মামাকে দেখতে যাওয়া- পর্ব(৫)

শামীম চৌধুরী ২০ মে ২০২০, বুধবার, ০২:১৪:১৯পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ২০ মন্তব্য
সারিস্কা বনে টাইগার জোন খ্যাত চিতলে পৌছার আগেই বেশ কিছু ওয়াইল্ডলাইফ ছবি আমার ঝুলিতে সংগ্রহ হওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। মনের ভিতর আনন্দ চলে আসে। সাপের ছবি তোলার পর আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি চিতলে যাবার জন্য। ভারতের রাজস্থান রাজ্যটাই পাথরের পাহাড়। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এই পাহাড়ের পাথর কেটে তারা বাড়ি ঘরের মোজাইক পাথর করে। গাইড রতন কৈরালার কাছে জানতে পারলাম তিন থেকে চার রঙ্গা পাথরের পাহাড় আছে রাজস্থানে। পাহাড়ি বনের ভিতর পাথর কেটে রাস্তা বানিয়েছে ভারতীয় বন বিভাগ। যে কারনে গাড়ির গতি কম। গতি কম থাকায় আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমরাও দুই নয়নে দুইপাশের সব কিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছি।
 
প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে নজরে এলো ময়ূর। দেশের চিড়িয়াখানা ছাড়া ময়ূর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রায় ৬০/৭০টা ময়ূর-ময়ূরী পানির সামনে নাচানাচি করছে। কেউ কেউ পানি খাচ্ছে। বনের ভিতর বন বিভাগ পানি ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু জলাধার তৈরী করেছে। যাতে বণ্যপ্রানীরা তাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারে। বণ্যপ্রাণী ও পাখিদের জন্য পানি অপরিহার্য। ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এই প্রানীগুলি পানির অভাবে থাকে। কারন তখন শুষ্ক মৌসুম। খরার কারনে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্রানীগুলি পানির অভাবে মারা যায়। এমন অনেক ইতিহাস আছে। তাই বিশ্বের সব বনেই পশু-পাখিদের জন্য ছোট ছোট জলাধার বানিয়ে রাখে। এই মৌসুমটায় পাখিদের রোজ গোসল করতে হয়। এমনিতেই এদের শরীরের তাপমাত্রা বেশী। তাই চৈত্রের দাবানলে প্রানীগুলি গরম সহ্য করতে না পারায় মারা যায়। বৈশাখ থেকে শুরু হয় বেশ কিছু প্রজাতি পাখির প্রজননকাল। তখন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। মোটামোটি বৃষ্টিপাত হয়। এই সময় গাছের পাতায় বা খোড়লে বা জমিনে পানি জমে থাকে। প্রানীগুলি পানির অভাব তেমন অনুভব করে না। আবার অনেক পাখির ডিমে তা দিতে পানি অপরিহার্য। যেমন মুনিয়ার ৭ প্রজাতির পাখি ভিজা শরীরে ডিমে তা দেয়। শরীর ভিজা না রেখে ডিমে বসবেই না। আবার দীর্ঘক্ষন সময় ডিম থেকে দুরে থাকলে ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই প্রজাতির পাখিরা কোন ডোবা বা পানি আছে এমন জায়গায় বাসা বানায়। মে থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত সব পাখির প্রজনন সময়। পাখি নিয়ে কাজ ও গবেষনা থেকে এই তথ্যগুলি পেয়েছি ও জেনেছি বলেই পাঠকদের জানাতে পারলাম। প্রকৃতির সাথে মিল রেখে সৃষ্টিকর্তা প্রানীদের বংশ বৃদ্ধির সময় ও ক্ষন নির্ধারন করে দিয়েছেন।
পুরুষ ময়ূর।
ময়ূরের ছবি তুলতে তুলতে চিতল স্পটে চলে আসলাম। গাইড রতন আমাদেরকে কিছু ব্রিফ করলো। প্রথম শর্ত কোন অবস্থাতেই বনের মাটিতে পা রাখা যাবে না। বাঘের দেখা পেলে কোন সাড়া শব্দ করা যাবে না। যদিও বাঘ টার্গেট শিকার করে তারপরও সামনে পড়লে ও সাড়া শব্দ করলে বাঘ ধরে নেয় তাকে আক্রমন করবে। তাই সে নিজের রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এটাই বাঘের চরিত্র। আরো বললো বাঘ আমাদের দেখতে পেলে সে উঠে যাবে বা হাঁটা শুরু করবে। আবার এমনও হতে পারে চিতলে আশে পাশে ঝোপ-ঝাড়ে বাঘ আছে। বাঘ আমাদের দেখতে পাচ্ছে অথচ আমরা দেখছি না। রতন আমাদের যা বললো তা আমাদের সবারই জানা। আমরা সুন্দরবনে ভ্রমনের সময় বাঘ সম্পর্কে সম্যক ধারনা নিয়েই যাই।
 
বাঘ মূলতঃ নিশাচর প্রানী। রাতের বেলায় শিকার করে। সারাদিন সেই শিকারের নরম অংশগুলি খায়। পরে প্রাণীর বাকি দেহ পাতা দিয়ে বনের ভিতর ঢেকে রাখে। চার থেকে পাঁচদিন পর শিকারের দেহে পঁচন ধরলে আবার খাওয়া শুরু করে। এই ভাবে একটি শিকার ৭/৮দিন সময় নিয়ে খায়। এটাই বাঘের খাদ্যাভ্যাস।
 
বাঘ খুবই অলস প্রাণী। পেট ভরে খাবারের পর বেশ কয়েকদিন সারাদিন শুয়ে বসে কাটাবে। যতক্ষন পর্যন্ত ক্ষুধা না ধরবে ততক্ষন পর্যন্ত তার শিকার করা প্রানীটির ধার কাছেও যাবে না। শুধু মাত্র পানি খাওয়ার জন্য দিনের বেলায় নদীর ধারে বা বনের ভিতর জলাধারের কাছে আসবে। বাঘ মিঠা পানি পান করে। আমাদের দেশে সুন্দরবনের যে নদী আছে সেটার পানি লবনাক্ত। তাই বনরক্ষীরা কচিখালি ও কটকায় বেশ কিছু পুকুর কেটে জলাধার তৈরী করেছে। যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। ঠিক তেমনি দেখলাম চিতলে বেশ কিছু ছোট ছোট পুকুর। পরিবেশ দেখ বুঝতে কষ্ট হলো না এটা যে বাঘের জোন।
 
রতন বাঘ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে ড্রাইভারকে ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হতে বললো। আমরা সবাই পাথরের মূূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। পরস্পরের মধ্যে দেখা-দেখিও নাই। সবাই পিনঃপতন চুপ। আমার ভিতর এক অজানা উত্তেজনা কাজ শুরু করলো। মনের ভিতর নানান প্রশ্ন জন্মালো। ভাবছি যদি বাঘ দেখি তাহলে প্রথমে কি করবো? বাঘটার দৈর্ঘ্যে কত বড় হতে পারে?
ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে সাহস ও চোখের জ্যোতি বড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
 
( চলবে )
0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ