একুশ আমাদের অহংকার

তৌহিদুল ইসলাম ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ১২:১২:০২পূর্বাহ্ন এদেশ ২৫ মন্তব্য

একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে আসলেই চোখে ভেসে ওঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ মিনার। খালি পায়ে সাদা-কালোতে সজ্জিত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ঢল। বাঙালির আবেগ-অনুভূতির অন্যতম একটি স্থান এই শহীদ মিনার। অনেকের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যে শহীদ মিনারে আমরা ফুল দেই তার রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কিভাবে হলো এটাও অনেকেই জানিনা অথচ মুখে মুখে বলে বেড়াই একুশ আমাদের অহংকার। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে, ভাষা শহীদদের স্মরণ করে ব্যস্ত থাকি যা একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য অবশ্যই লজ্জাজনক।

বাংলাভাষার রক্তাক্ত ইতিহাস-

ভাষা-বিক্ষোভ ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ বঙ্গীয় সমাজে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যার চরম প্রকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগি বিষয়ের পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের দেয়া একটি ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্’র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপ্রতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও বাদ-বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।

২১শে ফেব্রুয়ারি বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ঐ উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে সেসময় নিহত হন। ঐদিন অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছরেরে কিশোরও নিহত হয়। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।

শহীদ মিনার স্থাপনের ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস-

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রজনতার এক বৈঠকে নেতৃবৃন্দ ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই রাতের অন্ধকারেই গুলিবর্ষণের স্থানে নিজেদের নকশা অনুযায়ী ইট দিয়ে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে পুলিশ এ শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেয়। সে জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে প্রথম শহীদ দিবস পালনের জন্য কাগজ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরের দুই বছরও ঐ স্থানে কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে শহীদ মিনারের অভাব পূরণ করা হয়।

প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলার ২ বছর পর ১৯৫৪ সালে নিহতদের স্মরণে নতুন একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সহযোগীতায় বড় পরিসরে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করা হয়। নতুন শহীদ মিনারের স্থপতি ছিলেন হামিদুর রহমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল চত্বরে বড় আকারের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। মূল বেদীর উপর অর্ধ-বৃত্তাকারে সাজানো ৫টি স্তম্ভের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, মা তার শহীদ সন্তানদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কারণে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের মা হাসনা বেগম শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এটিও ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি পুনরায় নির্মাণ করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি -

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পাওয়ার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সাধনা, সংগ্রামের ইতিহাস। কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত The mother language lover of the world সংগঠন ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর, ইউনেস্কো সদর দফতরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া রফিকুল ইসলামকে ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সম্মতিসূচক চিঠি লেখেন, Regarding your request to declare the 21 February as International Mother Language day. The idea is indeed very interesting. এতে Bangladesh National Commission এর পক্ষে সচিব কফিল উদ্দিন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন।

বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো সদর দফতরে পেশ করেন। ইউনেস্কোর ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাব লিখিতভাবে সমর্থন করে। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ঘোষণার পর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে।

২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ- এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি এখন গোটাবিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলায় কথা বলে আমরা হৃদয়ের গভীর থেকে যে প্রশান্তি পাই তার অন্য কোন ভাষায় পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছি, বাংলায় কথা বলার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছি। তাই চলুন শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে একুশকে সবাই মনে ধারণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারির মহত্বকে নিজের আবেগীয় অনুভূতিতে লালন করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। মনে রাখবেন, একজন বাংলাদেশি হিসেবে শোকার্ত একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য গর্বের। রক্তাক্ত একুশ আমাদের অহংকারের।

তথ্যসূত্রঃ
----------

★ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন - রফিকুল ইসলাম।

★ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের একুশে উপর প্রবন্ধ: ভাষা আন্দোলন ১৯৫২। ঢাকা, বাংলা একাডেমি।

★ লেখাটিতে ২১ নিউজ ২৪ এ লেখা একটি আর্টিকেলের কিছু অংশ হুবহু দেয়া হয়েছে। লেখকের নাম পাইনি বিধায় কার্টেসি দেয়া সম্ভব হলোনা। তবে বই এবং নেট ঘেটে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সব জায়গায় একই লেখা পেয়েছি।

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ