ঘুরে এলাম সুন্দরবন (শেষ পর্ব)

শামীম চৌধুরী ২৯ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ০৩:৪৮:৪০পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ২৩ মন্তব্য

জাহাজে  দুপুরের খাবার খাচ্ছি। সুন্দরীখালের উদ্দেশ্যে জাহাজ চলছে । খাবার শেষে কিছু ফল দিলো। সবাই আড্ডায় মশগুল। জামতলায় কারা কি ছবি পেলাম সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। যারা বাঘ দেখেছিলেন তারা তাদের ভয় পাবার কারন ব্যাখ্যা করছেন। জাহাজ হুইসেল বাজিয়ে চলছে। আমি আড্ডা থেকে বের হয়ে ক্যামেরা নিয়ে ডেকের সামনে দাঁড়ালাম। দুই ধারের গাছ-গাছালি ও কমলা মাছরাঙার উড়াউড়ি দেখছি। মাছরাঙার চঞ্চলতার জন্য কোন ছবি ধরতে পারছি না। ওর উড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমার সাথে লুকোচুরির খেলছে। এরি মাঝে আরো তিনজন অভিযাত্রী আমার সাথে যোগ দিলেন। তাদের বক্তব্য ভাই একা একা ছবি তুলছেন? আপনাকে খুঁজছিলাম। ভাবলাম আপনি এখানে। তাই চলে আসলাম। বললাম ভালই করেছেন। বলতে বলতে সুন্দরী গাছের মাথায় Scarlet minivet বা সিঁদুরে সোহেলী ও Iora বা ফটিকজল পাশাপাশি বসে আছে। সবাইকে বললাম ভালো একটা কম্পোজিশান ও ফ্রেম পাবেন। ছবিটা তোলেন। সবাই ছবি তুললাম। বেশ কয়েক প্রজাতি পাখির ছবি তুলতে তুলতে সুন্দরী খালের মুখে জাহাজ নোঙ্গর করলো। খালের ভিতরে ঢুকার জন্য সবাই নৌকায় বসলাম। এই সুন্দরীখালেই পৃথিবী থেকে বিপন্ন Masked fin foot বা সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস  মাত্র ৮/১০ জোড়া পাওয়া যায়। যা আছে তা সুন্দরবনেই। আর কোথাও দেখা যায় না। সেই উদ্দেশ্যেই সুন্দরীখালে যাওয়া। নৌকা নিয়ে আমরা সুন্দরী খালের ভিতরে । সবাই চুপ। মুখে কোন শব্দ  নেই। আগে থেকেই বলেছিলাম এই পাখি খুবই লাজুক স্বভাবের ও ভীতু। শব্দ পেলে বনের ভিতর ঢুকে যাবে। অনেক খোঁজাখুজির পরও পাখিটির দেখা পেলাম না। না পাওয়ার মূল কারন এখন এদের প্রজনন সময়। আর এরা বাসা বানায় বনের ভিতর উঁচু গাছে। খাবারের জন্য ভাটার সময় কাদা মাটিতে আসে। আমরা যখন সুন্দরী খালে যাই তখন সন্ধ্যা ৬ টা। এরা ৩-৪ টার মধ্যে খাবার খেয়ে বাসায় চলে যায় ডিমে তা দেওয়ার জন্য। সতীর্থদের বলেছিলাম পাওয়াটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করবে। সুযোগের হার ৫০-৫০। (পরবর্তীতে সুন্দরী হাঁস নিয়ে সোনেলায় লিখবো) খাল থেকে ফেরার সময় বাদামী মাছরাঙা বা কমলা মাছরাঙা কেওড়া গাছের ডালে এসে বসলো। শেষ বেলার খাবারের জন্য পাখিটি ব্যাস্ত ছিলো। তাই অনেক্ষন সময় ধরে বসে ছিলো। সবাই পাখিটির ছবি তুললাম। সবাই ভালো ছবি পেয়েছে দেখে আমার খুব আনন্দ লাগলো। জাহাজে  নিজেকে ফ্রেশ করে নিলাম। সবাই জাহাজের ডাইনিংয়ে একত্রিত হলাম। বিকেলের নাস্তায় ২টা আলুর চপ, ২টা বেগুনী, তেতুলের সস ও মুড়ি ছিলো। পরে চা/কফি নিয়ে আবারো আড্ডায় বসলাম।

সুন্দরীখাল থেকে জাহাজ যাবে পক্ষীর খালে। যে নদী দিযে যাবে সেটার নাম দিশরাই নদী। আমরা রাতে পক্ষী খালের মুখে থাকবো। কারন ভোরে পক্ষী খালের ভিতরে নৌকায় ঘুরবো আর পাখির ছবি তুলবো। তাই রাতেই রওনা হলাম। রাত ১০:০০ টায় রাতের খাবার দেয়া হলো। সেদিন রাতে জাহাজে বারবিকিউ পার্টি হয়। ম্যানু ছিলো মুরগীর বারবিকিউ, বড় চিংড়ি মাছ, ভেজিটেবল রাইস, বিফ কারী ও তাজা আমের জুস। রাতের খাবার খেয়ে যার যার কেবিনে চলে যাই নিদ্রার জন্য। এরি মধ্যে জাহাজ পক্ষী খালের মুখে নোঙ্গর করেছে।

বাদামী মাছরাঙা বা কমলা মাছরাঙা।

ঘড়িতে এলার্ম দেয়া ছিলো। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠলাম। ওয়াশরুমে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুঁয়ে সবাই প্রস্তত হলাম। এরি মধ্যে কেবিন বয় ইমরান দুটি বিস্কুট ও এক কাপ চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কেবিন থেকে বের হলাম। সবাই নৌকায় বসলাম। আস্তে আস্তে নৌকা পক্ষীর খালে ঢুকছে। তখন নদীতে ভাটা চলছে। তাই খালের দুই ধারে কাদা মাটি জেগে উঠেছে। সেই কাদা মাটিতে প্রকৃতির অলংকার বন্যপ্রানীরা তাদের খাবার খুঁজে নিচ্ছে। তখনও সূর্যের আলো নদীর বুকে পড়ে নাই। ভোরের হাওয়া শরীরে বইছে। চারিদিক সবুজ আর সবুজ। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিরা গান জুড়ে দিয়েছে। পাখির কলতানে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম প্রকৃতির সাথে। ভাবছি যদি প্রকৃতির সাথে ঘর বাঁধতে পারতাম, তবে লোকালয়ে আর ফিরে যেতাম না। এমন সময় চোখের সামনে টুপ করে বসলো দাগী-বুক কাঠঠোকরা। পাখিটির ছবি আমার তোলা ছিলো না। খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি তুললাম। প্রায়ই ৫ কিলোমিটার খালের ভিতরে ঢুকলাম। খালের পাড়ে বনমেরাগ ও বানর খাবার খুঁজছে। কারো সাথে কারো দন্ধ বা যুদ্ধ নেই। কেউ কারো খাবার  ছিনিয়ে নেয় না।  কেউ কাউকে ধর্ষন করে না। কেউ গুজব ছড়ায় না। কেউ কাউকে পিটিয়ে হত্যা করে না। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতির কাছে নালিশও করে না। ওরা বণ্যপ্রানী হয়েও একত্রে দলবদ্ধ হয়ে প্রকৃতিতে বিচরন করছে। শুধু সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে আমরাই পারলাম না বন্য পশুদের মত প্রকৃতিতে বা সমাজে বসবাস করতে। যত হানাহানি,মারামারি,ধর্ষন ও ঘুষ লেন-দেন শুধু মানব জাতিতেেই। পশুর চেয়েও কি আমরা অধম? এই ভাবনাগুলি সবসময় আমার মনে গেঁথে উঠে যখন আমি প্রকৃতিতে থাকি। ইচ্ছে হয় বন্যদের সাথে ঘর বাঁধি। অন্ততঃ মানুষের চাপাতির আঘাতে মৃত্যৃর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে। মাঝে মাঝে নিজের জীবনের প্রতি ঘৃণা চলে আসে। নিজেকে তখন অসহায় মনে হয়। আমাদের ভিতরের এই লোভ-লালসা,অসভ্যতা, ধর্ষকতা ও খুন-খারাবি কি কোনদিন বিলুপ্ত হবার নয়? ভাবতে ভাবতে জাহাজে চলে আসলাম। সকাল ৯টায় আটার রুটি, মুগডাল, সুজির হালুয়া ও ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। জাহাজ ছুটলো করমজলের উদ্দেশ্যে। ডেকে দাঁড়িয়ে চা পান করছি। বর্ষায় নদী তার যৌবন ফিরে পেয়েছে। প্রবল স্রোত কাটিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। মাঝে মাঝে ডলফিন ও শুশক মাথা উঁচু করে ডুব দিচ্ছে। দেখতে ভালই লাগছে।

বেলা ১২ টায় করমজলে জাহাজ নোঙ্গর করলো। সবাই জাহাজ থেকে নেমে করমজলের প্রবেশ করার সময় অদ্ভুত এক দৃশ্য নজরে আসলো। দোকানীরা বিভিন্ন খাবার বিক্রি করছে। কিন্তু পন্যের পসরা সাজিয়ে নয়। দোকানীদের বিক্রির কৌশল দেখে মনে হলো কোন মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে। সব পণ্যই বাক্সে বন্দী। কারনটা জানতে চাইলাম। ওরা বললো বানরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে এই পন্থা।  পর্যটক বা দোকানীদের কাছ থেকে বানরগুলো যে কোন খাবার ছিনিয়ে নেয়। এমনকি মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগও। তাই এক বোতল সুপেয় পানি আর চিপস কিনে লুকিয়ে পকেটে  রাখলাম। যারা করমজলে নুতন যাবেন খুব সাবধানে হাতের ব্যাগ ও খাবার সংরক্ষন করবেন। নতুবা বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বেশী। কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র দেখে কাঠের ট্রেইল দিয়ে হাঁটছি। নজর দুই ধারে গাছের দিকে। এই করমজলে দেখা যায় পরিযায়ী পাখি ম্যানগ্রোভ পিট্টা বা ম্যানগ্রোভ বনসুন্দরী পাখিটি। ধীরে ধীরে সামনে দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের সাথের একজনের কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ ছিলো। গাছ থেকে একটি বানর লাফিয়ে সেই ব্যাগে টানাটানি শুরু করলো। আমরা কয়েকজন বানরটিকে তাড়ানোর জন্য তেড়ে আসলাম। উল্টো বানর ভেঁচকি কেটে আমাদেরকে তাড়া করলো। এদের সাহস দেখে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। পরে বানরটি পরাস্ত হয়ে চলে যায়। একমাত্র করমজলেই একটি পাখি দেখা যায়। নাম Orange bellied Flowerpeacker বা  কমলাপেট ফুলঝুড়ি। পাখিটি আমার ঝুলিতে ছিলো না। ভাগ্যগুনে পাখিটি পেয়ে যাই। আমি আনন্দে আত্মহারা। এই পাখিটি খোঁজার দরুন ম্যানগ্রোভ পিট্টা আমার হাত ছাড়া হয়ে যায়। (যদিও আগে তোলা ছিলো) অভিযাত্রী দলের অন্য সদস্যরা ম্যানগ্রোভ পিট্টার ছবি পাওয়ায় আমি খুশী। কারন তাদের জন্য ছিলো এটি রেকর্ড শট। বেলা তিনটায় দুপুরের খাবার খেয়ে আবারও বনের ভিতর যাই। বেলা ৫টা পর্যন্ত করমজলে থেকে মংলার উদ্দেশ্যে জাহাজ রওনা হয়। ৬টায় মংলায় আসি। সন্ধ্যা ৭:৩০মিনিটে রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের লাগেজ গুছিয়ে নেই। কারন ঐদিনই খুলনা এসে রাতের বাসে ঢাকা ফিরতে হবে। নৌকায় এপারে এসে রাত ৯ টায় ভাড়া করা মাইক্রোবাসে উঠি। আমাদের রূপসা ঘাটে পৌছে দেয়। নদী পার হয়ে অটোতে যখন খুলনা শহরের রয়েলের মোড়ে আসি তখন রাত ১০:৩০মিনিট। আমাদের ঢাকার এসি বাস রাত ১১টায়।

কমলাপেট ফুলঝুড়ি পাখি।

ভোর ৬টায় ঢাকায় পৌছি। সতীর্থরা যার যার মতন নিজ দায়িত্বে বাড়ির দিকে রওনা দেন। সবার মুখে একটি সফল ভ্রমনের আত্মতৃপ্তি শুনে নিজের কাছে খুব ভালো লাগলো। দুই রাত তিন দিন ১০জন মানুষ একসাথে থাকায় মনে হয়েছিলো আমরা একই পরিবারের সদস্য। নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা,একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সত্যিই বিরল। কারো কোন অভিযোগ ছিলো না।  আর ভ্রমন সঙ্গী এমনই দরকার। নইলে সেই ভ্রমনে তৃপ্তি আসে না। যে কোন দলগত ভ্রমনে সবার আগে মানুষ নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ। নইলে বিড়ম্বনায় পড়ার আশাংকা থাকে। সর্বক্ষন আনন্দ আর আড্ডা বাজিতে মত্ত থেকে বর্ষার সুন্দরবনে ঘুরে আসার মজাটা ছিলো আমার কাছে খুবই আনন্দের। আর এই আনন্দটাকে পুঁজি বা সঙ্গী করে  “ঘুরে এলাম সুন্দরবন” এর ভ্রমন কাহিনী এখানেই শেষে করলাম।

সর্বশেষ একটি কথা বলে লেখা শেষ করবো। যে কোন দুঃসাহকিতার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করায় আনন্দ যেমন থাকে তদ্রুপ জীবনের প্রতি হুমকিও তেমন থাকে। তাই এ্যাডভেঞ্চার মূলক ভ্রমনগুলিতে যাবার পূর্বে আমাদের উচিত হবে পড়াশুনা করে জেনে যাওয়া। যে জায়গায় যাচ্ছি সেই জায়গা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে আপনি ভ্রমনে তৃপ্তি পাবেন না। বিপদের সম্মুখীন হলে উদ্ধারের জন্য কোন সাহায্যও পাবেন না। প্রথমেই আমাদের যে কাজটি করা উচিত সেটা হলো যে জায়গায় যাচ্ছেন সেই জায়গার লোকজনদের সাথে ভালো ব্যবাহার করা। স্থানীয়দের আপন করে নেয়া। যদি এই কাজটি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে করতে পারেবন তবে আপনি যে কোন বিপদ থেকে স্থানীয় লোকের সাহায্য সহযোগিতা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি সব সময় এই পন্থাটি অবলম্বন করি।

আমাদের সকলের উচিত বছরে অন্তত একবার হলেও নিজ বাড়ি থেকে বের হওয়া বা ভ্রমনে যাওয়া। ভ্রমন আপনার মানসিক ক্লান্তি ও অস্থিরতা দূর করবে। ভ্রমন আপনাকে নিজ জগত থেকে একটা ভিন্ন জগতে নিয়ে যাবে। দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় ভ্রমন। তাই সুযোগ হলেই বের হয়ে পড়ুন কোথাও ভ্রমনে। দেখবেন কত প্রশান্তি ও সুখ এনে দেয় আপনার দেহ-মনে। প্রকৃতির সাথে থাকুন। প্রকৃতিতে বিচরনকারী বণ্যপ্রানীদের রক্ষা করুন। তাতে প্রকৃতির ভারসাম্য যেমন বজায় থাকবে তেমন আমরাও ভারসাম্যহীন থেকে মুক্ত হবো। সোনার গহনা যেমন নারীর অলংকার তদ্রুপ পশু-পাখি প্রকৃতির অলংকার। তাই এদেরকে ভালোবাসুন। এদের জন্য অভয়ারন্য গড়ে তুলুন। তাতেই আপনি চিরসবুজ থাকবেন।

সবাই ভালো থাকুন ও সুন্দর থাকুন। আপনার পাশের মানুষটিকে ভালো রাখুন।

সবাইকে ধন্যবাদ।

 

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ