মৃত শিউলীর ঘ্রাণ (একটি সত্যি ঘটনা)

নীলাঞ্জনা নীলা ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, রবিবার, ০৫:০৮:৪৭পূর্বাহ্ন গল্প ৩৬ মন্তব্য

আবারও পুজো চলে আসছে। বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। উঠোনের শিউলী গাছটা ভরে উঠেছে ফুলে ফুলে। একরাত্রির জীবন, অথচ কি নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে হেসে উঠছে সবুজ পাতাকে আড়াল করে। রবীন্দ্রনাথের দুটো গান বৃত্ত খুব গাইতো। বিশেষ করে শিউলী ফুল ফোঁটা শুরু করলেই। "ওলো শেফালি, ওলো শেফালি, আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি...", আরেকটা "আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে...।" সুদীপা দেবী হেসে উঠতেন, বৃত্তর গান শুনে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়লো গান দুটোর কথা মনে করে। বয়স যতো বাড়ে, দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যাও কি বেড়ে চলে? তিনতলার ছাদে দাঁড়িয়ে একা একা এসব কথাই ভেবে চলছেন সুদীপা দেবী। এ জীবনে যতো ধরণের যুদ্ধ করেছেন, হাসিটুকু ম্লান হতে দেননি কখনো। এই বিশাল বাড়ীর একটা কোণে আশ্রয় পেয়েছিলেন স্বামী-সন্তান নিয়ে। অর্থনৈতিক কষ্ট মেটাতে হাতের কাজ করতেন। সন্তানদের কখনও এতোটুকু অভাবও পেতে দেননি। স্বামীর ছোট্ট একটা ফটোগ্রাফির দোকান ছিলো, চলতোই না বলতে গেলে। যেদিন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন স্বামী দিব্যেন্দু, সেদিন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লেও শক্ত ছিলেন। এই হাসিটুকুই সবসময়, সব অবস্থায় কঠিন বাধা অতিক্রম করাতে সাহায্য করে গেছে। ঈশ্বর সবকিছু কেড়ে নেয়না, অনেক কিছুই পাশাপাশি দিয়ে থাকে। আর এই বিশ্বাসটুকু সবসময়ই ছিলো সুদীপা দেবীর।

চার সন্তানের মা তিনি। দেখে বোঝাই যায়না। দুই ছেলে, দুই মেয়ে এতোটাই ভালো যে, এলাকায় কখনোই কোনো সমালোচনা হয়নি কাউকে নিয়ে। বিশেষ করে বড়ো সন্তান বৃত্ত, কতো মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ যে সে। কিন্তু কখনোই কারো সাথে স্ক্যান্ডাল তৈরী হতে দেয়নি। কেউ যদি কোনো মেয়েকে বিরক্ত করতো, প্রতিবাদ করতো সবসময়। বৃত্ত বড়ো মা ন্যাওটা। আর এতো কিছুর মধ্যে সন্তানদের মুখের দিকে চেয়েই সমস্ত কষ্ট-যন্ত্রণা হজম করে নিতেন সুদীপা দেবী। স্বামী দিব্যেন্দু অসুস্থ, তাও মাথার উপর তো একটা ছায়া হয়ে তো আছেন। এটাই তাঁর শক্তি। জানতেন, যে কোনোদিন এই শাঁখা-সিঁদুর মুঁছে যাবে, তাও ভাবতে চাইতেন না। একদিন ঠিকই পৃথিবীর মোহ-মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন দিব্যেন্দু। বৃত্তর আব্দারে রঙিন শাড়ী পড়লেও, মনের ভেতর যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো, তা আর ভরে ওঠেনি। সুদীপা দেবীর হাসি শুধু মুখ জুড়ে নয়, চোখও হেসে উঠতো। আজও হাসি আছে, কিন্তু চোখ আর হেসে ওঠেনা। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননা তিনি। ভেবেছিলেন এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেবেন। বৃত্ত যেদিন চাকরী পেলো, তিনতলার ওই ছাদের ঘরে পাঁচ জনের ওই সংসারে কি যে এক আনন্দ উৎসব! বড়ো মেয়ে শমিতার বিয়ে হলো। বিদায়ের সময় সুদীপা দেবীর চোখে জল, কিন্তু সেটা স্বস্তির এবং আনন্দের। ওইটুকুন ছেলে আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে, দায়িত্ব নিয়েছে পুরোটা পরিবারের। আর কিসের চিন্তা! দুঃখের দিন শেষ। এখন যদি তাঁর মৃত্যুও হয় বৃত্ত তো আছে। আফসোস দিব্যেন্দু দেখে যেতে পারলেন না।

সেদিন বৃত্ত অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে বসলো। মা-ছেলের গল্পকথা ওই সময়েই চলে। সুদীপা দেবী জানতে চাইলেন,

---কি রে তুই বিয়ে করবি কবে?
---মা, কি যে বলো না! ওসব বিয়ে-টিয়েতে আমি নেই। স্বস্তির অনার্স প্রায় শেষ। ও মাষ্টার্স পড়বে। আমায় বলেছে চাকরী করবে, আগেই যেনো ওর বিয়ে নিয়ে না ভাবি।
---বাহ দুই ভাই-বোন দেখি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিস, আমায় বুঝি জানানোর প্রয়োজন নেই?
---আরে মা, হাসি-হাসি মুখ নিয়ে মানুষ এতো অভিমান করতে পারে, তোমায় না দেখলে জানা ছিলোনা। শোনো স্বস্তিকে আজই বলেছিলাম সকালে ছেলে কি পছন্দ আমরা করবো নাকি ওর নিজের পছন্দে কেউ আছে। ও এমন করে বললো, তোমায় জানানোর সময় ছিলোনা। অফিস চলে গেলাম।
---পাগল রে মজা করেছি। তুই দায়িত্ব নিয়েছিস, আমার তাতেই শান্তি। দৃপ্তকে দেখে রাখিস, এই বয়সটা খুবই মারাত্মক। পড়তেই দেখিনা, ইন্টার যে কিভাবে পাশ করবে, কে জানে!

সুদীপা দেবী নিজেকে একজন সুখী মা হিসেবেই জানেন। আজকাল মায়েদের দেখা যায় কতো দুঃশ্চিন্তা সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু তিনি একেবারে নিশ্চিন্ত। তাইতো উনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর কোনো না কোনোদিক থেকে পরিপূর্ণ করে দেয়। স্বস্তি সরকারী প্রাথমিক স্কুলে চাকরী পাবার পর আরেক আনন্দ। স্বস্তি তার মাকে স্বস্তির শ্বাস এনে দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিলো। ভালো একটি ছেলের সাথে বিয়ে হবার পর সুদীপা দেবী আবার একা। ছোট্ট এই ঘরটায় একসময় জায়গা হতোনা। দুটো রুমে দুই বিছানা, আর নীচেও বিছানা পেতে ঘুমাতে হতো। আর আজ খাঁ খাঁ করছে। বৃত্ত বা দৃপ্তর তেমন আব্দারও নেই, তবুও চেষ্টা করেন ভালো কিছু রান্না করতে। রান্নাও বেশী সময় লাগেনা। "নাহ, আজই বৃত্তকে বলতে হবে এখন বৌ নিয়ে আয়। একা একা এভাবে একটুকুও ভালো লাগেনা..." স্বগতোক্তি করলেন সুদীপা দেবী। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে স্নান সেরে খেতে বসলো তিনজন।

---একটা কথা বলবো। আজ কিন্তু কথাটাকে ফেলে দিস না।
---কি মা? বলো!
---এবারে বিয়ে কর। আমার বড়ো একা লাগে রে।
---তোমার একা লাগে তাই বিয়ে করবো? মা কোনো মেয়ে যদি এটা শোনে আমায় ধরে পেটাবে। বিয়ে তো দূরের কথা!
---হাসিস না। দেখ আমার শরীরটা ভালো না। কখন, কি হয়ে যায়! তোর বাবা কিছুই দেখে যেতে পারেনি। তুই কি চাস আমিও...!
---মা প্লিজ চুপ করো! ঠিক আছে তুমি মেয়ে দেখো। যাকে বলবে বিয়ে করবো। কিন্তু এভাবে বলোনা আর। এই দৃপ্ত কাল সকালেই মাকে ডাক্তারে নিয়ে যাস তো! এখন তো কলেজে ক্লাশ নেই তোর।

দৃপ্ত মাথা দোলালো। সুদীপা দেবী বলে উঠলেন, "আমার কিছু হয়নি। এমনি বলেছি তোর কথা নিতে!" মুখ চেপে হাসলেন। ওদিকে দৃপ্ত খুব খুশী দাদা বিয়ে করবে, বৌদি আসবে। "কি রে মুচকি হাসি কেন?" দৃপ্ত বলে উঠলো, "বাহ খুশী হবো না! বৌদি আসবে।" সেদিন এই খাবার টেবিলে একটা ছোট্ট-খাট্টো উৎসব হয়ে গেলো। সুদীপা দেবী রাতে শমিতা আর স্বস্তিকে ফোন দিয়ে জানালেন। মিষ্টি একটা মেয়ে পেয়েও গেলেন। বরবেশে বৃত্ত যখন বের হলো, সেই সময় নিয়ম আছে মায়েরা সন্তানকে দেখতে পারেনা। মায়ের নাকি দৃষ্টি লাগে। তার আগেই বৃত্তকে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে সরে এলেন। ভাবনায় পেয়ে বসলো পুরোনো দিন। এইতো সেদিন বৃত্ত গর্ভে এলো। খেতেই পারতেন না তখন সুদীপা দেবী। খেতে গেলেই বমি। শুধু কি তাই! কথা বলতে গেলেও বমি চলে আসতো। সাধারণত গর্ভস্থ শিশুরা বেশ দাপাদাপি করে পেটের ভেতর, বৃত্ত ছিলো খুবই শান্ত। অনেকেই বলতো মেয়ে হবে। জন্মের পর ছেলের মুখ দেখে এক নতূন জীবনের পথে যাত্রা শুরু করলেন। এখন সুদীপা দেবী একজন মা। বৃত্ত আস্তে আস্তে কথা বলতো, খুবই শান্ত। ছোট্ট ওই মফঃস্বল শহরে বৃত্তকে ভালোবাসতো না এমন কেউ নেই। সেই ছেলেটা আজ নতূন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। "হে ভগবান বৃত্তকে কখনো কষ্ট দিওনা। আমার এই লক্ষ্মী ছেলেটাকে কষ্টহীন জীবন দিও..." ঠাকুর ঘরে বসে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছিলেন। সেদিন চোখ ভরে জল গাল বেয়ে নেমে এসেছিলো আনন্দে। বড়ো মেয়ে শমিতা মাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ঠাকুর ঘরে এসে দেখে মা কাঁদছে। "কি হয়েছে মা? কাঁদছো কেন?" দু'দিকে মাথা দুলিয়ে বললেন,

---কান্না না রে, এ আমার আনন্দ। দৃপ্তকে নিয়ে চিন্তা নেই। তোরা সবাই দাঁড়িয়ে গেছিস। আজ আমি নিশ্চিন্ত।
---মা দাদাকে রওয়ানা করিয়ে দিয়েছি। তুমি তো কিছু খাওনি, এখন খেয়ে নাও।
---না রে বৃত্তর বিয়ে শেষ হলে খাবো। তোরা খা।

মনের মতো বৌ পেয়েছেন সুদীপা দেবী। বৃত্তর সাথে একেবারে মিলে গেছে। বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ হবার পর নন্দিনী বাবার বাড়ী গেলো। অনার্স পরীক্ষা শুরু, শেষ করেই চলে আসবে। নন্দিনী বাবার বাড়ী গেছে দশদিন হলো। সুদীপা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, "এই তুই কি মা রানীর সাথে কথা বলিস? শোন মেয়েরা সবকিছু ছেড়ে চলে আসে, তার আবেগকে যত্ন করিস বাবা।" সেদিনই ওই বুধবার রাতে বৃত্তকে বললেন সুদীপা দেবী, শনিবার কি ছুটি নিতে পারবে সে? "তোর মাসীবাড়ী যাবো রে একটা দিনের জন্য। আমায় নিয়ে যাবি?" শনিবার দুপুরে ফিরে এসে বৃত্ত বললো,
---মা মাথাটা খুব ব্যথা করছে। বমি আসছে।
---একটু চোখ বুজে থাক, আমি চুল টেনে দিচ্ছি। তোর মাসী অনেক পিঠে-পায়েস করেছে, সেসবে হয়তো এসিডিটি হয়ে গেছে। চুপ করে থাক। একটু ঘুমিয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
---মা, আমায় একটু জল খাওয়াবে?
---তুই উঠিস না, আমি জল নিয়ে আসছি।

সুদীপা দেবী এসে দেখেন বৃত্ত ঘুমে। আর ডাকেননি। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আবার রুমে এসে দেখেন এখনও ঘুম। পাশে জলের গ্লাস ভরা। আস্তে আস্তে ডাকলেন, "বাবা রে ওঠ জলটা খেয়ে নে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ওঠ!" এতো গভীর ঘুম তো বৃত্তর ছিলোনা কখনো! গিয়ে হাল্কাভাবে ধাক্কা দিলেন, সারাটা শরীর বরফ। কে বলে বাবার কাঁধে পুত্রের লাশ সবচেয়ে ভারী বস্তু! দশটি মাস গর্ভে ধারণ করে সেই সন্তানের নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়া শরীর দেখে মায়েদের কি অবস্থা হয়, সে মা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারেনা। পরেরদিন খবর আসে নন্দিনী ট্রেনের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনটি বছর হয়ে গেলো, আবারও পুজো। বৃত্তর জন্ম শরতে, মৃত্যু শরতে। সুদীপা দেবীর ভগবান তাঁর প্রার্থনা রেখেছে, বৃত্তকে কষ্ট না দিয়ে নিয়ে গেছে।

**বৃত্ত  নামের ছেলেটি আমার এলাকারই একটা ছোট ভাই। আমার চোখে দেখা ভালো একজন মানুষ। ভালো মানুষদের ঈশ্বর নিয়ে যায়। সুদীপা কাকীমনির সেই হাসি এখন কেমন চোখে দেখিনি। তবে গতকাল মামনির থেকে শুনেছি। কাকীমনি নাকি বলে, মায়ের সামনে থেকে মৃত্যুদূত সন্তানকে নিয়ে যেতে পারেনা। তাই জল নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিলো, ওই ফাঁকেই মৃত্যুদূর বৃত্তর আত্মাকে নিয়ে চলে গেছে।

**এখানে সবকয়টি ছদ্মনাম। ইচ্ছে করেই ব্যবহার করেছি। তার কারণও আমি বলবো না। শুধু প্রার্থনা করি কাকীমনি ভালো থাকুক। বড়ো প্রিয় একজন মানুষ আমার। আর বৃত্তকে দেখি যখন ও হাইস্কুলে পড়ে। আদরের একটা ভাই, এতো মিষ্টি করে দিদিভাই বলে ডাকতো। এই মায়া কেন যে পেলাম, খুব কষ্ট হচ্ছে। লিখতে আর পারছিনা। ভালো থেকো রে ভাই ওই পৃথিবীতে।

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ইং।

সুন্দরতম মৃত্যু...
সুন্দরতম মৃত্যু...

0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ