প্রিয়তোষ বড়ুয়া বাংলাদেশ বেতারের একজন নিজস্ব শিল্পী। এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) চট্টগ্রাম এর নিয়মিত উচ্চশ্রেণীর বেহালা বাদক। এছাড়াও তাঁর সহায়তায় বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেহালা সংগঠন ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’। উল্লেখ্য প্রিয়তোষ বড়ুয়া একুশ পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত কবিয়াল কবি ফণি বড়ুয়ার কনিষ্ঠ সন্তান। সম্প্রতি তিনি কথা বলেন আকবর হোসেন রবিন এর সাথে। কথা বলেন, ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’, নিজের ক্যারিয়ার সহ নানা বিষয়ে।

‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রার পেছনের ভাবনা কি ছিলো?

আধুনিক সংগীতের অনুষঙ্গ হিসেবে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কিবোর্ড, গিটার, স্প্যানিশ গিটার ইত্যাদি শেখার আগ্রহ দেখা গেলেও; বেহালা,সারোদ,সেতার ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রকে আধুনিক সংগীতের সাথে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ নিয়ে ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ এর ৭ম বর্ষ অতিক্রম করে ৮ম বর্ষে পদার্পণ করার সময় এই দীর্ঘ পথচলাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এই পথচলা কখনও সহজ ছিলোনা। আমাদের দেশের পেক্ষাপটে ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ বা এই জাতীয় উদ্যোগগুলো বিফল হয় মূলত অর্থনৈতিক কারণ, মানসিক দৃঢ়তার অভাবে। একজন সংগীত পরিবারের সন্তান হিসেবে মানসিক দৃঢ়তা দিয়েই বোধ হয় আজ ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ কে এই অবস্থানে আনতে পেরেছি। এই পথচলায় আমার বেশ কয়েকজন সঙ্গীর কথা মনে পড়ছে। যেমন ডা. তন্ময় সরকার, সমর বড়ুয়া, নিগার সুলতানা, সাবিনা ইয়াসমিন।

‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ এর ৮ম বর্ষপূর্তি নিয়ে পরিকল্পনা যদি জানাতেন…

‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ এর ৭ম বর্ষপূর্তিতে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। ৮ম বর্ষপূর্তিতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। ফেব্রুয়ারির মাসে ‘ভায়োলিনিস্ট’স চট্টগ্রাম’ এর বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠান আশাকরি দৃশ্যমান হবে। আমরা ইতিমধ্যে ৮ম বর্ষপূর্তি উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছি।

সংগীত পরিবারের সন্তান হিসেবে এই সংগীত যাত্রা সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে বলতেন……..

জন্মসূত্রে সুরের বীজ আমার মধ্যে রয়েছে। আপনারা হয়তো জানেন আমার বাবা একজন প্রথিতযশা একুশ পদকপ্রাপ্ত কবিয়াল। আমি আমার বাবার সাথে বিভিন্ন বড় বড় অনুষ্ঠানে যেতাম এবং কাছ থেকে দেখতাম। তখন থেকে আমার মধ্যে সুর সম্পর্কিত অনুভূতি প্রকাশ হতে থাকে।

আমার বাবা আমাকে বেহালা হাতে তুলে দিয়েছিল আমার শৈশবে, তা নিয়েই আমার এই সংগীত যাত্রা। এই পথ চলায় আমি অনেক সুরসাধকের সংস্পর্শে যেতে পেরেছি। ইসমাইল মাস্টার, জাহিদ আনোয়ার, অনিল বরণ চৌধুরী সহ আমার সকল সংগীতের গুরুর কাছে আমি ঋণী। আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এমন একজন গুণী বরেণ্য ব্যক্তি যিনি আমাকে দীর্ঘদিন আলাউদ্দীন ললিত কলা কেন্দ্রে তালিম দিয়েছিলেন, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় প্রিয় গোপাল গুপ্ত। এইসকল গুণী মানুষ আমার মধ্যে যে সংগীত বোধ সঞ্চার করেছিলেন, তাই বহন করে যাচ্ছি এই সংগীত যাত্রায়।

অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে যদি বাবা হয়ে থাকে তবে কেন সংগীত মাধ্যম হিসেবে কবিগানকে বেছে নিলেন না?

দেখেন ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হবে এমন ধারণা করাটা ভুল । আমার বাবা কবিগান করতেন বলে আমিও কবিগান করবো এমন ভাবাটা সঠিক নয়। হ্যাঁ, অনুপ্রেরণার জায়গা আমার বাবা এবং তিনি প্রথম সংগীত যন্ত্র হিসেবে বেহালা তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মধ্যে সংগীত সম্পর্কিত যে অনুভূতি তা কথায় কিংবা কবিগানে প্রকাশ করতে চাইনি। আমার অব্যক্ত কথাগুলো আমি সুরেই বলতে চেয়েছি। তাই হয়তো সংগীত মাধ্যম হিসেবে কবিগানের বদলে যন্ত্র সংগীতকে বেছে নিয়েছি।

বর্তমানে কবিগানকে যদি এককথায় মূল্যায়ন করেন, তাহলে কী বলবেন?

কবিগানের ভাষায় যদি বলতে চাই, “কবিগানে যারা ছিলো কবি, তারা আজ হয়েছে সবাই ছবি”। বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।

আগের প্রশ্নের উত্তরে ক্ষোভের আঁচ ধরে জানতে চাই, বর্তমান সংগীত অঙ্গনের অবস্থা…….

আমাদের সংগীত অঙ্গনে ইদানীং একটি মারাত্মক নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা হলো সংগীত নিয়ে নতুন, মৌলিক, সৃজনশীল কর্মের পরিধি ক্রমশ সংকোচিত হওয়া। এবং রিমেকের নামে বাংলা এবং ভিন্ন ভাষাভাষীর বিখ্যাত গায়কের গান নকল করে স্টেজে পারফর্ম করা। যার প্রধান উদ্দেশ্য খ্যাতি লাভ। যা আমাদের সংগীতে বিকাশের জন্য অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সংগীতে দক্ষতা অর্জনের জন্য অন্যের গাওয়া গান রিমেক করা যেতে পারে। কিন্তু নিজের মৌলিক কাজের জায়গায় সচেতন হওয়া উচিত।

সংগীত জগতের মানুষ হিসেবে এবং রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে কোন বিষয়টি আপনাকে কষ্ট দেয়?

আমাদের দেশে একটি নতুন বিষয় চর্চা হচ্ছে, তা হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রের জনবলকে দেশের বা আর্ন্তজাতিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসম্পদে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু বেদনার বিষয় সংগীতের মতো একটি সম্ভবনাময় জায়গা আজ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। এই বিষয়ে সরকারের আরও নজর দেওয়া দরকার।

ব্যক্তিগত জীবনেও কি এই দুঃখবোধ কাজ করে?
হ্যাঁ, অবশ্যই।

প্রখ্যাত কবিয়াল কবি ফণি বড়ুয়ার ছেলে নাকি ওস্তাদ প্রিয়তোষ বড়ুয়া, কোন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আমার একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে, আমার ক্ষেত্রে বোধহয় ওস্তাদ শব্দটা খাটবেনা। ‘ওস্তাদ’ শব্দটার মাঝে অহংবোধ খুঁজে পাই। হ্যাঁ, আমি মানছি আমার উপলব্ধিটি যুক্তিহীন। আমি নিজেকে প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি যেমন যন্ত্রসংগীত প্রশিক্ষক, বেতার শিল্পী প্রিয়তোষ বড়ুয়া; ঠিক একইভাবে আমি বিখ্যাত কবিয়াল কবি ফণি বড়ুয়ার ছেলে। বরং ফণি বড়ুয়ার ছেলে হিসেবে আমি গৌরববোধ করি।

আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?

ভবিষতে আমি আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় সুরেলা যন্ত্রগুলোকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।

আপনার প্রতি শুভকামনা ও ধন্যবাদ

আপনাকেও ধন্যবাদ

 

( উল্লেখ্য,  আমার নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯  তারিখে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।)

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ