"সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে”

... নিজ আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দের কাছে কথাটা বলেছে নরপিশাচ, রাজাকার কামারুজ্জান।
হুম, এই একটা কথায় আমি ওর সাথে সহমত, কড়াভাবে সহমত। ঠিকই তো !! সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলেই, শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ নিরীহ বাঙালিদের হত্যার নির্মম সত্য ৪৪ বছর পরে উন্মোচিত হয়ে ওর ফাঁসি নিশ্চত হয়ে গিয়েছে।
সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলেই, সোহাগপুর গ্রামে ওর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১৬৪ জন পুরুষকে হত্যা এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করার বিচার আজকে হচ্ছে।
সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলেই, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে ওর নেতৃত্বে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও হত্যার যথার্থ বিচার হচ্ছে।
সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলেই, শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করার মতো নির্মম সত্যটির জন্য ওর ফাঁসি হবে।
চলুন দেখে নেয়া যাক কামারুর অপরাধসমূহের বিস্তারিত বিবরণঃ-
ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামারুজ্জামান। শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ নিরীহ বাঙালিদের ধরে আনার নির্দেশ দিতেন এবং হত্যা, নির্যাতন চালাতেন তিনি।
এছাড়া শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে তার পরিকল্পনা ও পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১৬৪ জন পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। সে ঘটনার পর থেকে সোহাগপুর গ্রাম এখন ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। এ কারণে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জন্যও দায়ী কামারুজ্জামান।
সব মিলিয়ে গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা, ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ দায় কামারুজ্জামানের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করেন প্রসিকিউশন।

১. বদিউজ্জামানকে হত্যা
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
২. অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।
৩. সোহাগপুর গণহত্যা
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে। এটি কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে করা হয়। সেদিন ওই গ্রামে নাম জানা ৪৪ জনসহ ১৬৪ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।
৪. গোলাম মোস্তফাকে হত্যা
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে কামারুজামান ও আলবদররা তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
৫. লিয়াকত-মুজিবুরকে নির্যাতন ও ১০ জনকে হত্যা
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দু’জনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ ৩ জনকে সরিয়ে নিয়ে ১০ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
৬. টুনু হত্যা
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৭. দারাসহ ছয় হত্যা
সপ্তম ও শেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান কামারুজ্জামান আলবদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারিতে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আলবদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।

সময়টা ২০০৬। কামারুপুত্র ওয়ামি মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দিয়ে, স্বাধীনতাপক্ষের ব্লগারদের বলেছিলো-

“পারলে টেরাবুনাল বানাইয়া আমার বাপেরে ঝুলাইস”...

এখন সময়টা ২০১৫। সেই ওয়ামিই মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে পিতা কামারুর ফাঁসি হবার পর সেই মৃতদেহ দাফনের স্থান নিয়েই আছে বড্ড চিন্তায়। ওর জবানিতে-

"শেরপুরে যে জন্য না করা হচ্ছে একই সমস্যা তো অন্যসব জায়গাতেও আছে। আর যেখানেই হোক বাংলাদেশেইতো দাফন করতে হবে। এছাড়া আব্বুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া ছাড়াতো আর উপায় থাকবে না”...

ইতিহাস হল সময়ের হিসেব।ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের হিসেবটা অতন্ত রক্তাক্ত।তাই যখনই সেই ইতিহাসের হিসেবের খাতার পৃষ্ঠাগুলো উন্মোচন করে, তখন সুকান্তের একটা কথা মনে পরে-

“হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে,দেখেছি লিখিত রক্ত খরচ তাতে...”

মানুষ মরে যায়, পচে যায়, নিঃশেষ হয়ে যায় একসময়।কিন্তু ইতিহাসের কোন মরণ নেই,কোন শেষ নেই।ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে নাহ্‌।আর সেজন্যই তো দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি এক রাজাকারের ছেলের দম্ভোক্তির উচিৎ জবাব মাত্র ৯ বছরের মাথায়, আর রাজাকারটার বিচার দেখতে পাচ্ছি ৪৪ বছরের মাথায়...

0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ