সারিস্কা বনে টাইগার জোন খ্যাত চিতলে পৌছার আগেই বেশ কিছু ওয়াইল্ডলাইফ ছবি আমার ঝুলিতে সংগ্রহ হওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। মনের ভিতর আনন্দ চলে আসে। সাপের ছবি তোলার পর আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি চিতলে যাবার জন্য। ভারতের রাজস্থান রাজ্যটাই পাথরের পাহাড়। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এই পাহাড়ের পাথর কেটে তারা বাড়ি ঘরের মোজাইক পাথর করে। গাইড রতন কৈরালার কাছে জানতে পারলাম তিন থেকে চার রঙ্গা পাথরের পাহাড় আছে রাজস্থানে। পাহাড়ি বনের ভিতর পাথর কেটে রাস্তা বানিয়েছে ভারতীয় বন বিভাগ। যে কারনে গাড়ির গতি কম। গতি কম থাকায় আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমরাও দুই নয়নে দুইপাশের সব কিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছি।
প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে নজরে এলো ময়ূর। দেশের চিড়িয়াখানা ছাড়া ময়ূর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রায় ৬০/৭০টা ময়ূর-ময়ূরী পানির সামনে নাচানাচি করছে। কেউ কেউ পানি খাচ্ছে। বনের ভিতর বন বিভাগ পানি ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু জলাধার তৈরী করেছে। যাতে বণ্যপ্রানীরা তাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারে। বণ্যপ্রাণী ও পাখিদের জন্য পানি অপরিহার্য। ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এই প্রানীগুলি পানির অভাবে থাকে। কারন তখন শুষ্ক মৌসুম। খরার কারনে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্রানীগুলি পানির অভাবে মারা যায়। এমন অনেক ইতিহাস আছে। তাই বিশ্বের সব বনেই পশু-পাখিদের জন্য ছোট ছোট জলাধার বানিয়ে রাখে। এই মৌসুমটায় পাখিদের রোজ গোসল করতে হয়। এমনিতেই এদের শরীরের তাপমাত্রা বেশী। তাই চৈত্রের দাবানলে প্রানীগুলি গরম সহ্য করতে না পারায় মারা যায়। বৈশাখ থেকে শুরু হয় বেশ কিছু প্রজাতি পাখির প্রজননকাল। তখন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। মোটামোটি বৃষ্টিপাত হয়। এই সময় গাছের পাতায় বা খোড়লে বা জমিনে পানি জমে থাকে। প্রানীগুলি পানির অভাব তেমন অনুভব করে না। আবার অনেক পাখির ডিমে তা দিতে পানি অপরিহার্য। যেমন মুনিয়ার ৭ প্রজাতির পাখি ভিজা শরীরে ডিমে তা দেয়। শরীর ভিজা না রেখে ডিমে বসবেই না। আবার দীর্ঘক্ষন সময় ডিম থেকে দুরে থাকলে ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই প্রজাতির পাখিরা কোন ডোবা বা পানি আছে এমন জায়গায় বাসা বানায়। মে থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত সব পাখির প্রজনন সময়। পাখি নিয়ে কাজ ও গবেষনা থেকে এই তথ্যগুলি পেয়েছি ও জেনেছি বলেই পাঠকদের জানাতে পারলাম। প্রকৃতির সাথে মিল রেখে সৃষ্টিকর্তা প্রানীদের বংশ বৃদ্ধির সময় ও ক্ষন নির্ধারন করে দিয়েছেন।
পুরুষ ময়ূর।
ময়ূরের ছবি তুলতে তুলতে চিতল স্পটে চলে আসলাম। গাইড রতন আমাদেরকে কিছু ব্রিফ করলো। প্রথম শর্ত কোন অবস্থাতেই বনের মাটিতে পা রাখা যাবে না। বাঘের দেখা পেলে কোন সাড়া শব্দ করা যাবে না। যদিও বাঘ টার্গেট শিকার করে তারপরও সামনে পড়লে ও সাড়া শব্দ করলে বাঘ ধরে নেয় তাকে আক্রমন করবে। তাই সে নিজের রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এটাই বাঘের চরিত্র। আরো বললো বাঘ আমাদের দেখতে পেলে সে উঠে যাবে বা হাঁটা শুরু করবে। আবার এমনও হতে পারে চিতলে আশে পাশে ঝোপ-ঝাড়ে বাঘ আছে। বাঘ আমাদের দেখতে পাচ্ছে অথচ আমরা দেখছি না। রতন আমাদের যা বললো তা আমাদের সবারই জানা। আমরা সুন্দরবনে ভ্রমনের সময় বাঘ সম্পর্কে সম্যক ধারনা নিয়েই যাই।
বাঘ মূলতঃ নিশাচর প্রানী। রাতের বেলায় শিকার করে। সারাদিন সেই শিকারের নরম অংশগুলি খায়। পরে প্রাণীর বাকি দেহ পাতা দিয়ে বনের ভিতর ঢেকে রাখে। চার থেকে পাঁচদিন পর শিকারের দেহে পঁচন ধরলে আবার খাওয়া শুরু করে। এই ভাবে একটি শিকার ৭/৮দিন সময় নিয়ে খায়। এটাই বাঘের খাদ্যাভ্যাস।
বাঘ খুবই অলস প্রাণী। পেট ভরে খাবারের পর বেশ কয়েকদিন সারাদিন শুয়ে বসে কাটাবে। যতক্ষন পর্যন্ত ক্ষুধা না ধরবে ততক্ষন পর্যন্ত তার শিকার করা প্রানীটির ধার কাছেও যাবে না। শুধু মাত্র পানি খাওয়ার জন্য দিনের বেলায় নদীর ধারে বা বনের ভিতর জলাধারের কাছে আসবে। বাঘ মিঠা পানি পান করে। আমাদের দেশে সুন্দরবনের যে নদী আছে সেটার পানি লবনাক্ত। তাই বনরক্ষীরা কচিখালি ও কটকায় বেশ কিছু পুকুর কেটে জলাধার তৈরী করেছে। যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। ঠিক তেমনি দেখলাম চিতলে বেশ কিছু ছোট ছোট পুকুর। পরিবেশ দেখ বুঝতে কষ্ট হলো না এটা যে বাঘের জোন।
রতন বাঘ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে ড্রাইভারকে ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হতে বললো। আমরা সবাই পাথরের মূূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। পরস্পরের মধ্যে দেখা-দেখিও নাই। সবাই পিনঃপতন চুপ। আমার ভিতর এক অজানা উত্তেজনা কাজ শুরু করলো। মনের ভিতর নানান প্রশ্ন জন্মালো। ভাবছি যদি বাঘ দেখি তাহলে প্রথমে কি করবো? বাঘটার দৈর্ঘ্যে কত বড় হতে পারে?
ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে সাহস ও চোখের জ্যোতি বড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘মনে সাহস ও চোখের জ্যোতি বড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।’
শেষ লাইনে শব্দ ব্যাবহারের মুন্সিয়ানা দেখে আনন্দিত হলাম (আগে দেখিনি বলে)।
মুনিয়ার ভেজা গায়ে ডিমে তা দেয়ার কথা জানলাম।
কিছু পাহাড় দেখতে মন চায়, বর্ণনা শুনে!
চলুক।
এবার মনে হয় মামা দেখা মিলতে যাচ্ছে, অপেক্ষায় আছি আমরা।
দুইবার সুন্দরবনে গিয়ে কতো যে মামাকে খুজেি তার কোন ইয়ত্তা নেই। লঞ্চের মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওনি সুন্দর বনের ভেতর যেহেতু লঞ্চ চালায় মামার সাথে দেখা হয়েছে কিনা। ওনার বক্তব্য হলো সাতাশ বছর সুন্দর বনের লঞ্চ চালিয়ে মাত্র তিনবার মামার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। সুতরাং আমরা যেন আশা না করি 🙂
২০টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মুনিয়ার ভেজা শরীরে তা দেয়া, বাঘের খাদ্যাভাস বিস্তারিত জেনে খুব ভাল লাগলো । আপনাদের ভ্রমণ সফল হোক শুভ কামনা রইলো
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ দিদিভাই। ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
জানলাম নতুন কিছু
শামীম চৌধুরী
আপনার জানায় নিজেকে খুব ভাগ্যমান মনে হচ্ছে মহী ভাই। ভাল থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
‘মনে সাহস ও চোখের জ্যোতি বড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।’
শেষ লাইনে শব্দ ব্যাবহারের মুন্সিয়ানা দেখে আনন্দিত হলাম (আগে দেখিনি বলে)।
মুনিয়ার ভেজা গায়ে ডিমে তা দেয়ার কথা জানলাম।
কিছু পাহাড় দেখতে মন চায়, বর্ণনা শুনে!
চলুক।
শামীম চৌধুরী
চলুন কোন এক সময় যাওয়া যাবে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাহ্!
অসাধারণ বর্ণনা আর সর্তকতা অবলম্বন করে প্রবেশ।
ময়ূর,বাঘ সম্পর্কে জানলাম দাদা।
বেশ ভালো লাগলো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ দাদাভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
চলুক, সাথে আছি 🙂
একেকপর্বে জেনে যাচ্ছি অভিযানের অনুভূতি গুলো,
শুভ কামনা রইলো শামীম ভাই 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
সাবিনা আপু আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা। ভাল থাকুন।
তৌহিদ
আজ অনেক কিছু জানলাম লেখা থেকে। ময়ূরের ছবিটি অসাধারণ কিন্তু! বাঘমামা দেখার অনুভূতি নিয়ে আপনার এই ধারাবাহিক লেখাটি দারুণ হচ্ছে ভাই।
শুভকামনা সবসময়।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ তৌহিদ। শুভকামনা সবসময়।
ইঞ্জা
আমি তখন ছোটো, আমার মেঝো চাচার বাসায় ময়ূর পালতো, তখন সামনা সামনি দেখেছি, তিতিরও পালতেন উনারা, ভেজা শরীরে মুনিয়া জাতের পাখি ডিমে তা দেয় শুনে অবাক হলাম।
অপেক্ষায় রইলাম ভাই।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইজান। বনের ময়ূর এই প্রথম দেখলাম।
ইঞ্জা
এ আপনার সৌভাগ্য ভাই
হালিম নজরুল
মামা দেখার একটি ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল। দুই একদিনের মধ্যে লিখব ইনশাআল্লাহ।
শামীম চৌধুরী
অপেক্ষায় রইলাম কবি ভাইজান।
কামাল উদ্দিন
এবার মনে হয় মামা দেখা মিলতে যাচ্ছে, অপেক্ষায় আছি আমরা।
দুইবার সুন্দরবনে গিয়ে কতো যে মামাকে খুজেি তার কোন ইয়ত্তা নেই। লঞ্চের মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওনি সুন্দর বনের ভেতর যেহেতু লঞ্চ চালায় মামার সাথে দেখা হয়েছে কিনা। ওনার বক্তব্য হলো সাতাশ বছর সুন্দর বনের লঞ্চ চালিয়ে মাত্র তিনবার মামার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। সুতরাং আমরা যেন আশা না করি 🙂
শামীম চৌধুরী
লঞ্চের সুকানী সত্যটাই বলেছেন। ১১ বার যেয়েও মামার দেখা পাইনি সুন্দরবনে। আমাদের একজন ৬০ বার গিয়েছেন। একাবারও মামার দেখা পাননি।
জিসান শা ইকরাম
অনেক কিছু নতুন জানছি আপনার পোস্টের মাধ্যমে।
ধন্যবাদ আপনাকে শামীম ভাই।
শুভ কামনা।