বাবার সাথে ঈদ

রোকসানা খন্দকার রুকু ২২ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮:০০পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

ঈদ করেছি বহুকাল আগে বাবার হাত ধরে। তারপর তাকে ছাড়া ১৫টি ঈদ; অন্যদিনের মতোই। তোমরা বাবারা কেন  বুঝতে চাও না বিশেষ দিনগুলোতে মেয়েরা সবচেয়ে বাবাকেই মিস করে, ফিল করে। ভীষন ইচ্ছে করে তোমাদের সাথে স্পেশাল মোমেন্ট কাটাতে। অন্যের বাড়িতে বউ, অমুকের মা হয়ে থাকতে  ভালো লাগে না।

ঈদ আসার আগে আগে আমি অজুহাত খুঁজতে থাকি। কিভাবে অসুখ বাধিয়ে ফেলা যায়। তারপর কি আনন্দ; উপভোগ্য একাকিত্বতা। আর আবদারের মানুষটা বুঝতে পেরেছে এ জিনিস কন্ট্রোলের বাইরে তাই সে আমাকে সাহায্য করতে তার বাবা- মায়ের সাথে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে।

অন্য কারণেও ঈদ আমার ভালোলাগে না। মহা সমারোহে গরু-ছাগল কিনে এনে জবাই করে গরীবদের হাড়, গোর, ফ্যাপডা দিয়ে বাকি সব ফ্রিজিং করে রাখার নাম মুসলমানের কুরবানী। আর এতেই দীর্ঘ প্রত্যাশা বেহেস্ত লাভের। আমার বাপু এমনিতেও বেহেস্ত লাভের সম্ভাবনা নেই, তাই ঘুমিয়ে নেয়াই ভালো।

-বাবা নীল কেন?

-নীল হলো সেরা রং! এটাই নাও তোমাকে মানাবে।

শিক্ষক বাবার সাইকেলে চেপে পাশের হাঁটে যেতাম ঈদের জামা কিনতে। নীল তার পছন্দ তাই কিনে দিতেন। অভাব ছিলো না তবু মাঝারি দামের জামাকাপডই তার পছন্দ ছিলো। শিখিয়েছেন মিতব্যয়ি হতে।

ঈদের রাতে ঘুমই আসতো না পাছে কেউ নতুন জামা দেখে ফেলে। সকালে সে কি উত্তেজনা সেটি পরে মাঠে যাবার? বাবা কখন যাবে? বাবা আগের বছরের পান্জাবী পরে আমাকে নিয়ে যেতেন ঈদগাহ মাঠে। কারন জৌলুস দেখানোর জিনিস নয়। কতো মানুষ ঈদে নতুন জামা পায় না, তাদের তিনি কষ্ট দিতে চান না। এমনি আমার অসাধারণ বাবা। আর আমি তার কুডিয়ে পাওয়া মেয়ে!!

আমি সবেমাত্র অনার্সে পড়ি। এমনই এক কুরবানী ঈদের আগে বাবা অসুস্থ হলেন।লিভার সিরোসিসে একদমই খারাপ অবস্থা। হাসপাতালে তার সাথে আমি,অতোসতো বুঝি না। বাবা ঈদের আগের দিন বললেন, তিনি বাঁচবেন না। তাকে যেন বাড়িতে নিয়ে আসি। আমি হেসেছিলাম, তা হয় নাকি? এখনও তোমার সাথে আমার কাটানোর কতকিছু বাকি। সে সব না করে যাও কই?

চারিদিকে ঈদের পটকা, আতশবাজি। আমি ছুটছি ডাক্তারের কাছে, বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পালস্ কমে গেছে। রাত ১২.৪৫ এ বাবা চুপ হয়ে গেলেন। আমার বুকফাটা চিৎকারে হাসপাতাল ভারী হলো, কে শুনবে? সবাই ঈদের আনন্দে অস্থির।

ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় তার মাটি হলো। ভয়ংকর মৃত্যু কেড়ে নিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে যা আমি অনেক পরে বুঝেছি। মেয়েদের জীবনে বাবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্ট যা আমি হাডে হাডে টের পেয়েছি।সবাই সবার মতো স্যাটেল। আমি আর মা অনিচ্ছায় পরে রইলাম।

মা তার ছেলেদের ভীষন ভালোবাসেন কিন্তু আমাকে ব্যবহার করেন এটা বুঝলাম, আমি যখন কুড়িগ্রাম চলে এলাম। বিবাহিত মেয়ে বাসায় থাকবে এটা অসহনীয়, অসম্মানের নানা আচরনে তিনি বুঝিয়ে দিলেন। বাবা হারিয়ে আমি মায়ের এমন আচরনেও তাকে ছাড়লাম না। শুধু আশ্রয় চেন্জ করলাম। ওটা ভাইদের বাসা, আমার মায়ের ছেলেদের বাসা। আমার অধিকার নেই, কারন আমার বাবা নেই।

মামার বাসায় উঠে গেলাম। আমি অবাধ্য, ঘাড় তেরা, অগোছালো বাজে একটা মানুষ। বিছানায় ঘুমাই একদিকে উঠি অন্যদিকে।  যাদের কাছের আমার আশ্রয় হবার কথা তারা ’ সাত ঘা ছুলে পাপ- এমন ভাব করে দুরে থাকলেই বাচেঁন।

মামা-মামীমা এই দুটো মানুষ আমার সকল আবদার, অনিয়ম, অনাচার সহ্য করে অভাব পুরন করছেন আজ ৭ বছর ধরে। এই দুজন মানুষের কাছেও আমার অনেক ঋন। বোনটা অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে তারা হয়তো আমাকে দিয়েই সন্তানের অভাব পূরণ করতে চান। কিংবা অনেক বেশি ভালোও বাসেন।

বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমার ঈদ করা হয় না। মাকে ঈদে ছেলের সাথে দিই। আমি মধ্যদুপুরে ঘুম থেকে উঠি। মামীমা নিয়ম করে প্রতি ঈদে আমাকে ডেকে তোলেন, ট্রে ভর্তি খাবার পাঠান। আমি অবাক হই উঠবো না বলে ফোন অফ কিংবা সাইলেন্ট করে রাখি। তারপরও এ মানুষটা বিরক্ত হন না কেন? যতক্ষন উঠে খাবার না খাই, কাজের মেয়ে নিচে পাঠাতেই থাকেন। খুব অনিচ্ছায় উপরে গিয়ে খাই, না হলে মামীমা বসেই থাকেন। এটাই আমার কাছে ঈদ

শশুরবাডীতে কুরবানী দেয়, আমার নামও থাকে। আমরা মানুষই ছয়জন। বাবাকে( শশুর) বলি আমার বাবারও নামটা দিতে কারন গরু-খাসি দুটোই থাকে। বোঝা গেল মৃত মানুষ মূল্যহীন হয়, তাদের নাম দেয়ার নিয়ম নেই। তখন থেকে আমি বাবার কোরবানীর নাম দেই মামার সাথে। মামার কাছে হয়তো তিনি মৃত না। ১২ টার পর উঠে মাংস ভাগ করে বিলিবাট্টা করি। বিলিয়ে দিয়েই মনে হয় বাবার স্পর্শ পাচ্ছি। কারন তার জন্য কিছুই করতে পারি নি।

বহুবছর আমি বাবার গেন্জি কিনি না। ঈদে আমারও কিছু কেনা হয়না। নীল পছন্দের হলেও পরি না, ব্যথায় কুকডে যেতে থাকি। তবুও ঈদ আসে হাসতে হয়, চলতে হয় নিয়ম- অনিয়মের মধ্যেই!!!

ছবি- নেটের।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ