জলের নীল...
জলের নীল...

অহর্নিশ,

জীবনে যে কয়টি সময় খুব প্রিয় আমার, সে তোমাকে নিয়েই। আমি জানি বিক্ষোভ আর আন্দোলন ছাড়া তোমার কাছে আর কিছুই মুখ্য নয়। এই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা সমাজ কাঠামোর বদল করতে গিয়ে কতোকিছুই যে উৎসর্গ করেছো, তারপরেও পিছিয়ে পড়োনি। তোমার কাছে ভালোবাসা বলে কোনো শব্দ নেই, আবেগের সাথে বিশাল বিতৃষ্ণা। অথচ সামাজিক দায়িত্ত্ব ঠিকই পালন করে যাচ্ছো। দায়িত্ত্ব শব্দটির সাথে আবেগ-ভালোবাসা আছে বলেই তুমি এখনও এই সমাজ নিয়ে পড়ে আছো। তা নইলে কবেই রাজনৈতিক নেতা হয়ে যেতে! মজা পাই একা একা যখন ভাবি, নিজেকে আর কতোটা ফাঁকি দিয়ে এভাবে চলবে?

নিজেকে কাঠিন্যের খোলসে মুড়ে রাখো এই বলে মৃত্যু দেখতে দেখতে তোমার মধ্যে আর কোনো আবেগ কাজ করেনা। অহর্নিশ এতো মৃত্যু চারদিকে, সবগুলোর কি আর খবর হয়! কোনো কোনোটা সংবাদে চলে আসে, বেশীরভাগই খবরের বাইরে। তুমি কি জেনেছো তোমার জন্যে বহুজনের মৃত্যু হয়েছে? এই তো আজই একজন মারা গেলো, তোমার নির্লিপ্ততায়। সমকালীন অস্ত্রের নাম জানিনা, তবে ভালোবাসা নামের একটি মারণাস্ত্র তোমায় জন্ম দেবে নতূন করে একদিন। আমিও দেখবো, তবে দূর থেকে।

আচ্ছা তোমার এই সমাজ-বদলের কঠিন দায়িত্বের তালিকায় কি কি আছে? অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা আর কি কি? ওসবের অভাব থাকলেই বুঝি মানুষ অসুখী? জানো এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে রোজ খাদ্য আছে, সাথে খাওয়ার খোঁচাও আছে। মাথার উপর ছাদ আছে, কিন্তু সেই ঘরে বাসের জন্যে অনেক কিছু দিতে হয়। বাইরে থেকে সুখ টই-টুম্বুর, ভেতরে বীভৎস কঙ্কাল। তাদের নিয়ে কিছু করো তুমি। ব্যস্ত রাখতে চাও নিজেকে, কি ভোলাতে জানিনা! জানতে চাইওনা। আমি ক্ষতকে খোঁচা দিয়ে রক্তাক্ত করতে চাওয়ার মতো মানুষ নই। বরং ক্ষতের দাগকে প্রশ্নহীন রাখার মতো একজন। মানুষের কাজই হলো প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা। এসব মোটেও ভালো লাগেনা আমার।

অহর্নিশ দুটো মিল তোমার আর আমার মধ্যে। দুজনের মধ্যেই পাগলামী আছে, আমরা দুজনেই আবার বোহেমিয়ান। জানো খুব ইচ্ছে করে কখনো বেড়িয়ে পড়বো, তারপর ঘুরে বেড়াবো। স্পেনের জারাগোজাতে সূর্যাস্ত দেখেই চলে যাবো নরওয়ের ফ্লামভ্যালিতে মধ্যরাতের সূর্যোদয় দেখতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে গ্লাস বিচে হেঁটে বেড়াবো খালি পায়ে। ওই গ্লাসে যদি পা কেটে রক্ত ঝরে, একটু ব্যথায় কি এমন হবে! আর তুমি নিজেকে আবেগহীন বলেছো, এসবে খারাপ লাগার কথা না। এই চিলিতে যাবে? ওই যে দুটো কালো পাহাড় আর মধ্যে নদী, তার জল কালো আর নীল। উফ কি জানি নাম! ভুলে গেছি। সমস্যা না, গুগল আছে না? ঠিক বের করে নেবো নামটা। তারপর ঋতুরাজের আগমন হলে কলারোডার সেভেন ফলসে গিয়ে স্নান করবো জলে। তোমার প্রিয় নীল রঙের শাড়ী পড়ে। অনেকেই চেয়ে থাকবে, দেখবে। অবশ্য তোমার তাতে কি!তোমার তো কোনো কিছু যাবে-আসবে না। তারপর শোনো ওখান থেকে আসবো ভিয়েতনাম, সন ডুং কেভ-এ। গুহার ভেতর একটি রাত সেই আদিম যুগের জীবন কাটাবো। ইস ভাবতেই কেমন লাগছে! শুধু তুমি আর আমি। সারাটি রাত অনেক গল্প-গান-কবিতা, সেই আগের মতো। যখন প্রথম পরিচয় হয়েছিলো তোমার সাথে। তুমি গিটার বাজাবে, আমি শুনবো, গুনগুন করবো দুজনে। ওহ শোনো মশাল নাকি মোমবাতি জ্বালাবো? মশালে অনেক বেশী আলো, মোমের আলোয় লজ্জ্বাটুকু ঢেকে রাখা যায়।

কি যে লিখছি আর কেনই যে লিখছি! জানিনা। তোমার এতো ব্যস্ততার মধ্যে এই চিঠিটা কতোটা যত্ন পাবে, কে জানে! সমাজ বদল করতে গিয়ে তুমি নিজে যে কতোটা বদলে গেছো, সে কি বোঝো? নিজের অস্তিত্ত্বকে বদলে দিয়ে কোনোকিছুরই বদল আনা যায়না অহর্নিশ। কখনোই না। সেই তুমি হয়ে যাও, দেখোই না ভেঙ্গে একটিবার। সেই জায়গায় যেখানে এই যে আমি হাত বাড়িয়ে রেখেছি, এসো। বিশ্বাস রেখে দেখো তোমার ক্ষতি হবেনা। নিজের ক্ষতি কি কেউ করে কখনো? তোমার এই বর্তমানের ভেতর আমি নিজেকে দেখতে চাই, নেবে না? আচ্ছা এই উপকারটুকু কি করবে আমার? স্বপ্নের ভ্রমণটা বাস্তব রূপ দিতে চাই। জানি তুমি আমার সঙ্গী হবেনা, কিন্তু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিতে পারো? সমাজ বদলে নেমেছো যখন নিরাপত্তা তো তোমার কাছেই চাইবো। দেখি কতোটা বদলেছে অ-নিরাপদ সমাজ! আচ্ছা অহর্নিশ বলো না আমায় গুমড়ে থাকা নির্লিপ্ত অভিমান নিজের উপর নিয়ে কোন পথে যাচ্ছো তুমি? তোমায় আমি “একা এবং কয়েকজন” উপন্যাসের সূর্য হতে দেবোনা। এমনকি “কালবেলা”র অনিমেষও না। নির্লিপ্ত-নীরব অহর্নিশকে সত্যিকারের আবেগ জড়ানো বিপ্লবী রূপে ফিরিয়ে আনবোই। পিছু হ’টে যেতে জানিনা আমি। শেষ দেখে তবেই ছাড়ি। আড়াল করে রাখো, এড়িয়ে যাও। কতো দূরে যেতে পারবে? ধরে রাখিনি, রাখবোও না। ভালোবাসা নাকি স্বার্থপর বানিয়ে দেয়! আমার ভালোবাসা মুক্ত-স্বাধীন। সারা আকাশ ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যের সময় পাখী নীড়ে ফেরেই।

আমি সেই লহরী

হ্যামিল্টন, কানাডা
১-লা জানুয়ারী, ২০১৬ ইং।

**বছরের প্রথম লেখাটা চিঠি দিয়েই শুরু করলাম। চিঠি এই বিষয়টি অসম্ভব প্রিয় আমার। এই একটি-ই বোধ হয় মনের গভীর আবেগ থেকে উঠে আসে। অহর্নিশ, প্রতিনিয়ত যে থাকে মনে-মননে, ভাবনায়। আর লহরী তো ঢেউ, অহর্নিশ যে দোল দেয়। ছবি দুটো একই আটলান্টিকের, একই স্থান। শুধু সময় ভিন্ন। পরিবর্তন প্রকৃতিতে ঘটে, আবেগেরও। তাই না?

ঢেউয়ের নির্লিপ্ততা...
ঢেউয়ের নির্লিপ্ততা...

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ