খোলাচিঠি ( প্রতিযোগিতা)

ইকরাম মাহমুদ ৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ১০:৩৭:০৯অপরাহ্ন বিবিধ ৩৬ মন্তব্য

শ্রদ্ধেয় স্যার,
আমার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা আপনাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সেই যে গেলেন আমাদের ছেড়ে। চলে যাবার সময় আপনি বলেও যাননি কোথায় যাচ্ছেন। একটা ঠিকানা কিংবা ফোন নাম্বার কোনোটাই রেখে যাননি। শুধু আপনার একটা ব্রিফকেস আজো আমাদের ঘরে যে রুমটাতে আপনি থাকতেন সেখানটায় রাখা আছে যত্নে। কলেজ কমিটি আপনার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারেনি বলে অভিমান করে চলে গেলেন ভোরের আলো ফুটবার আগেই। যেদিন চলে গেলেন আমাদের গ্রাম ছেড়ে সেদিন সকালে আপনার পিয়ন আমাদের বাসায় এসে কেঁদে কেঁদে জানাল আপনি রাগ করে চলে গেছেন।
খবরটা শুনে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। এভাবে চলে যাবেন ভাবতেও পারিনা। আব্বু অনেক খুঁজেছে আপনাকে।

জানেন স্যার, আপনার নিজ হাতে গড়া কলেজটা অনেক নাম করছে আমাদের উপজেলায়। মাত্র ৭ জন ছাত্রী নিয়ে আপনি যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯৯৯-এ। বেতন ছাড়াই আপনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর খেঁটেছেন কলেজটা দাঁড় করাতে। রাতে ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন আপনার ছাত্রীরা পড়ছে কিনা। আপনার কলেজ থেকে এখন প্রতিবছর অনেক ছাত্রী বের হয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান করে নিচ্ছে। কলেজের মুখ উজ্জ্বলকরছে। অনেক ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে প্রতিবছর। আপনি দেখলে অবাক হবেন টিনের ঘর ভেঙে দালান উঠেছে।

স্যার, আপনি কলেজ ছেড়ে চলে গেলেন ২০০২-এ। ২০০৯ এ এমপিওভুক্ত হলো আপনার কলেজটা। শিক্ষকদের বেতনের জন্য আপনি কতকিছুই না করেছেন। আপনার গুণগ্রাহী অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনার কথা। কিন্তু তাদের কিছুই বলতে পারিনা আপনার সম্পর্কে।

স্যার, আপনার রেখে যাওয়া ব্রিফকেসটা খুলেছি ক'দিন আগে। এছাড়া আমার কিছুই করার ছিলনা। আপনার ঠিকানা খুঁজতেই এ কাজটা করেছি আমি। ক্ষমা করবেন আমাকে।কিন্তু কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর ছিল না ব্রিফকেসে। তবে আপনার একটা ছবি পেয়েছি। ছবিটা যে খামে ছিল তাতেও এমনভাবে আটকে আছে যে আপনার মুখবয়ব অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
আমার মনে আছে আপনি এই ব্রিফকেসটাই নিয়ে
এসেছিলেন আমাদের গ্রামের কলেজটা প্রতিষ্ঠা করতে। আপনার সংসার বলতে ঐ ব্রিফকেসটাই -মাঝেমাঝে আপনি বলতেন। ব্রিফকেসটাতে আপনার প্রিয় জিন্নাহ টুপি, ২টি লুঙ্গি, ১টি পাঞ্জাবি, ১টি পাজামা, ১টি তোয়ালে, কলম, কাগজ, একটি সাবান রাখা ছিল। ভিতরটা ছত্রাক লেগে গিয়েছিল। লুংগি আর পাঞ্জাবিটা ধুয়ে আবার রেখে দিয়েছি যত্নে। আব্বু আপনাকে আমাদের গ্রামের কলেজের জন্যই এনেছিল। কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি। শুধুমাত্র গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল বলে আপনাকে তাঁরা পথের কাঁটা ভেবে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর আপনি রাতের অাঁধারে কাউকে কিছু না জানিয়ে সেই যে চলে গেলেন আর ফিরে এলেন না। কতোটা মন:কষ্টে, দুঃখ নিয়ে আপনি চলে গেলেন কলেজটা ছেড়ে। আপনার মতো সরলমনা মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি।
আমাকে যদি বলা হয়, আমার প্রিয় শিক্ষক কে?
উত্তরে বলব গোলাম কিবরিয়া।
আব্বুর স্যার বলে আমরা সবাই স্যারই ডাকতাম আপনাকে। একটা দুঃখ মনের ভিতর রয়ে গেছে, আপনার ছাত্র না হতে পারার দুঃখ। তবে পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে সে জন্মে আমি আপনার ছাত্র হয়ে জন্মাতে চাইব। আপনার ক্লাশের শেষ বেঞ্চের এককোণে হলেও একটুকু জায়গাই চাইব স্রষ্টার কাছে।

জানেন স্যার, আমার গ্রামের মানুষ আপনাকে অপমান করেছে, এটা মনে করে আব্বু মনোঃকষ্টে ভোগেন। আব্বুর প্রিয় স্যার ছিলেন আপনি। আপনার জন্যই আব্বু শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছিলেন। আপনার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে আব্বুও শিক্ষকতা জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে।

বছর পাঁচেক আগে খবর পেলাম আপনি চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমার এখনো বিশ্বাস হয়না আপনি নেই। ভাবতেই কষ্ট হয় আপনার সংসার নামক ব্রিফকেসটির জন্যও আপনি আর আসবেন না আমাদের মাঝে। আপনার ব্রিফকেসটা অনেক যত্নে রাখা আছে। না ফেরার দেশে চলে গেছেন আপনি তবু একটি চমকে উঠার দিনের অপেক্ষায় আছি।
আল্লাহ আপনার বেহেশত নসীব করুন।

ইতি
আপনার স্নেহের
ইকরাম

0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ