শুরু হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব

নিতাই বাবু ৩ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৮:০১অপরাহ্ন সমসাময়িক ৩৬ মন্তব্য

প্রতি বছরই মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। এ-বছর ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার মহালয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। মহালয়া হয়ে থাকে অমাবস্যা তিথিতে। তখন থাকে ঘোর অন্ধকার। মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয়ে প্রতিষ্ঠা পায় শুভশক্তি। সেই থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের সূচনা এবং দুর্গাপূজার দিন গণনা। এ মহালয়া থেকে শুরু হয় দুর্গাপূজার সবকিছু। আর বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে মূল পূজা শুরু হয় এর কয়েকটা দিন পর থেকে।

এরমধ্যেও প্রতিদিন শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার কিছু-না-কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকেই। যেমন: মহালয়ার পর ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে সায়াংকালে দেবীর বোধন। এরপর দেবীর ষষ্ট্যাদি কল্পারম্ভ। শুরু হবে সায়াংকালে দেবীর  আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ১৬ আশ্বিন (৩ অক্টোবর ২০১৯) বৃহস্পতিবার মহাষষ্ঠী পূজা থেকে শুরু করে ২১ আশ্বিন (৮অক্টোবর ২০১৯) দিনগত রাতে বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই বর্ণিল উৎসবটি।

এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকার মণ্ডপগুলোতে দুর্গা প্রতিমায় চলছে শেষমুহুর্তের তুলির শেষ ছোঁয়া। আমাদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায়  বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এসব পূজামণ্ডপগুলো হচ্ছে, চিত্তরঞ্জন হরিসভা মন্দির, চিত্তরঞ্জন আশ্চর্য বাড়ি পূজামণ্ডপ, গোদনাইল হাজারীবাগ দুর্গামন্দির, হাজারীবাগ বলাই বাবুর মন্দির, ২নং ঢাকেশ্বরী দেব মন্দির, নিউ লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস পূজামণ্ডপ। এসব পূজামণ্ডপেও প্রতিমার শেষ কাজই চলছে। এ-বছর ১৬ আশ্বিন (৩ অক্টোবর ২০১৯) বৃহস্পতিবার  থেকে শুরু করে একনাগাড়ে অলবে পাঁচদিনের জন্য শারদীয় দুর্গোৎসব। এবার দেবী দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে মর্ত্যলোকে আসবেন। যাবেনও  ঘোড়ায় চড়ে। তাহলে এখানে মায়ের আগমন আর গমন নিয়ে বিস্তারিত কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।

মায়ের আগমন:
খাতায় কলমে পুজো শুরু ৩ অক্টোবর থেকে। সেদিনই পঞ্চমী। তারপরও প্রতি বছর আমরা সবাই মায়ের অপেক্ষায়ই থাকি! আর এই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবছর মা দুর্গা আসছেন ঘোড়ায়। পঞ্জিকা মতে বার মায়ের আগমন ঘোড়ায় বা ঘোটকে।

মা দুর্গা দেবীর ঘোড়ায় আগমন হলে তার ফল কী?

প্রতিবারই কোনও না কোনও বাহনে মর্ত্যে আগমন ও মর্ত্য থেকে গমন হয় মা দুর্গার। এমনই মত শাস্ত্রজ্ঞদের। আর ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে সেই বাহনের বিচারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে মায়ের গমন ও আগমনে কী ফল উঠে আসতে চলেছে। ঘোড়ায় মায়ের আগমন মানেই হল ফল ছত্রভঙ্গ। তাতে সমস্ত কিছু ওলট পালট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পণ্ডিতদের দাবি, এই ঘোড়ায় আগমন শুভ নয়।

মায়ের গমন:

৮ অক্টোবর বিজয়া দশমী। আগেই বলা হয়েছে এবার মায়ের গমনও ঘোটকে। অর্থাৎ ঘোড়ায় বা ঘটকে। ঘোড়ায় এই গমন মোটেও ভালো ফল নয় বলে দাবি শাস্ত্রজ্ঞদের। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও সাংসারিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই শারদীয় দুর্গোৎসবটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। যা হয়ে থাকে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা। এটি বাঙালি হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষকের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তীপূজা। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের দুর্গা পূজা বা বাসন্তী পূজাটি অনেকের চোখে পড়ে না। তাই আর এবিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে দুর্গাপূজা নিয়েই আলোচনায় আসা যাক।

দুর্গা পূজার কথা বলতে গেলে, আগে বলতে হয় কুমারী পূজার কথা। এই কুমারী পূজা হচ্ছে দুর্গা পূজারই একটা অংশ। এই কুমারী পূজাটি নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকায় শুধু রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমেই হয়ে থাকে। রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটি শহরের মিশনপাড়াতে অবস্থিত। প্রতিবারের মতো এবারও রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেযে়র পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো। যা শোনা যায় বুড়ো- বুড়িদের কাছ থেকে। তবে আগের মতন বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন তেমন নেই। যা আছে শুধু সারাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতেই হয়ে থাকে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা শেষে শুরু হয় পূজার্থী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ। পূজা পরিচালনা করে নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের প্রধান মহারাজ।

মহারাজ বলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ শারদীয় দুর্গোৎসবে এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। নারী মানে মায়ের প্রতীক। তাই কুমারী পূজা মানে স্বয়ং মাকে পূজা করা’ পৃথিবীতে দেবী দুর্গাই সর্বশক্তিরূপে বিপদনাশিনী। তাকে লক্ষ্য করেই কুমারী পূজা করা হয়। একজন কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করাই হলো দুর্গাদেবীকে পূজা করা’।

দুর্গা পূজার গ্রন্থের তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে জানা যায়, এক থেকে ১৬ বছর বয়সী কুমারীকে পূজা করা যায়। তবে ১০ বছরের কুমারী মেয়েকেই কুমারী পূজায় শাস্ত্রে বশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বয়স অনুসারে কুমারীর নামকরণও করা হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের কুমারী মেয়ের জন্য শাস্ত্রে আলাদা আলাদা নামও রয়েছে।

যেমন:
☛ এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
☛ দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
☛ তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
☛ চার বছরের কন্যা — কালিকা
☛ পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
☛ ছয় বছরের কন্যা — উমা
☛ সাত বছরের কন্যা — মালিনী
☛ আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
☛ নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
☛ দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
☛ এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
☛ বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
☛ তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
☛ চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা
☛ পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
☛ ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা

কুমারী পূজায় যে ধ্যান করতে হয়, ‘মা তুমি ত্রৈলোক্যসুন্দরী, কিন্তু আজ তুমি কালিকাস্বরূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত। তুমি জ্ঞানরূপিণী, হাস্যময়ী, মঙ্গলদায়িনী।’

আর কুমারী পূজার যে প্রণাম মন্ত্র রয়েছে তার অর্থ- ‘মা, তুমি প্রসন্ন হলে আমাকে সৌভাগ্য দান করতে পারো। তুমি সকল প্রকারের সিদ্ধি আমাকে দান কর। তুমি স্বর্ণ, রৌপ্য, প্রবাল কত রকমের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হয়েছ। তুমিই সরস্বতী। আমি তোমাকে প্রণাম করি।’

এবার নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার ৭টি থানা এলাকায় ২০৫টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে, যা গত বছরের তুলনায় ১টি বেশি। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকায় হবে ৭টি মণ্ডপে। ইতোমধ্যে চারুকারুর শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। রংতুলির কাজ যা বাকি আছে, তা শেষ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে। এমনটাই আশা করছে প্রতিটি পূজা মণ্ডপের কর্তারা। পূজামণ্ডপের সামনে এবং রাস্তায়-রাস্তায় বিশাল-বিশাল তোরণ নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ হরিসভা মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে প্রতিমায় রংতুলির শেষ ছোঁয়া। মন্দিরের পুরোহিত বলেন, ‘২৮সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে মায়ের আগমনী বার্তা। দুর্গা মা দুষ্টের দমন ও মানুষের শান্তির জন্য আসবেন। মহালয়া দিন সকালেই পূজা মণ্ডপে পূজার ঘট বসানো হয়েছে। মহালয়ার  সারাদিন চণ্ডি-পাঠ হয়েছে। রাতে হয়েছে পূজার সূচনা পূজা।’ ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থেকেই প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে বাজবে ঢাকঢোল আর শঙ্খ ধ্বনি। সাথে উলুধ্বনি ও আরতি বা প্রদীপ নৃত্য।

দুর্গাদেবীকে প্রণাম করার মন্ত্র:
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।


অনুবাদ:
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অধিষ্ঠিতা, তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।

এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার দিনক্ষণ:

☛ মহাপঞ্চমী ১৬ আশ্বিন, ৩ অক্টোবর ২০১৯ ইং।
☛ মহাষষ্ঠী ১৭ আশ্বিন, ৪ অক্টোবর ২০১৯ ইং।
☛ মহাসপ্তমী ১৮আশ্বিন, ৫ অক্টোবর ২০১৯ ইং।
☛ মহাঅষ্টমী ১৯ আশ্বিন, ৬ অক্টোবর, ২০১৯ ইং।
☛ মহানবমী ২০ আশ্বিন, ৭ অক্টোবর, ২০১৯ ইং।
☛ বিজয়াদশমী ২১আশ্বিন, ৮ অক্টোবর ২০১৯ ইং

দুর্গাপূজা উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। দেখা যায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে পুলিশ-সহ আনসার বাহিনীও। যাতে করে কোনও ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা না ঘটতে পারে। নারায়ণগঞ্জে যাতে পূজা উদযাপন করতে কোনও ধরনের সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসন রাখবে সজাগ দৃষ্টি রাখবে বলে মনে হয়।

0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ