একান্ত আমি

সাবিনা ইয়াসমিন ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ০১:৩৩:৪২পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৫ মন্তব্য

অনেক দিন হলো আমি কিছু লিখতে পারছি না। পড়ছি, কিন্তু কি পড়ছি সেটা দেখার জন্য আবারও প্রথম থেকে পড়ে নিতে হচ্ছে।

আসলেই আমি পারছি না। যেন সবকিছু থমকে গেছে, যেন ছন্দপতন হয়ে গেছে সময়ের, আমার!

এলোমেলো-অগোছালো আমিটাকে যতই গোছানোর চেষ্টা করছি ততোই আরও দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে সব।

কিছু কথা, কিছু ব্যাথা, কিছু প্রশ্ন, আর অনেক অনেক বোঝা নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হয়। দাঁতালো কিছু স্মৃতি কামড়ে ধরে রাখে, মুছে ফেলা যায় না। মেরে ফেলারও উপায় নেই, মনে হয় স্মৃতিরা অমর হয়ে জন্ম নেয়। স্মৃতিদের মৃত্যু নেই।

গত সপ্তাহে আমাদের পরিবারের প্রবীণতম সদস্য আমার নানী চলে গেছেন না ফেরার পথে। সকল মৃত্যুই যন্ত্রণার, প্রিয়জনের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠা সহজ কাজ নয়।  নানীর মৃত্যু একইভাবে আমার জন্য যতটা কষ্টদায়ক, তেমনি আমি নতুনভাবে নতুন করে পুরনো অনেক জিনিস হাতে কলমে শিখতে পেরেছি, জেনেছি। আরও উপলব্ধি করেছি নিজস্ব জীবনের প্রতিটি ঘটনা আমাদের যা শেখায় তা অন্য কোথাও থেকে শেখা যায় না।

আমরা যতক্ষণ বেঁচে থাকি ততক্ষণই পৃথিবীটা আমার, আমাকে ঘিরে থাকা সবার মাঝে আমি পৃথিবীর সব কিছু পাই। কিন্তু চিরবিদায়ের সময় কেউই সাথে যায় না, যা কিছু একান্ত আমার বলে জানতাম সেসব কিছুই সাথে দেয়া হয় না। পৃথিবীতে আমার আগমন হয়েছে নিশ্চিত প্রস্থানের জন্যেই,  এটাই একমাত্র সত্যি, রুঢ় বাস্তব।

আমার বয়স কমে যাচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। অথচ আমার জানা নেই  আমার মোট আয়ুর কতটা ফুরালো!

ইদানীং আমি শুধু দেখি। শুধু দেখার জন্য নয়, নিজেকে দেখানোর জন্য দেখি। করোনার প্রভাবে চলমান  জনজীবনে যাকিছু হয়েছিল তার সবই মোটামুটি কেটে গেছে।  মানুষের জীবনে গতি ফিরেছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই মানুষ নিজেদের ছন্দে ফিরে গেছে। শুধু আটকে আছে বাচ্চাদের নিয়মিত পড়াশোনা। ঘরের চারদেয়ালে বন্দি সময় পার করছে আমাদের শিশুরা। অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই আমার ছোট্ট মেয়েটা স্কুলে যেতে চাচ্ছে,নিজের ক্লাসরুমে বসে লেখাপড়া করতে চাইছে। আর আমি অসহায়ের মতো নির্বিকার হয়ে থাকছি।

আজ আমার পাঁচ বছরের ছোট ভাগ্নী আমাকে শোনালো ” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ”,, আমি হতভম্ব হয়ে শুনছিলাম। মনে হয়েছিল এই বুঝি পরের লাইনটা ভুল হবে, অথবা ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে শুনে গেলাম, ওর গানে কোথাও ভুল হচ্ছিলো না। পরম মমতায় যথাযথ মর্যাদা দিয়েই ও গানটি গেয়েছে। এটা ওকে ওর স্কুল থেকে শিখিয়েছে, ওর মা ওকে অনুপ্রাণিত করেছে। শিশুরা শিখতে চায়, বুঝে শুনে সেসব শিক্ষার অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হলো সব স্কুলে শিশুদের শিক্ষার্থী ভাবা হয় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চাগুলোকে জাস্ট তোতা পাখি মনে করে। কিছু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে বছর টপকে দেয় পাসের সার্টিফিকেট দিয়ে। প্রকৃতি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

খবরের কাগজ পড়ি না বহুদিন হয়ে গেছে। টিভি খুললেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একের পর এক দুর্ঘটনার ভয়ালচিত্র, দুঃসংবাদ। শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, কে রাখে তার খবর! ছোট্ট শিশুর লাস পড়ে থাকে পানির ট্যাংকে অজ্ঞাত পরিচয়ে, শহীদ মিনারের পাশে পড়ে রয় কিশোরীর নিস্প্রাণ দেহ! অভিমান-আত্মগ্লানীর সব বেদনার অবসান ঘঠাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তরতাজা জিবন্ত মানুষেরাও। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার মাসে নিরবে কত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে বিনা বিচারে অন্ধকার কারাগারে, কেউ কি শুনতে পায় তাদের বিদেহী আত্মার আর্তনাদ? দেশ স্বাধীন হয়, জাতি স্বাধীনতা পায়, কিন্তু মানুষ?  মানুষ কি প্রকৃতঅর্থে স্বাধীন হতে পারে?

সবই দেখি, নিজেকে দেখাই, ভুলে যাই বারবার মনে না রাখার ব্যর্থতায়..।

 

* ছবি- আমার।

0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ