গতকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি খবর ভাইরাল হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে- "অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এফবিআই বোস্টনের হার্ভার্ড থেকে চার্লস লিবার নামক একজন অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করেছে, যিনি উহানের চীনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা ল্যাবের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে চীন কোরোনা ভাইরাসটি দিয়ে আসলে বায়ো অ্যাটাকের পরিকল্পনা করেছিল!"

আরো বলা হচ্ছে, চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সেই ল্যাবটিতে করোনা ভাইরাস কীভাবে তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে একাধিক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব রয়েছে। তত্ত্বটি সঠিক ছিল তা প্রমাণ করার জন্য এখন একটি ভিডিও সহ মেসেজটি সোশ্যাল মিডিয়ায় জনে জনে শেয়ার করা হচ্ছে।

খবরটি মোটেও সত্য নয়। এটি একটি মিথ্যে গুজব এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ আমরা না জেনেই খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইনবক্সে ভাইরাল করছি এবং জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছি যা মোটেও উচিত নয়।

চলুন আসল ঘটনাটি জানি-

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের (US Department Of Justice) এর ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত বিবৃতিতে দেখা যায়- অধ্যাপক লিবার, যিনি হার্ভার্ডের রসায়ন ও রাসায়নিক জীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি ২০১১ সালে উহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (WUT) এর "স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত বিজ্ঞানী" নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের জন্য বিজ্ঞানী প্রতিভা অন্বেষণ পরিকল্পনার চুক্তিভিত্তিক অংশগ্রহণকারী ছিলেন। চীনের বিজ্ঞান গবেষণার পরিধি বাড়ানোর জন্য প্রতিভা অন্বেষণ করা, যা উচ্চ-স্তরের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা নিয়োগ এবং তাদের যোগ্য করে তোলাই হচ্ছে এই প্রকল্পের মুল লক্ষ্যে।

আদালতের নথি অনুসারে, ২০০৮ সাল থেকে ডা. লিবার, যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিসার্চ গ্রুপের প্রধান তদন্তকারী হিসাবেও কাজ করতেন। ২০১১ সালের শুরুতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিবার চীনের উহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (WUT) এর একজন “Strategic Scientist বা কৌশলগত বিজ্ঞানী” হিসেবে নিয়োগ পান। অধ্যাপক লিবারের সাথে তিন বছরের প্রতিভা অন্বেষণ চুক্তির শর্তাবলীতে উহানের সেই টেকনোলোজি বিশ্ববিদ্যালয় (WUT) লাইবারকে প্রতি মাসে ৫০,০০০ ডলার প্রদান করে এবং তাকে উহানে একটি গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ১.৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি পুরষ্কার প্রদান করে। এর বিনিময়ে লাইবারকে এই প্রকল্পের পরিচালক ঘোষণা করা হয় যারা তরুণ শিক্ষক এবং পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করতো। চুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে বছরে কমপক্ষে নয় মাস WUT এর পক্ষে কাজ করা বাধ্যতামূলক।

চীনের বৈজ্ঞানিক বিকাশ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জাতীয় সুরক্ষার লক্ষ্যে উচ্চ-স্তরের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা গড়ে তোলার জন্য এই প্রতিভা অন্বেষণ প্রোগ্রামগুলিতে চীন বিদেশী প্রতিভা এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা চীনের জন্য কাজে লাগাতে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন গবেষণা সম্পর্কিত তথ্য চুরি করার জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের সবসময় গোপনে পুরস্কৃত করে থাকে।

লিবারের বিরুদ্ধে মুলত যে অভিযোগ -

অধ্যাপক লিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে লিবার তার WUT 'র প্রতিভা অন্বেষণ পরিকল্পনায় জড়িত থাকা এবং WUT এর সাথে নিজের সংযুক্ততা সম্পর্কে অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন। তদন্তকারীদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময়, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ তে তার সম্পর্কে, লিবার বলেছিলেন যে তাকে কখনই উহানের সেই প্রতিভা অন্বেষণ প্রোগ্রামে অংশ নিতে বলা হয়নি, তবে চীন কিভাবে তাকে পরিচালকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে তা তিনি নিশ্চিত নন।

নভেম্বর ২০১৮ তে যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইন্সটিটিউট ( NIH) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল যে, তারা অধ্যাপক লিবারকে তার চীনের প্রতিভা অন্বেষণ পরিকল্পনার সাথে তৎকালীন সন্দেহের সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল কিনা?

এর জবাবে হার্ভার্ড বলেছে- NIH কে এরকম মিথ্যা তথ্য বলতে অধ্যাপক লিবার আসলে হার্ভার্ডকে বাধ্য করেছিল। লিবার নিজে বাঁচার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে বলেছিল যে, ২০১২ সালের পর লিবারের WUT 'র সাথে কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না এবং চীন এর পরের বছরগুলিতেও WUT 'র সাথে লিবারের জড়িত থাকার কথা মিথ্যাভাবে অতিরঞ্জিত করে চলেছে। চীনের সেই প্রকল্পে লিবার নাকি কখনো ছিলেননা এবং অংশগ্রহণকারী হিসেবে তার নাম চীন কেন প্রকাশ্যে এনেছে তা তিনি জানেননা।

গত ১০ ডিসেম্বর ইয়াংকিং ও জাওসাং নামক দু'জন চাইনিজকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেফতার করা হয়। ইয়াংকিংকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চীনের কাছে পাচারের দায়ে এবং জাওসাংকে যুক্তরাষ্ট্র হতে ২১টি বায়োলজিক্যাল স্যাম্পল চীনে পাচারের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। তাদের গ্রেফতারের পরই অধ্যাপক লিবারের নাম সামনে চলে আসে। লিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে তথ্য পাচারের জন্যই চীনের কাছ থেকে প্রতিভাধর বিজ্ঞানী অন্বেষণ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে টাকা পেয়েছিলেন।

মূলত এই মিথ্যাচারের জন্যই এফবিআই অধ্যাপক লিবারকে গ্রেফতার করেছে।

অধ্যাপক লিবারের করোনাভাইরাস তৈরি সম্পর্কিত গ্রেফতারের সেই ভিডিওটির প্রচারণা যে বিভ্রান্তিকর এবং গুজব তা কিভাবে বুঝবেন-

প্রথমত, ভিডিওক্লিপটিতে শুধু এতটুকুই দেখানো হচ্ছে- যেখানে এফবিআই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অধ্যাপক চার্লস লিবার চীনের উহানের একটি বিজ্ঞান গবেষণায় নিজের যুক্ত থাকার তথ্য গোপন করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। ভাইরাল হওয়া মেসেজটিতে দেখানো হচ্ছে ও বলা হচ্ছে যে লিবার চীনে করোনাভাইরাস তৈরীতে জড়িত ছিলেন। অথচ পুরো ভিডিওটিও দেখানো হয়নি আর কোথাও কোন সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়নি যে লিবার নিজেই চীনে করোনাভাইরাস উদ্ভাবন ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন।

দ্বিতীয়ত, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ক্লিপের বার্তাটি WCVB-TV এর একটি বুলেটিনের সাথে শেয়ার করা হচ্ছে যা বিশ্বখ্যাত ABC- চ্যানেলের একটি অনুমোদিত টেলিভিশন স্টেশন। একটি অনুমোদিত টিভি ষ্টেশন এরকম বিভ্রান্তিকর বার্তা কখনোই ব্রেকিং নিউজ হিসেবে জনসম্মুখে প্রকাশ করবেনা, অন্তত এই করোনা দূর্যোগের সময়তো নয়ই। তাই ভিডিওটি যে ডাম্প করা হয়েছে বা এডিটিং করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে যেখানে তথ্যসূত্রেরও কোন উল্লেখ নেই তা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যে কেউই বুঝতে পারবেন।

তৃতীয়ত, বিখ্যাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও প্রকাশনা সংস্থা Quintillion Media Pvt.Ltd. তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে- "আমাদের হেল্পলাইন নম্বরটিতে অধ্যাপক লিবারের বার্তাটি যাচাই করতে একাধিক ফোনকল আমরা পেয়েছি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফেসবুকে থাকা সেই বার্তাগুলি অধ্যাপক চার্লস লিবারকে কেন অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং গুজব রটিয়ে কেন এই মামলাটিকে এমনকরে মিথ্যেভাবে ব্যাপক কভারেজ দেওয়া হয়েছিল তা নির্ধারণ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল না। আমরা The New York Times, ABC, Bloomberg এসব সংস্থা থেকেও এই মামলার বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে পেয়েছি। তাদের প্রতিবেদনগুলির কোনটিই ভাইরাল বার্তায় প্রদত্ত বিবরণগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।"

চতুর্থত, ভাইরাল বার্তায় যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, প্রফেসর চার্লস লিবারকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তিনি চীনকে করণাভাইরাস তৈরি ও বিক্রয়ে সহায়তা করছেন বলে নয়। তিনি বৈজ্ঞানিক নিয়োগের জন্য চীনা সরকারের কর্মসূচির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মিথ্যাচার করেছিলেন তাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লেখা আছে।

পঞ্চমত, অধ্যাপক লিবারের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগে এটাও বলা হয়েছে যতক্ষণ তার দোষ প্রমানিত হবেনা ততক্ষণ তাকে কোনভাবেই দোষী বলা যাবেনা। ABC চ্যানেলের মত একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও মানসম্পন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক সহ দায়িত্ববান কেউই এমন সংবাদ প্রচার করে নিজেদেরকে আইনের কাছে দোষী সাব্যস্ত করবেনা নিশ্চিত।

সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে যে, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যেখানে ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল, ল্যাপটপ সবার হাতের মুঠোয় সেখানে পৃথিবীব্যাপী ভাইরাল হওয়া যেকোন খবরের সত্যনিষ্ঠতা মূহুর্তেই যাচাই করা যায় fact checking এর মাধ্যমে। ফ্যাক্ট চেক অধ্যাপক চার্লস লিবার এ ক্লিক করলে যেখানে এই ভিডিওক্লিপটি সত্য নয় বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। চাইলে দেখে আসতে পারেন।

আশাকরি এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সবারই এই গুজব এবং মিথ্যাচার সম্পর্কে ভুলধারণাগুলির অবসান ঘটবে। করোনা সম্পর্কিত যে কোন তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ রয়েছে Coronavirus fact checking এর মাধ্যমে। তাই নিজেই যাচাই করুন এসব তথ্য। কারন জনমনে ভীতি ছড়ানোর দায়ে আপনিও গ্রেফতার হতে পারেন কিন্তু!

করোনায় ঘরবন্দি এই বিষণ্ণ সময়ে যেকোন গুজব আমাদের সবাইকেই সংবেদনশীল করে তোলে। তাই মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, অসত্য গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন। নিজেরা সচেতন হোন, অন্যদেরকেও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন।

তথ্যসূত্রঃ

লেখার নীল কালি চিহ্নিত লাইনগুলি ক্লিক করুন।

 

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ