নোনতা বুড়ি, নানা হোটেল, নানা নুয়া, নানা তাই এমন সব নাম দেখে প্রথমবার বেশ মজাই লেগেছিল। নোনতা বুড়ি এলাকার নাম হলো কেন ব্যাংককে? কোন বুড়িকে কে খেয়েছে যে এলাকার নাম হবে নোনতা বুড়ি? নানা মনে হয় খুব প্রিয় সবার একারণে নানার ছড়াছড়ি। কেউ একজন আমাকে নানা ডাকে, কিন্তু ব্যাংককে নানা প্রিয় অনেকেরই এটা নানার আধিক্য দেখে বুঝা যায়।
২০০৩ সাল হতে এই ব্যাংককে আসি আমি। শহরটা অত্যন্ত ভালো লাগে। সুকুমভিত এর রাস্তায় গেলে সব দেশের মানুষ দেখা যায়। সুকুমভিত যেন একটি বিশ্ব-মানব মেলা।

ব্যাংককে শেষ বার আসি এবছরের মে মাসে। দেশ ভ্রমণ করতে ভালো লাগে আমার, নেশার মত। নোনতা বুড়ি এলাকার পরিচিত হোটেলের রিসিপশনে রুমের জন্য দাড়িয়ে। রিসিপশনের মেয়েটি খুবই নিচু কণ্ঠে নিচে তাকিয়ে কথা বলছে। কথা শোনা যায় না, এমন আস্তে বলা। ব্যাংককে এসে মোবাইলে নিচু কণ্ঠে কথা বলা শিখেছি আমি। হ্যালো ম্যাডাম  ডাক দিতেই মেয়েটি আমার দিকে তাকালো। তাকিয়ে যেন ভুত দেখলো এবং অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পরে গেলো। হতভম্ব আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাকে নিয়ে সবাই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো ১৫ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার চলে এলো, ডাক্তারের পরামর্শে মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হলো।

রুম পেয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দিলাম। কখন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে জানিনা। দরজায় ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দ্রুত দরজার কাছে। এমন তো হবার কথা না। দরজার সামনে আমি 'ডোন্ট ডিসটার্ব ' ঝুলিয়ে রেখেছি। দরজা খুলে দেখি পুলিশ। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাংলাদেশ থেকে এসেছি হোটেলের রেজিষ্ট্রার থেকে জেনেই এসেছে, পাসপোর্ট দেখতে চাইল। বললাম পাসপোর্ট তো কাউন্টারে রেখে এসেছি। পুলিশ বললো, না তুমি পাসপোর্ট জমা দাওনি, নিয়ে এসেছো। মনে পড়লো যে পাসপোর্ট আমি রুমেই নিয়ে এসেছি ফটোকপি করে দেবো বলে। ছোট কোমরের ব্যাগে রাখি আমি এসব। ব্যাগ খুলে পেলাম না, লাগেজ খুলে খুঁজে তাও পেলাম না। কোটের পকেট, জামা এবং প্যান্টের পকেট খুঁজলাম, নেই কোথাও।  রুমের ঠান্ডায় ও কপালে ঘাম এসে গিয়েছে আমার। বিছানা ওলট পালট করি, ড্রয়ার, ওয়াড্রব সব দেখা শেষ। নেই কোথাও। চলো আমাদের সাথে থানায়- পুলিশ এর গম্ভীর নির্দেশ এ বাধ্য মানুষের মত চলা শুরু করলাম।

পুলিশ স্টেশনে গিয়ে নানা প্রশ্ন, কেন আমি উধাও হলাম, কিভাবে উধাও হলাম, কিভাবে বেঁচে উঠলাম। সব প্রশ্ন, কথাবার্তা শুনে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি সব বলছো তারা বুঝি না আমি। রাত ১২ টার দিকে গাড়িতে ওঠানো হলো আমাকে। নিয়ে গেলো ব্যংকক কবরস্থান। মাথা আমার খারাপ হবার মত অবস্থা। কবর স্থানে আনল কেন আমাকে? সবাই দাঁড়ালো, আমিও। পাশাপাশি দুটো নতুন কবর। একটির উপরের মাটি কিছুটা এলোমেলো, অন্যটি পরিপাটি করা। পুলিশ মৃত ব্যক্তির নাম খোদাই করা পাথরে টর্চ লাইট মেরে আমাকে পড়তে বললো। নাম পড়ে ভয়ে আতংকে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম। লেখা আছেঃ
জিসান শা ইকরাম,
জন্ম ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬২
মৃত্যু ১৬ জানুয়ারী ২০১৫
অন্য কবরটি তার স্ত্রীর, একই দিনে মৃত।
কি বলবো, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। পুলিশের নির্দেশে মাটি খোঁড়া শুরু হলো। আলগা মাটি উঠানোর পরে কাঠের কফিন। কফিনের ডালা সরানো হলো, লাশ নেই কফিনে। স্ত্রীর কবর খোঁড়া হলো, স্ত্রীর লাশ আছে। মুখ দেখে আমি চিনতে পারলাম। কিন্তু বললাম না। কিভাবে বেড় হলে কফিন থেকে? পুলিশের এমন প্রশ্নের উত্তর কি দেবো আমি?

আবার থানায়, পুলিশ কর্মকর্তা অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে। ফোন করলেন কোথাও, থাই ভাষায় কথা বলছেন, আমি সব বুঝতে পারছি এখন। কথায় জানলাম ২০১৫ সনের ১৬ জানুয়ারী এক কার দুর্ঘটনায় মিঃ এবং মিসেস জিসান শা ইকরাম মৃত্যু বরণ করেন, কিন্তু জিসান শা ইকরাম কিভাবে জানি বেঁচে আছেন।
পরদিন সকাল দশটায় আমাকে গাড়িতে উঠানো হলো। নিয়ে এলো এক বিশাল বাড়িতে। বাড়ির চত্বরে পা রাখার সাথে সাথেই চিনতে পারছি যেন সব। ৪৯ টি আম গাছ আছে এই বাড়িতে। লাল সুরকির পথ পেরিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম বাড়ির দরজায়। দরজা খুলে দিল একটি মেয়ে, '' বাবা তুমি আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে? একা এত বড় বাড়িতে আমার থাকতে ভয় করে ''। কান্না জড়িত কণ্ঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকে। আমার মেয়ে প্লয় শা ইকরাম।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসি সবাই। রুমের ওয়ালে বড় বড় কিছু বাঁধানো ফটো। আমারই ফটো, সাথে স্ত্রী এবং কন্যা প্লয় শা।
রাতে মেয়েকে গুড নাইট বলার পরে ভাবছি, কি হলো এটি? কেমন হলো এটি? ওয়্যারড্রব খুলে খুঁজতে লাগলাম পাসপোর্ট। পেয়ে গেলাম থাই পাসপোর্ট। অবাক হয়ে দেখলাম, যত দেশ আমি ভ্রমন করেছি সব দেশের ভিসা লাগানো। কানাডা, চীন, কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভারত। পৃষ্ঠা উলটাচ্ছি আর ভাবছি কিভাবে সম্ভব এটি? যে কদিন যে যে দেশে ছিলাম, আগমন এবং বহির্গমনের তারিখ মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোন ভিসা নেই।
এখানে আমার বাড়ি হয়েছে,আছে আমার কিউট একটি মেয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে আমার স্ত্রী ও ৩ পুত্র। আপনারা কেউ কি আমাকে একটু জানাবেন, আমার বাংলাদেশের বাড়িতে জিসান শা ইকরাম নামে কেউ আছে কিনা? থাকলে সে তো স্ত্রী পেলো, সাথে তিন পুত্র। আর আমি এখানে স্ত্রী পেলাম না 🙁

নোটঃ
* হোটেলের রিসিপশনের মেয়েটি প্লয় শাই এর বান্ধবী।
* জীবনটাই একটি গল্প,এই গল্পের কিছু অংশ কল্পনা।
========================================
আমি আমি না, আমি সে ও না-পর্ব ১

0 Shares

৫৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ