জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক…

শমশেরনগর গার্লস হাইস্কুলে যে কয়েকজন শিক্ষকের স্নেহ পেয়েছি, উনাদের কথা বলবো আজ। আপামনি, লীলা ম্যাডাম, মওলানা স্যার, ধীরেন্দ্র স্যার। আমি স্কুল থেকে চলে আসার পর মামনির কলিগ হিসেবে এসেছিলেন সিংহ স্যার। তাই উনার প্রতিও সম্মান ছিলো। আরোও কয়েকজন নতূন এসেছিলেন মামনির কলিগ হিসেবে, যেমন নজরুল স্যার। আরোও আছে কিন্তু মনে পড়ছে না নাম। শুধু চেহারাই ভাসছে।

আপামনি ঃ-

আপামনি আমাদের সমাজ ক্লাশ নিতেন। হাল্কা-পাতলা দেখতে, আর সবসময় জর্জেট শাড়ী পড়ে আসতেন। মামনিকে সই বলে ডাকতেন। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন জানিনা। তবে শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট মায়া ছিলো। উনিও বেতের প্রয়োগ করতেন, তবে আমায় কোনোদিনও না। মাঝে-মধ্যে বেশ রাগত স্বরে কথা বলতেন রেহানা-ঊষা-মনি-শেফালীর সাথে। একদিন টিফিনের সময় আমায় ডেকে নিয়ে সিঙারা দিলেন। আমি নেইনি। তারপর বললেন, “আমি দেখেছি টিফিন আনোনি আজ।” আর সত্যি সেদিন টিফিন নিয়ে আসিনি। মামনি সামনেই ছিলো, নিয়ে নিতে বললো। আমি নিলাম। আপামনি বললেন ওখানেই খেতে। উনার বাসায় একবার ইনভাইট করেছিলেন আমাদের সবাইকে। আঙ্কেল খুবই মজার মানুষ। এতো হাসাতে পারতেন। হুম আঙ্কেল আর নেই। আপামনির দুই ছেলে শিপু আর তপু অনেক ছোট ছিলো। রঙীন শাড়ী পড়া মানুষটা তারপর সাদা শাড়ী পড়ে আসতেন। মামনির কথায় হাল্কা অন্য রঙের শাড়ী পড়তে শুরু করলেন। শিক্ষকতা করতে যখন আসি, কতোভাবে যে বলতেন বসার জন্য। পারিনি, মন থেকেই বসার ইচ্ছে আসেনি। তাই হয়তো আপামনি আমার কুমকুম আপুকে বলেছেন, “অনেক ছাত্রী পেয়েছি।দু’/একজনকে কলিগ হিসেবেও পেয়েছি। এসেই চেয়ারে বসে গেছে। নীলার মতো দেখিনি। ছয় মাস চাকরী করলো, একটা দিনও চেয়ারে বসেনি। এমনকি টুলে বসা থাকলেও উঠে গেছে।” আপামনি এখন নিউইয়র্কে থাকেন। কুমু আপুর সাথে আগে প্রায়ই দেখা হতো। এখন একটু দূরে থাকেন। এই কথাগুলো এ জীবনের বড়ো সম্পদ। গর্ব কিংবা অহঙ্কার করে এসব লিখছি না। শুধু এ কারণেই বললাম, আমরা যা কিছু করি তার ফলাফল পাই। তবে এসব প্রশংসা শুনবো ৪২ বছরের এ জীবনে কখনো ভাবিনি। যা কিছু করেছি মামনি-বাপির শিক্ষা থেকে।

লীলা ম্যাডাম ঃ- 

লীলা ম্যাডামকে সবাই ছোটদিদিমনি বলে ডাকতো। উনি খুবই ফ্যাশনেবল ছিলেন। হেয়ার কাট, সাজুগুজু উনার মধ্যেই দেখি প্রথম। হিল পড়ে আসতেন গট গট করে। উনি পড়াতেন বাংলা দ্বিতীয় পত্র। ম্যাডামও ক্লাশে বেত নিয়ে ঢুকতেন। সপাং সপাং করে সবাইকেই মারতেন। সত্যি বলছি আমি কোনোদিনও মার খাইনি। স্কুলে খুবই লক্ষ্মী মেয়ে ছিলাম। ক্লাশে নীরব থাকতাম। যা হোক। একটি দিনের কথা বলছি, আমি তখন ক্লাশ সেভেনে। কু্মু আপু ক্লাশ নাইনে পড়ে। টিফিন পিরিয়ডে আমি কুমু আপুর কাছে চলে যেতাম। একদিন কুমু আপুর ক্লাশমেট ঝর্ণা আপা খুবই রেগে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই নীলাঞ্জনা তুমি জুনিয়র ক্লাশের মেয়ে হয়ে এই রুমের সামনে আসো কেন? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।” টিচার্স রুমে গিয়ে ঝর্ণা আপা নালিশ করলো আমার নামে। রুমে ছিলেন লীলা ম্যাডাম, আপামনি, মামনি। আমার ডাক পড়লো, সাথে ঝর্ণা আপারও। এবারে লীলা ম্যাডাম বললেন, “ঝর্ণা কারক-বিভক্তি শিখে আসছো তো আজ? বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ফেল করো, এটা কেমন কথা! আচ্ছা শোনো নীলাঞ্জনা ক্লাশ নাইনের ক্লাশে যাও কেন?” ম্যাডাম আর যাবো না। তবে আমি তো রুমের ভেতরে যাইনা। সেখানেও যাবো না।” ম্যাডাম বললেন, “আরে যাবে না কেন? কিন্তু কাউকে বিরক্ত করো কেন? চলো তো ক্লাশ নাইনে।” যাবার পর ম্যাডাম জানতে চাইলেন সবার কাছে। রুবী আপা, কুমু আপু, রোকেয়া আপা সকলেই বললো আমি তো কথাই বলিনা। চুপ করে এসে দাঁড়াই। আর সত্যি তাই। লীলা ম্যাডাম তখন আমায় যেতে বললেন। কুমু আপুর কাছে শুনেছি ঝর্ণা আপাকে নাকি লীলা ম্যাডাম বলেছেন, “ঝর্ণা লেখাপড়ায় তো গোল্লা পাও। স্বভাবটাকে ঠিক করো। আর কোনোদিন যেনো না শুনি এসব নালিশ। তোমার যদি এতোই সমস্যা জুনিয়র মেয়ে এসে ক্লাশের সামনে দাঁড়ানোতে, আলাদা একটা স্কুল কিনে নিও।” একদিন ম্যাডামের বাসায় গেছি, এরচেয়ে শাস্তি কি আর আছে! বসতেই পারিনি। শেষে ম্যাডাম আর মামনি অন্য রুমে যাবার পর ম্যাডামের মায়ের সাথে গল্প করেছি। কলিগ হিসেবে যাবার পর ম্যাডামের কি গর্ব নতূন শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। লীলা ম্যাডামের ছোট বোন শিলা ম্যাডামও চাকরী করেছিলেন ওই স্কুলে, ততোদিনে আমি ইন্টারে পড়ি।

মওলানা স্যার এবং ধীরেন্দ্র স্যার ঃ-  

স্যারের ক্লাশ কখনো পাইনি। তবে উনি ধর্মশিক্ষা যখন পড়াতেন, মাঝে-মধ্যে বসে বসে শুনতাম। হিন্দু ধর্মশিক্ষার শিক্ষক না এলে। মওলানা স্যার অনেক জ্ঞানী ছিলেন। ধর্মকথার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরী করতেন কি সুন্দরভাবে! সাদামাটা, পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়া, মাথায় টুপি–অথচ এতো আধুনিকতা ছিলো উনার ভাবনায়। পুজা হলে, মামনিকে বলতেন, “বৌদি প্রসাদ আনেননি আবার নিমন্ত্রণও দেননি।” আমাকেও বলতেন “দেখো তোমার মা পুজার প্রসাদ আনেননি আজ।” দুই ধর্মের শিক্ষকের মধ্যে এতো বন্ধুত্ত্ব ছিলো। স্যারের পড়ানোর ধরণ ছিলো গল্পের মতো। একদিন বললেন, “নীলা তোমার বইটা আনো।” নিয়ে যেতেই বললেন, কোন অধ্যায় শেষ হয়েছে? যেটা শেষ হয়েছে তার উপরে পড়া ধরতেন। আবার পরীক্ষাও নিতেন। স্যারেরও কলিগ হয়েছিলাম আমি। জানিনা আজ স্যার কোথায় আছেন।

হিন্দু ধর্মশিক্ষা ও সংস্কৃতের ক্লাশ নিতেন ধীরেন্দ্র স্যার এবং মাঝে-মধ্যে আমার মামনি, সকলের বড়ো দিদিমনি। স্যারের হৃদয় স্নেহময়তায় পরিপূর্ণ। পাঞ্জাবী আর ধুতি পড়তেন স্যার। স্যারের সাথে সেভাবে গল্প হতো না। কিন্তু সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন। “মানুষ আগে। মানুষদেরে ভালোবাসিও। ভগবান মানুষের ভেতরে। যে খারাপ কিছু করে, তারে বুঝাইতে হয়। এই যে তোমরা শয়তানী করো, আমি তোমরারে বুঝাই।” এসব কথা বলতেন।  তবে সবাই মামনির অপেক্ষায় থাকতো। খুব সুন্দর করে গল্পে গল্পে পড়াতেন মীরা ম্যাডাম, তাও সারাটি ক্লাশ ঘুরে ঘুরে। আগেই বলেছি,  দুই ধর্মশিক্ষকের মধ্যে এমন সৌহার্দ্য দেখেছি যা আজকের দিনে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!  কি জানি কেমন আছেন স্যার? ভালো থাকুন, এই তো চাই।

**পুনশ্চ, আমার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। বেশীদিন থাকেননি। কিন্তু উনি অনেক জ্ঞানী একজন শিক্ষক ছিলেন। উনার নাম ধীরেন্দ্র শীল। সবাইকে পড়াতেন না। নিজে থেকে বাপিকে বলে আমায় পড়াতে এলেন। এখনও মনে আছে উনি বলেছিলেন, ইংরেজী পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ভাষা। গ্রামের রাজনীতি এমনভাবে স্যারকে প্যাঁচিয়ে ফেলেছিলো, উনি ভারত চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু যাওয়ার আগে Tense-এর সব নোট আমায় দিয়ে যান। মামনিকে বলেছিলেন, “মেয়েটার পাশে থাকতে পারলাম না। কিন্তু আমার যতো শিক্ষা সবটুকু ওরে দিয়া গেলাম।” এবার নজরুল স্যারের কথা একটু বলে নেই। উনি বশির আহমেদ স্যারের পর প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। স্কুলের অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। ওখানে স্নেহ-ভালোবাসা আছে কিনা, সে খবর জানিনা। শুধু জানি এখন হিসেব চলে প্রাইভেট শিক্ষকতার।

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৫ জুলাই, ২০১৬ ইং।

যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন (মীরা দাস ম্যাডাম ও আত্তর আলী স্যার – চতুর্থ ভাগ)

৭২০জন ৭২০জন
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ