জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...

অনেকটা সময় পার করে এসেছি। সেই কোথায় ১৯৯০ সালে একাদশ বর্ষে ভর্তি হয়ে কলেজ জীবনের এক নতূন রোমাঞ্চকর সময়ের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করা। আমরা সে সকলেই জানি। আমাদের কমলগঞ্জ কলেজটা এমন আহামরি কিছু না, কিন্তু ওখানের ছাত্র-ছাত্রী বন্ধুত্ত্ব, সৌহার্দ্য সত্যি অন্যরকম। অতিরিক্ত স্নেহ-মায়া-আদর নাকি চরিত্র নষ্ট করে ফেলে। অথচ আমাদের শিক্ষকদের অত্যাধিক স্নেহ কখনোই কাউকে নষ্ট হতে দেয়নি। কথা না বাড়িয়ে আসল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

বিশ্বজিৎ স্যার - স্যার আমাদের রসায়ন ক্লাশ নিতেন। স্যার কথা বলতেন হবিগঞ্জ আর সিলেটের মিশ্র ভাষায়। যেমন "অতলা অক্সিজেনে অতলা হাইড্রোজেন মিলাইলে পানি হয়।" আবার প্রশ্ন করতেন এভাবে, "কতলা অক্সিজেনে কতলা হাইড্রোজেন মিলাইলে পানি হয় কওসাইন? স্যারের এই "কতলা" শব্দটা খুব দারুণ লাগতো আমার কাছে। স্যার যেমন আমায় খুব স্নেহ করতেন, তেমনি উনার স্ত্রীও আমায় যথেষ্ট ভালোবাসতেন। প্রায়ই ম্যাডাম আমাদের বাসায় আসতেন উনার তিন মেয়েকে নিয়ে। ম্যাডাম খুবই হাসিখুশী। ম্যাডামের কথা বলার কারণ উনাদের দুজনের দারুণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিলো। যাক বিদায়ী সম্বর্ধনা হলো আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলাম আর আধুনিক। আসলে আধুনিক গানে আমার পছন্দ ক্লাসিক্যাল টাইপ, তো একটা গান গেয়েছিলাম অনুপ জালোটার গাওয়া "ভরে না তোমায় দেখে দেখে মন, আকাশের মতো বদলায় রঙ।" এসব গান কি আর কারো ভালো লাগে? হয়ে গেলাম থার্ড। স্যার সেদিন সন্ধ্যার সময় বাসায় এসে খুব গরম। "কই গাইবে মন মানেনা দিল দিওয়ানা টাইপ গান, তাইলে প্রথম হইবার পারতে।" আমি বললাম স্যার আমায় দিয়ে ওসব গান হয়না।

যাক একদিন ল্যাবরটরীতে প্রাক্টিক্যাল ক্লাশ চলছিলো। আমার আবার কৌতুহল একটু বেশী। একেকটা টিউব ধরে দেখছি, গন্ধ নিচ্ছি। লাফিং গ্যাস হাতে নিয়ে বললাম স্যার আসলেই কি এর গন্ধ নিলে হাসি আসে? স্যার বললেন, "নীলাঞ্জনা রাখ ওইটা। ধরিস না।" রেখে দিলাম। তারপর একটা আলাদা কোণায় সরিয়ে রাখা টিউবটা ধরে দেখছি, স্যার সেটা দেখে দৌঁড়ে এলেন। ওটা ছিলো সালফিউরিক এসিড, বোতলের গায়ে নাম ছিলোনা। কারণ আগেরদিন যখন নিয়ে আসা হয়েছিলো তখন কলেজ বন্ধ হয়ে যাবার সময়, তাই নাম লেখা স্টিকার লাগানো হয়নি। স্যার শুধু বললেন প্রাক্টিক্যাল ক্লাশ করতে এসেছি, সব না গোছানো পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। বুঝে গেলাম স্যার বেশ রাগে আছেন। অবশ্য স্যারের রাগের স্থায়ীত্ত্ব খুবই কম।

স্যার আমাকে বাসায় পড়াতে আসতেন। উনি কিন্তু আর কারো বাসাতেই পড়াতে যেতেন না। স্যারের এসিডিটির সমস্যা ছিলো, উনি তেলে ভাঁজা টাইপ কিছু খুবই কম খেতেন। তাও মাঝে-মধ্যে। স্যারকে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে বানানো হতো। আর স্যার অনেক ফ্রী ছিলেন আমাদের পরিবারের সকলের সাথেই। তবে স্যারের প্রিয় ছিলো শুকনো মুড়ি। মাঝে-মধ্যে চানাচুর দিয়ে মেখে দেয়া হতো। আমাদের বাসায় সাধু বুড়া নামে একজন ছিলো(এই বুড়োর অনেক গল্প একদিন বলবো। শুধু জানিয়ে রাখি আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই বুড়ো আমাদের বাসায় ছিলো।), উনি-ই স্যারকে খাবার এনে দিতেন। আমি একদিন পাশের কুমকুম আপার বাসায় গেছি বিকেলের দিকে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখনও ফিরিনি। চাচী আমায় খাবার না খাইয়ে ছাড়বেন না। যাক আমাদের বুড়ো সেদিন আমায় ডাকতে গিয়ে বললো, "নীলা চলো চলো মুড়ি স্যার আসছেন।" আমি বললাম মুড়ি স্যার মানে? যখন মামনিকে বললাম পুরো বাসায় হাসতে হাসতে...। অবশ্য স্যারও জেনে গিয়েছিলেন সাধু বুড়া উনায় মুড়ি স্যার বলে সম্বোধন করেন। কখনোই তিনি রাগ করেননি।

জীবনে অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি এবং অনেক অন্যায় না করেও শাস্তি পেয়েছি। তবে সততার পথে বাধা আসে, কিন্তু অবশেষে জয়ী হয় সততাই। আমাদের ইন্টার পরীক্ষার সময়। সেদিন চলছে ইলেকটিভ ম্যাথ পরীক্ষা। বিশ্বজিৎ স্যার রোজই পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে আমায় বলতেন "নীলাঞ্জনা শুন যে হারে নকল চলের, সিটে যখন বইবে সবদিক খেয়াল করে বইস। আর শুন কোনো কাগজ-টাগজ যদি পায়ের কাছে পড়ে সাবধান ওইদিকেও চাইবে না। বুজছস?" 'পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে'ই। কেউ একজন নকল ঢিল দিচ্ছিলো অন্য কাউকে, আমার পায়ের কাছে এসে পড়লো। বলদের মতো হাতে নিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম, অমনি জজসাহেব এসে গেলেন। এসেই আমার পেপার নিয়ে গেলেন আর পরিদর্শক শিক্ষককে বেশ কড়াভাবে বললেন আমার পেপার যেনো বাতিল করে দেয়া হয়। ওদিকে বিশ্বজিৎ স্যারের কানে কথা চলে যেতেই, তিনি দৌঁড়ে এলেন। প্রথম উনি-ই বলেন জজসাহেবকে, "নীলাঞ্জনা কুনু সময় নকল এইটা অসম্ভব!" আর ওদিকে আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি, কি বলা উচিৎ, বা কি করা উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না। এমন একটা মোচড় দিচ্ছিলো মনের ভেতর, আমি একরকম অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের পল্লব স্যার, রায়হান স্যার, প্রিন্সিপাল স্যার, মঞ্জুশ্রী ম্যাডাম, মোহন স্যার, সুনীল স্যার সবাই এসে বললেন একই কথা। অন্য যে কাউকে বললে উনারা বিশ্বাস করবেন, কিন্তু আমায় নিয়ে কিছুতেই না। পরীক্ষার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, আমি পাথরের মতো দাঁড়ানো। বিশ্বজিৎ স্যার হঠাৎ আমায় দেখে এসে ধাক্কা দিলেন, "ওই যা নিজের কথা কইয়া আয়।" না পারছিলাম কাঁদতে, না কিছু একধরণের অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম। ওই সময় স্যার আমার হাতটা ধরে জজসাহেবের সামনে নিয়ে গেলেন আর বললেন, "স্যার আপনে তো অনেক নকলিষ্ট দেখছেন, নীলাঞ্জনারে দেখেন তারপর কইনছাইন হেরে কি লাগেনি নকল করার মতো মেয়ে?" অবশেষে পেপার ফিরে পেয়েছিলাম, একটি ঘন্টা পেপার সামনে নিয়ে বসেছিলাম। কিচ্ছু লিখিনি। পাশ করেছিলাম। পরীক্ষার পর স্যার এসেছিলেন বাসায়। আরেকবার এসেছিলেন রেজাল্টের পর। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন তারপর চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম মন খারাপ হয়েছিলো আমার রেজাল্ট দেখে। কিন্তু কারুরই তো আর কিচ্ছু করার ছিলোনা।

আজও মনে পড়ে স্যারের উদাত্ত কন্ঠে কথা বলা এবং হাসি। এমন কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই যে স্যারকে ভালোবাসতো না। শুনেছি তিনি এখন তেলিয়াপাড়ার কোনো এক কলেজের অধ্যক্ষ। স্যার ভালো থাকুক, অনেক ভালো। আমি জানি উনি যে কলেজেই থাকুক না কেন, সকলেরই ভালোবাসা পাবেন নিশ্চিত।

ক্রমশ 

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ইং।

রায়হান সেলিম স্যার (এক) – যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন : অষ্টম ভাগ

রায়হান সেলিম স্যার (দুই) – যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন : নবম ভাগ

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ