রঙ্ধনু আকাশ (১২তম পর্ব)

ইঞ্জা ১১ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:২২:০৫অপরাহ্ন গল্প ৩৩ মন্তব্য

মেট্রোপলিটন হাসপাতালে পোঁছেই গাড়ি থেকে নেমে রুদ্র জামালকে নিয়ে রিসেপশনে গিয়েই পেলো রুদ্রর মাকে, রুদ্র বললো, মম জানতে পেরেছো কোথায় আছেন উনি?

হাঁ, সুলতান ভাইকে সিসিইউতে রাখা হয়েছে, চল উপরে যায়। 

রুদ্ররা কুমু আন্টিদের ফলো করে লিফটে চেপে চার তলায় উঠে এলো, লিফটের দরজা খুলে গেলে রুদ্র দেখলো অনিলা বসে আছে, ওর আসেপাশে আরও কিছু মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, রুদ্র পাশে গিয়ে ঝুকে বললো, তুমি ঠিক আছো অনিলা?

অনিলা মাথা তুলে তাকালো রুদ্রের দিকে, এরপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো, ঘিরে থাকা মানুষরা একটু সরে গেলে রুদ্রর মা অনিলার পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললেন, এইভাবে কাঁদলে হবে মা, তোমার বাবা অসুস্থ হতেই পারেন, সুস্থও হয়ে উঠবেন। 

স্যার কোথায়, রুদ্র জিজ্ঞেস করলো।

অনিলা রুদ্রর মাকে বললো, আন্টি চলুন বাবাকে দেখবেন, রুদ্র আসো বলেই অনিলা উঠে গিয়ে পাশের দরজার সামনে গিয়ে পায়ের সেন্ডেল খুলে রাখলো, দেখাদেখি রুদ্র আর তার মা জুতা সেন্ডেল রেখে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ভিতরে। 

 

পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সিসিইউ রুমটির প্রথম বেডেই রাখা হয়েছে অনিলার বাবাকে, মুখে অক্সিজেনের টিউব, হাতে অক্সিমিটার, স্যালাইন লাগানো। 

রুদ্র পাশে গিয়ে দাঁড়ালে উনি চোখ খুলে রুদ্রকে দেখে একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন, রুদ্র হাতটি নিজের হাতে নিয়ে হালকা চাপ দিলো, যেন অভয় দিলো।

সুলতান সাহেব কিছু বলতে চাইলে রুদ্র মাথা নিচু করে শুনার চেষ্টা করলো। 

সুলতান সাহেব খুব ধীরেধীরে বললেন, আমার মেয়েটিকে দেখে রেখো, ও খুব অভাগী। 

রুদ্র হাতে ধীরে আরেকটা চাপ দিয়ে বললো, স্যার আপনি টেনশন নিয়েন না, আপনি রেস্ট করুন, আমি আছি আপনার পাশে৷ 

রুদ্র সরে দাঁড়ালে রুদ্রর মা পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, রুদ্রর মাকে দেখে অনিলার বাবার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। 

মম তুমি থাকো আমি আসছি, বলেই রুদ্র অনিলাকে ইশারা করে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো, অনিলাও পিছ পিছ এলে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, এইখানকার ডিউটি ডাক্তার কোথায় বসে? 

এই সামনেই, আসো। 

রুদ্র অনিলাকে ফলো করে ডিউটি ডাক্তারের রুমের সামনে গেলে দুজনেই ভিতরে প্রবেশ করলো।

সালামালেকুম ডক্টর। 

ওয়া আলাইকুম আসসালাম, আরেহ রুদ্র ভাইয়া আপনি এখানে?

 

আরেহ নয়ন, তুমি ডাক্তারি পড়ছো জানতাম কিন্তু চট্টগ্রামে কেন?

নয়ন রুদ্রদের পাড়ার ছোটো ভাই, নয়নের বড় ভাই আবার রুদ্রর বন্ধু।

ভাইয়া ভালো চাকরি পেয়েই জয়েন করেছি গতবছর। 

তাই খুব ভালো। 

বসেন ভাইয়া। 

রুদ্র অনিলাকে নিয়ে বসলো। 

ভাইয়া ঢাকা থেকে কবে এলেন? 

আজ দুপুরেই এসেছি, তা তোমাকে পেয়ে ভালো হলো। 

বলুন ভাইয়া কি হেল্প করতে পারি?

এক নাম্বার বেডের সুলতান সাহেবের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলাম, উনার সমস্যাটা জানতে চাইছিলাম। 

ভাইয়া উনার ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে আনার আগেই, আমরা মেডিকেট করেছি, উনার অক্সিজেন লেভেল কম ছিলো। 

এখন কি অবস্থা? 

এই মুহূর্তে তা বলা সম্ভব নয় ভাইয়া, উনার কিছু টেস্ট করতে দিয়েছি, টেস্ট গুলোর রিপোর্ট আসুক, এছাড়া উনাকে বাহাত্তর ঘন্টা অবজারভেশনে না রাখলে কিছুই বলা সম্ভব না। 

তা উনাকে কোন সিনিয়র ডাক্তার দেখছেন?

হাঁ উনাকে সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. আক্তার জামান স্যার দেখছেন। 

রুদ্র নিজের বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বললো, সুবিধা অসুবিধা জানিও আমাকে, উঠি এখন।

জ্বি ভাইয়া, সালামালেকুম।

 

রুদ্র অনিলা আর মাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো সিসিইউ থেকে, অনিলার পরিচিতরা বেশিরভাগ বিদায় নিয়ে চলে গেছে, দুই তিনজন চেয়ারে বসে আছে আর কুমু আন্টিরা বসে আছেন। 

রুদ্র আর তার মা অনিলাকে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়ালো, রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, স্যারের কি আগে থেকেই সমস্যা ছিলো?

অশ্রুসজল চোখে অনিলা বললো, না। 

তাহলে হটাৎ  এমন হলো কেন? 

আসলে আব্বু আমার বিয়ের সব দেখভালে ব্যস্ত ছিলেন, একটা ফোন এলে উনি রিসিভ করে কথা বলছিলেন, হটাৎ উনি আমাকে ডাক দিলে আমি উনার পাশে যায়, উনি বললেন যে, অপু মানে যার সাথে আমার বিয়ের কথা ছিলো, সে নাকি আমেরিকাতে আরেকটা বিয়ে করেছে।

কি বলছো, রুদ্র আশ্চর্য হলো।

এরপর আব্বু  অপুর বাবাকে ফোন দিলে, অপুর বাবা মুখের উপর বললেন, এমন বিয়ে নাকি আমেরিকাতে থাকতে গেলে করতে হয়, তখন আব্বু খুব রেগে গিয়ে বললেন অমন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না, বলতে বলতেই আব্বু বুক ধরে বসে পড়েন, এরপর আমরা উনাকে এখানেই নিয়ে এসেছি। 

আহ, দুঃখিত, রুদ্র উদ্বীগ্ন হলো।

 

অনিলা কিছু সময় পর ভিতরে চলে গেলে জামাল এসে সালাম দিলো রুদ্রর মাকে, এরপর রুদ্রকে বললো, দোস্তো আমি এখন আসি। 

ঠিক আছে বন্ধু যা। 

জামাল চলে গেলে রুদ্র ওর মাকে বললো, মম তুমি কি হোটেলে যাবে নাকি আন্টির ওখানে থাকবে। 

ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনা বাবা, আমি তোর আন্টির ওখানে থেকে যাবো আজকে। 

এখনো তো নিশ্চয় খাওনি, তোমরা চলে যাও, কাল দেখা হবে। 

তা যাবো, তুই কি থাকবি আরও কিছুক্ষণ?  

দেখি অনিলার সাথে কথা বলে, অনিলা আসলে বিদায় নিয়ে চলে যাও, ঐ যে অনিলা আসছে। 

অনিলা কাছে আসলে রুদ্র বললো, মম চলে যাক, তোমার কিছু লাগবে?

না না কিছু লাগবেনা, আন্টি যান রেস্ট করুন। 

রদ্রর মা অনিলার মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো, তোমার কিছু লাগলে জানিও মা, আজ আসি।

রুদ্রর মা চলে গেলে অনিলা বললো, তুমিও যাও রেস্ট করো। 

কিছু তো খাওনি নিশ্চয়, আমি কিছু নিয়ে আসছি।

না না আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছেনা। 

তাই, ঠিক আছে আমি আসছি বলেই রুদ্র লিফটের দিকে এগুলো। 

 

আধা ঘন্টার মধ্যেই রুদ্র ফিরে এসে দেখলো অনিলা বাইরে নেই, রুদ্র জুতা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে উঁকি দিলে সামনেই দেখলো অনিলাকে, রুদ্র ইশারা করে বাইরে ফিরে এলে অনিলাও পিছ পিছ ফিরে এলো। 

কি ব্যাপার তুমি ফিরে এলে?

রুদ্র অনিলার হাত ধরে চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসালো, এই নাও এগুলো খাও। 

এগুলো কি?

খুলেই দেখোনা। 

অনিলা প্যাকেট খুলেই দেখলো ভিতরে ফ্রাইড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, এইসব দেখে অনিলা বললো, বললাম না খিদে নেই। 

তোমার চেহেরা তা বলেনা, জানি এতক্ষণে খিদে লেগেছে তোমার, খাও। 

অনিলার চোখ ভরে জল এসে গড়িয়ে পড়লো আর তা দেখে রুদ্র বললো, আমি জানি তোমার আজ সবচেয়ে দুঃখের দিন, এই দুঃখের ভাগ কেউ নেবেনা কিন্তু বন্ধু হিসাবে তোমার পাশে তো থাকতে পারি। 

অনিলা রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করলো। 

কেঁদে যদি মনকে হাল্কা করতে চাও তবে কেঁদে বুক ভাসাও, আর যদি নিজেকে ঠিক রাখতে চাও, এই কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করো, তোমার জয় নিশ্চিত। 

 

আব্বু ঠিক হয়ে যাবে তো, অনিলা ছলছল চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে। 

শতভাগ ঠিক হয়ে যাবে, তুমি নিশ্চিত থাকো স্যারের কিছুই হবেনা। 

আল্লাহ যেন তাই করেন। 

আচ্ছা এখন কথা না বলে তুমি খেয়ে নাও। 

তুমি খেয়েছো? 

না খাইনি, পরে খাবো। 

এখানে তো অনেক আছে, তুমিও খাও। 

না আমি হোটেলে ফিরেই খাবো, এইতো পাশেই পেনিন্সুলায় উঠেছি, তুমি খাও।

অনিলা মাথা নেড়ে খেতে শুরু করলো। 

জানো আমি ভাবতেই পারছিনা অপু এমন ভাবে চিট করবে, ফোনে কতো সুন্দর সুন্দর কথা, আমি ওকে পেলেই খুন করবো। 

আচ্ছা কোরো, এখন খাএ, পুরাটা শেষ করবে বলেই পেকেট থেকে পানির বোতল বের করে ঢাকনা খুলে দিলো। 

খাওয়া শেষে প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ফেকে দুজনেই ভিতরে গেলো, অনিলার বাবা পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছেন। 

আব্বুকে ওরা ঘুমানোর জন্য মেডিসিন দিয়েছে, ফিসফিস করে অনিলা বললো। 

দুজনেই বেরিয়ে এলে রুদ্র বললো, তুমি কি সারা রাত থাকবে এখানে? 

অনিলা মাথা নেড়ে সায় দিলে রুদ্র বললো, আচ্ছা থাকো আমি সকাল সকাল চলে আসবো।

ওকে, রুদ্র ধন্যবাদ তোমাকে।

আসি। 

এসো। 

 

......... চলবে। 

ছবিঃ কালেক্টেড  

0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ