকে অগ্রীম
ঈদ মুবারক।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ