বিশ্ব এখন করোনার দখলে।করোনা সারা বিশ্ব হতে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো বিলীন করার যেন পণ করে বসে আছেন।এমনিতেই বিভিন্ন কারনে অকারনে বিশ্বে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় তারপর যদি মৃত্যুর দূত নিদিষ্ট হয়ে থাকে তাহলেতো আর বেশী দিন বাচা বড় দায় হয়ে পড়ে।কলুষিত বিশ্ব লকডাউনে স্থিরতায় আসতে ব্যাতি ব্যাস্ত।যাই হোক মৃত্যু অবধারিত-নিশ্চিৎ।তবে মৃত্যুটা যদি হয় সু-মরন তবে হাসিবে তুমি কাঁদিবে বিশ্ব ভুবন।

আশির দশকে আমাদের দেশে বা এলাকায় এখনকার মত ঘরে ঘরে টিভি ছিলো না।সারা গ্রাম খুজঁলে দুএকটা অবস্থাশীল ঘরে সাদা কালো টিভি দেখা যেত।তাতেই আমাদের আনন্দের সীমা ছিলো না।অনেকটা রুটিন করে তখন আমরা টিভি দেখতাম।ছয় মাসে তিন মাসে কিংবা মাসে একটি করে বাংলা সিনেমা টিভিতে দেখানো হত।তখন অনেক উৎসাহ উদ্দীপনায় সিনেমা শুরু হবার আগ মুহু্তগুলো কাটতো।

তেমনি মুগ্ধতায় রেখে যাওয়া শতাদিক জনপ্রিয় ছবি’র অভিনেত্রী যাকে আমরা সিনেমার নায়িকা বলেই অভ্যাস্থ কবরী সরোয়ার করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৬/০৪/২১ হাসপাতালে মারা গেলেন।রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি,অসংখ্য ভাল ভাল কাজ।আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং সেই সাথে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ট অবদানের জন্য জানাই লাল সালাম।

আশির দশকে যখন নায়িকা কবরীকে চিনতাম তখন তার দেশ স্বাধীনতার এমন গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা আমাদের অনেকের জানা ছিলো না।যাই হোক মানুষ বেচে থাকতে হয়তো অনেক কিছুই অজানা থেকে যায় যা মারা গেলে অনেকটা প্রকাশ পায়।

আসুন আমাদের নারায়ণগঞ্জ ০৪ আসনের এমপি কবরী সারোয়ার এর বর্নাঢ্য জীবনের কিছুটা অংশ জেনে আসি।

নায়িকা কিংবদন্তী কবরী সারোয়ারের মুল নাম ছিলো মিনা পাল। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই বাঁশখালী চট্রোগ্রামে তার জন্ম।পিতা শ্রী কৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল৷সংস্কৃতি অঙ্গণে তার অভিষেক ঘটে প্রথমে নৃত্য শিল্পী হিসাবে।১৯৬৩ সালে মাত্র তের চৌদ্দ বছর বয়সে সে নৃত্য শিল্পী হিসাবে মঞ্চমুগ্ধ করেন।এরপর ১৯৬৪ সালে প্রথম ছবি করেন “সুতরাং”।সুভাষ দত্তের এই ছবিতে সে নাম ভুমিকায় অভিনয় করে চলচ্চিত্র জগতের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।এরপর হতে মাত্র তের চৌদ্দ বছর বয়সে মিনা পাল নাম বদলিয়ে হয়ে উঠা কবরী’কে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।একের পর এক সাফল্য যেন তার হাতের মুঠোয় আসতে থাকে।

কবরীর চেহারার অববয় সাঁজসজ্জা চালচলন কথাবার্তা অভিনয় তার সব কিছুই ঠিক যেন আবহমান বাংলার অবিকল কিশোরীর মায়ায় ভরা মুখমন্ডল।বাংলার জমিনে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া  প্রকৃতপক্ষে একজন কিশোরী মেয়ে দেখতে যেমন ঠিক তেমনি ভাবে কবরী যেন সোনালী পর্দায় আর্বিভাব হয়ে মানুষের মন কেড়ে নিতেন।অভিনয় শি্ল্পী হিসাবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা এবং সহজাত প্রবৃত্তি তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়।

মাহমুদা চৌধুরী চলচ্চিত্রর প্রবীন সাংবাদিক তিনি বলেন-মিষ্টি মেয়ে” ছাড়াও তিনি “পাশের বাড়ির মেয়ে' হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কারণ তার চেহারায়, আচরণে, অভিনয়ে সেই বিষয়টাই বেশী স্পষ্ট ছিলো। খুব বেশি মেক আপ সে করতো না, এমনকি চুলটাও একদম সাধারণ একটা মেয়ের মত রাখতো। যার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব আপন হয়ে ধরা দিতো।

কবরীকে মানুষ মনে করতো,এই শিল্পীটা তার শিল্পী।তার আত্মার আত্মীয়,ভাল লাগা অনুভুতির কেন্দ্র স্থল।তার অভিনয় দক্ষতা যেমন অনবদ্য ছিলো তেমনি ছিলো তার গ্লামারাস।

ব্যাবসা সফল তার অসংখ্য ছবির মধ্যে  দুই দশকে - রংবাজ,নীল আকাশের নীচে,১৯৭৫ সাধারন মেয়ে, গুন্ডা,সুজন সখী', ১৯৭৮ সারেং বৌ,বধু বিদায়, ১৯৬৫ জলছবি,সাত ভাই চম্পা,বাহানা,১৯৬৮  দর্প  চূর্ণ,কখগঘঙ,বিনিময়,আর্বিভাব,বাশঁরি,যে আগুনে পুড়ি,১৯৭০ এ দ্বীপ নেভে নাই,অঙ্গার ১৯৭৩ এ লালন ফকির,মাসুদ রানা,১৯৭৪ সবিতা”,১৯৭৬ নীল আকাশের নীচে,ময়নামতি,আগন্তুক,আঁকাবাঁকা,কত যে মিনতি,অধিকার,স্মৃতিটুকু থাক,১৯৭৯ আরাধনা,বেঈমান,অবাক পৃথিবী,কাচঁ কাটা হীরা,ছোট মা,উপহার,আমাদের সন্তান,মতিমহল,পারুলের সংসার,দিন যায় কথা থাকে,অরুন বরুণ কিরণ মালা,হীরামন,দেবদাস,অর্নিবান, আমার জন্মভুমি,লাল সবুজের পালা,১৯৮৭ সালে দুই জীবন আপন পর এবং ১৯৭৩ সালে কলকাতার বিশ্বখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে অভিনয় করে বেশ আলোচিত হন ছবিগুলো তাকে ভক্তদের মাঝে অনেক উচু মাত্রায় নিয়ে যায়।এ ছাড়া রাজনীতির ফাকে ২০০৫ সালে “আয়না” নামক একটি সামাজিক অবক্ষয় নির্ভর ছবি তিনি নিজে অভিনয় ও পরিচালনা করেন।

মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সরকারী অনুদানের ছবি “এই তুমি সেই তুমি” ছবির সুটিং শেষ করে যান।২০১৭ সালের বই মেলা প্রকাশিত হয় “স্মৃতিটুকু থাক” তার আত্মজীবনি মুলক একটি বই।

প্রথম বিয়ে ১৯৭৮ সালে চিত্ত দত্তকে ডিভোর্স দেন।এরপর  বিয়ে করেন সাংসদ শামীম ওসমানের চাচা ব্যাবসায়ী শফিউদ্দিন বাবু সরোয়ারকে ।২০০৮ সালে শেষ পর্যন্ত তাকেও ডিভোর্স দেন।বর্তমানে সে পাচ সন্তানের জননী।

ক্যারিয়ার জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সন্মাননা।জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সন্মাননা পুরস্কার সহ মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার,ঋষিজ পদক সহ অসংখ্য পুরস্কার।

মেরিল প্রথম আলো আজীবন সন্মাননা

গুণী এই শিল্পীটি একদিকে সিনেমা জগতের ঈর্ষানীয় কাজ ছাড়াও তিনি ছিলেন প্রচন্ড দেশ প্রেমিক ১৯৭১ এ তুখোর একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে যান।তারপর সে সেখান থেকে কাউকে কিছু না বলে ভারতে পাড়ি জমান। গনমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেন-...

তখনতো আমি আওয়ামীলীগ কিংবা কোন রাজনৈতীক দলের ছিলাম না।একজন সাধারন জনগন হিসেবে একজন সাধারন মানুষ।একজন অভিনেত্রী একজন শিল্পী হিসাবে পাকিদের মানবতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই।তখন পাকিদের এতোটাই ঘৃণা করতাম যে মা বাবা ভাই বোন নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আমি ভাষন দিয়েছিলাম এবং জন সম্মুখে সেই ভাষনের সময় আমি কাঁদছিলাম এই জন্য যে পূর্ব বাংলায় পাকিদের অত্যাচারের নির্মমতা এতোটাই মনে দাগ কাটে যে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম।সে জন্য মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববাসীর জনমত গড়তে দেশের জনগনকে অত্যাচার নির্যাতন ধর্ষন শোষন হতে রক্ষার বর্ননা করতে সেদিন কথার ফাকে আমার চোখে জল এসে পড়ে এবং একটা সময়ে আমি অজ্ঞান হয়ে মঞ্চে পড়ে যাই।আমি আমার এ ভাষনের জন্য আমার জীবনে শেষ পরিনতি কী হবে তাও তখন ভাবিনি।

যতটুকু লোকমুখে জানা যায় সে সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কাজে সহায়তা করার কারনে চট্রোগ্রামে সেই সময়কার দাপুটে সাকা চৌধুরীর পিতা ফকা চৌধুরী কবরীকে ঘেরাও করে বেশ শাষালেও কবরী তার প্রতবাদের হাল ছাড়েনি।

ডয়েচে ভেলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে কলকাতায় গিয়ে সে বিভিন্ন সভা সমাবেশে যোগ দিয়ে বক্তিতা দেন এবং অংশ নেন প্রচুর সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে যে অর্থ আসে তা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কাজে লাগান।বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য উদাত্ত আহবানের যে ভাষনটি তিনি দিয়েছিলেন সেই সময় তার সেই ভাষনগুলো “আকাশবানী” থেকে মাঝে মাঝে বাজানো হত।

দেশ স্বাধীনতায় যে সংগ্রাম তিনি করেছেন তা এদেশের মানুষের মনে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।দেশপ্রেমে এতোটা গভীরতায় মন ছিলো যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলচ্চিত্রের স্বরণীয় অবদান রাখার পরও স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগনকে সাংসদ হয়ে সরাসরি সেবাদানে আত্মনিয়োগ করেন ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে।তিনি সাংসদ ছাড়াও যুক্ত ছিলেন অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে।

সাদাকালো সিনেমার যুগে আমাদের জীবন যাবন ছিলো।শাবানা,কবরী,ববিতা তারা ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়িয়া আমাদের হার্টথ্রব।কবরী তাদের মধ্যে অন্যতম।স্বাভাবিক মৃত্যুতে কারো কিছু বলার নেই অস্বাভাবিক মৃত্যু মনে আফসোসের জন্ম দেয়।করোনা মৃত্যু তেমনি আমাদের জন্য অস্বাভাবিক মৃত্যু।অনেক মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তেও কেউ পাশে থাকতে চাননা।এমন কী লাশটি সমাধিতে কেউ নিতেও চান না।এক সময় কী না ছিলো তার!অর্থে বিত্তে ক্ষমতায়!কত জনের জন্য কত কিছুই না করেছিলেন সে!করোনায় মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে তার পাশে কেউ নেই,কেউ থাকতে চননা-এমন মৃত্যু আমাদের কারো কাম্য নয়।

মৃত্যুর আগে জনদরদী কবরীর কিছু কথা আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে দেশপ্রেম কাকে বলে।

সবাই ভাল থাকুন।সুস্থ থাকুন।স্বাস্থ সচেনতায় জীবন গড়ুন।

ছবি তথ্য এবং ভিডিও
ইউটিউভ ও
দেশের বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম হতে সংগৃহীত।

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ