১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী সবচেয়ে সক্রিয় দল ছিল এই জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। এ দলটি সচেতনভাবে মধ্যে শুধু বিরোধিতাই করেনি বরং তাঁর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘকে (পরবর্তীকালে যার নাম রাখা হয় ইসলামী ছাত্র শিবির) নিয়ে পাকিস্তান রক্ষার জন্য একটি সশস্ত্র দল পর্যন্ত গঠন করে।

সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের এদেশে তাদের হত্যা, ধ্বংস,লুট ও নারী ধর্ষণকে এরা শুধু সমর্থন, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাই করেনি তার সাথে সাথে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের এরাই নির্বিচারে ধরে এনে অমানুষিকভাবে হত্যা করে এবং গনিমতের মাল বলে হাদীসের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বাঙালি মেয়েদের জোর করে ভোগ করাকে সিদ্ধ ঘোষণা করে।

কিন্তু আদর্শবাদের নামে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের এই নিষ্ঠুর পৈশাচিক আচরনের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, এটা তাদের জন্য মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ যে আদর্শবাদে এ দলটি সংগঠিত, তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এ জাতীয় ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ। তাই ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলাম, গোলাম আযম ও মাওলানা মওদুদীর ভূমিকার স্বরুপ বোঝার জন্য ইসলাম ধর্ম নিয়ে তাদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে পাঠকের ধারণা থাকা প্রয়োজন।

জামায়াতে ইসলামের জনক মাওলানা মওদুদী তাঁর প্রচারিত আদর্শে কথাই বারবার প্রকাশ করেছেন যে অস্ত্র ছাড়া আদর্শ কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থেও এই মত প্রকাশ করেছেন যে, তলোয়ারের জোরে ইসলাম দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দাওয়াতে নয়।

ইসলাম সত্য ন্যায় ও সাম্যের আদর্শ। বস্তুত দেশে দেশে, কালে কালে ইসলাম সাধারন মানুষের কাছে যে গৃহীত বা আদৃত হয়েছে তা ওই আদর্শেরই গুনে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামের জনক মাওলানা মওদুদী ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে কোন গুন ব্যাখ্যা করেন, তা মূলত পাশ্চাত্যের ইসলাম-বিরোধী লেখকদের প্রতিধ্বনি মাত্র।

১৯৫৩ সালেও মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামী আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে পাকিস্তানি আহমদীয়া সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। আইয়ুব খানের আমলে বিচারপতি মুনীর ও বিচারপতি কায়ানীর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারকরা এজন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে মানবিক কারণে মওদুদীকে ক্ষমা করা হয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর দ্বারা জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় তা কোনদিনও পূরণ হবার নয়।

মওদুদীবাদীর এই আদর্শ যেই গ্রহণ করেছে সেই এই ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়েছে। আজো এই মতবাদীদের মধ্যে লক্ষণীয় ব্যাপারটি হলো এই যে, যে ইসলামের জন্য তারা এতো উন্মাদ, সেই ইসলামের অনুশাসন যে তারা নিজেরা খুব একটা মেনে চলেন এমন নয়। বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী আপন দেশের মুসলমান বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র প্রয়োগ করে তা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরপরই তারা যে অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ে তাও কিন্তু নয়। অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা থেকে এর মজুদকরনের কাজ তারা অনেক আগে থেকেই করছিল। এমনকি এ কথা তারা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছিল।

১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর করাচিতে মাওলানা আবু আলা মওদুদী হজব্রত পালনে মক্কা যাওয়ার পূর্বে কর্মীদের এক সমাবেশে বলেন - সমাজতন্ত্রীদের মোকাবেলার জন্য জীবন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে হবে। মাওলানা মওদুদী এদিন শেখ মুজিব ও মাওলানা ভাসানীকে দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করেন। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ প্রদান করে বলেন বল প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে বিপ্লব করতে চাইলে জামায়াত শক্তি দিয়ে শক্তির মোকাবেলা করবে।

১৯৭০ সালের ২ এপ্রিল মাওলানা মওদুদী লাহোরে সমাজতন্ত্রীদের প্রতিরোধ করার জন্য দেশের সর্বত্র স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি তার দল জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বক্তৃতা করছিলেন। জামায়াতে ইসলামের মিত্র সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের মজলিস-এ-আমল এর নেতা সাহেবজাদা ফয়জুল হাসান সমাজতন্ত্রীদের প্রতিরোধ করতে দুই লাখ লোকের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার ঘোষণা দেন।

এসব বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালে হঠাৎ করেই গঠিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, জামায়াতে ইসলামের এই বিষয়ে পূর্ব-মানসিক ও বৈষয়িক প্রস্তুতি ছিল। ১৯৭১ সালে তার চূড়ান্ত ও চরম প্রকাশ ঘটে মাত্র।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলাম, মাওলানা মওদুদী ও তার একনিষ্ঠ শিষ্য অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন বিতর্কিত এবং বিভিন্ন মহলের কাছে অজস্র প্রশ্নের উৎস স্বরূপ। এমনকি পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেমরা পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ডকে ইসলামের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন। আলেমরা বলেছেন, মওদুদীর ইসলাম ও রাসুলের ইসলাম এক নয়। মওদুদী মূলত তার নিজের স্বার্থে ইসলামের নাম ব্যবহার করছেন। অনেকে মওদুদীকে কাফের বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন।

(চলবে.....)

তথ্যসূত্রঃ

★ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
★ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পত্রিকা সংকলন।
★ স্বাধীনতার দলিল (২য় খন্ড)

লেখার কিছু কিছু অংশ তথ্যসূত্রে উল্লেখিত বইগুলি থেকে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। কারন ইতিহাস মনগড়া নিজের মত করে কিংবা বানিয়ে লেখা অনূচিত বলে মনে করি।

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ