একজন গল্পবলা যোদ্ধা

ইকরাম মাহমুদ ১ ডিসেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০১:০৫:৫২অপরাহ্ন গল্প ১২ মন্তব্য

এখনো ৭১-এর গল্প শুনি। মাঝে মাঝেই শুনি।
ঐ সময়ের এক কিশোর যোদ্ধার কাছে।যুদ্ধের সময়ে তাঁর সাথে এবং সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা যখন বলতে শুরু করে তখন মনে হয় যেন তাঁর মুখ থেকে শব্দগুলো গুলির মতো ছুটছে আর বিদ্ধ হচ্ছে চারপাশের দেয়ালে।একেবারে চোখের
সামনে চলে আসে সেদিনের চিত্র।

১২ কিংবা ১৩ বছরের এক কিশোর। কতোটা সাহস আর দেশপ্রেম থাকলে লুঙ্গির গীঁটে গোলাবারুদ, কাঁধে গ্রেনেডের ব্যাগ, মাথায় ঘাসের ট্যাপারিতে লুকানো গোলাবারুদ নিয়ে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারে? এখনো একটু কাঁটা-ছেঁড়া, একটু রক্ত দেখলেই মাথা ঝিমঝিম করে। যে কিশোরের কথা বলছি সেআজ প্রবীণ। শরীরে একটু একটু করে ঘুঁণ ধরা শুরু হলেও মস্তিষ্কে জমে থাকা স্মৃতিতে
যেনো একটুও ঘুঁণ ধরেনি। প্রতিটা ঘটনা,প্রতিটা মুহুর্তের বর্ণনা এতোটা প্রাণবন্ত যে, শুনলেই শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যায়। কৌতুহলভরে প্রশ্নও করি তাঁকে। আচ্ছা,গ্রেনেড এভাবে সাথে রাখতে তোমার কি একটুও ভয় করতো না? সে সময়ের কিশোরের সহজ উত্তর; কিসের ভয়? ভয় টয় কিছু ছিল না তখন। এসব মনেই হতো না। আর ফাটলে কি হবে তাও মনে
আসতো না। কালিহাতী থানার আউলিয়াবাদ গ্রামে সে
কিশোরের বেড়ে উঠা। পাশের কয়েকগ্রাম পড়েই মরিচা গ্রামের পাহাড়ে ছিল মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। সে ক্যাম্পে
মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন খবরাখবর সরবরাহ ছিল এ কিশোরের কাজ।ভারত থেকে আসা অস্ত্র,গোলাবারুদ কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দিয়ে যেত। সেগুলো সে কিশোর আর সহযোদ্ধারা নিয়ে যেত বিভিন্ন ক্যাম্পে।প্রতি রাতেই ৩ নং কোম্পানি
কমান্ডার নবী-নেওয়াজ এর নির্দেশে বিভিন্ন ব্রিজে পাহারায় থাকতে হতো গ্রেনেড হাতে নিয়ে। সেই কিশোর ৩নং
কোম্পানি বার্তাবাহক ও পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো।

একবার তো পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে আসতে পেরেছিল।সেদিন কমান্ডার তোফাজ্জল সহ কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ হোন এই কিশোরের
সামনেই।

যে কিশোরের গল্প তোমাদের শুনাচ্ছি সে
কিশোরটি একজন গল্পবলা যোদ্ধা।
নাম মোঃ আব্দুল লতিফ মিয়া।
আমার বাবা।
হ্যাঁ, আমার বাবার গল্পই বলছি।
না, রাষ্ট্রীয় গেজেটভুক্ত যোদ্ধা নয় সে।
যদিও কমান্ডার তাকে একটা স্বীকৃতিপত্র দিয়েছিল। দূর্ঘটনাবশত সে তা হারিয়ে ফেলেছে। এরপর অনেক সুযোগ এসেছে যখন টাকার বিনিময়ে তাঁর নাম উঠতো সরকারী
গেজেটে। কিন্তু তিনি তা গ্রহন করেননি।
এমন অনেক যোদ্ধা এদেশে আছে।দেশের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সে কিশোরের মাঝে এ নিয়ে আফসোস নেই কোনো। তবে দুঃখ হয় আমার, যখন তারই কাছে শুনি আরো
ভয়ঙ্কর কিছু গল্প।

বাবা মায়ের কোলে থাকা হামাগুড়ি দেওয়া সন্তানরা আজ মুক্তিযোদ্ধা।তাঁর পরিচিত এমন অনেক যোদ্ধা আছে যারা
জানেই না মুক্তিযুদ্ধ কী? আপসোস হয়, তারা কী গল্প শোনাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তাঁদের ভান্ডারে কি গল্পই বা
আছে বলার? মুক্তিযুদ্ধ তো কোনো মিথ্যা গল্প
নয়? নয় তো কোনো সিনেমা? তাদের জন্য আমার
নিরব হাসিই বরাদ্দ। শঙ্কিত এই ভেবে যে সেসব মুক্তিযোদ্ধার ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা কিছু মিথ্যে বানানো যুদ্ধের
কাহিনীকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।
যা আমাদের ইতিহাসকে করবে সিনেমাটিক।

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের গর্ব করার
মতো অনেক কিছুই থাকে।
আমিও করি। কারণ, আমার বাবা এ
সময়ের সদ্য গেজেটভুক্ত যোদ্ধা নয়।
ঐ সময়ের এক সাহসী কিশোর যোদ্ধা আর এ
সময়ের একজন গল্পবলা যোদ্ধা। যার ভাণ্ডারে সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া শত শত নির্মম ঘটনা।
রক্ষিত আছে ৭১ এর গল্প।

আজ পহেলা ডিসেম্বর, মুক্তিযোদ্ধা দিবস।
স্যালুট তাঁদের যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। তাঁদের মাঝেই তো
বেঁচে থাকবে ৭১। তাঁরাই বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান।
আরও স্যালুট জানাই এই কিশোরের মতো
গল্পবলা যোদ্ধাদের। যাদের গল্পে উঠে আসে ৭১ এর দিনগুলির কথা। তাদের গল্পেই বেঁচে
থাকবে ৭১ সংখ্যাটিও।
অনন্তকাল বেঁচে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের গল্প।

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ