পূষনকে লেখা চিঠি

আসিফ ইকবাল ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, সোমবার, ০১:১৯:১৩পূর্বাহ্ন চিঠি ১৬ মন্তব্য

প্রিয় পূষন,

আমার ক্যাম্পের চারপাশে বরফের ধূ ধু মরুভূমি। তুমি নেই, বিদায় নিয়েছ মকর সংক্রান্তির দীর্ঘতম রাতে, এখন নক্ষত্রের মিটিমিটি আলোয় সামান্যই অন্ধকার কাটে। যেন চির ভোরের দেশে এসে পড়েছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে নক্ষত্রের আলো বরফের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে সুবহে সাদিকের মতো এক রকম নীল আলোর প্লাবন বয়ে যায়, মনে হয় একটু পরেই সকাল হবে, এই বুঝি সকাল হলো- কিন্তু সকাল আর হয় না, ওভাবেই ঝুলে থাকে সময়, যেন মাকড়শার জালে আটকে গেছে এক কাঁচপোকা, কিছুতেই আর ছুটতে পারছে না। আর তুষারের ঝড় যখন আসে তখন সেই সামান্য আলোটুকু-ও শুষে নেয় হিমের কণাগুলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয় না অবশ্য, কেমন একরকম ঘোলাটে আলো উড়ে উড়ে যায়, ঝড়ের তাণ্ডবে। বাতাস, বাতাসের কথা কি আর বলবো? এখানে অতৃপ্ত আত্মার মতো নাচন উঠিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে ওড়ে সে, প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাসের মতো ইনিয়ে ইনিয়ে কি বলতে চায় বুঝতে পারি না, সেই ভাষা আমার জানা নেই। সবিতা, তোমার এই নামটাই সবচেয়ে কোমল, এই ভুতুড়ে অক্ষাংশে কেউ না এলে কখনো বুঝতেই পারবে না, কেন তোমাকে সবিতা বলে ডাকে! তুষারের ঘূর্ণি যখন মাতালের মত নেচে নেচে হুহু করে একদম হাড়ের ভেতরে ঢুকে যেতে চায়, যখন মনে হয় পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে সমস্ত উত্তাপ, তখন- ঠিক তখন তোমার আগুনের মতো লাল আঁচলের নীচে মাথা গুঁজে দিয়ে তোমার বুকের জীবনদায়িনী, পুষ্টিদায়িনী উষ্ণতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা এইজন্যেই কি তোমার নাম পূষন? তুমি পোষণ করো, পুষ্টি দাও, তাই?

প্রিয় পূষন, তোমার কি মনে আছে সেই বৈশাখী মেলার কথা? তখন তুমি আমার আপু ছিলে। হাত ধরে ধরে নিয়ে গিয়েছিলে মেলার কোলাহলে। তোমার সমুজ্জ্বল মুখে ছিল অমিতাভ দীপ্তি। দুধের মতো সাদা কদমা, তেলতেলে বাঁশের বাঁশি, এক টুকরো চামড়ার ডুগডুগি কিনে ফেরার পথে আর হাঁটতে পারছিলাম না, তুমি কোলে তুলে নিলে, গরমে আমি ঘেমে-নেয়ে একাকার, তবু তোমার উঁচু-নীচু, পাহাড়ী বুকের মাঝখানে মুখ গুঁজে ছিলাম সারাটা পথ, কিছুতেই মুখ সরাবো না। আর তুমি হেসে অস্থির। কেমন পাগল ছেলে দেখ! আর আমার যে ঈশ্বর, তিনি তো তোমার-ও ঈশ্বর, তিনিও সেদিন হাসছিলেন খুব, আর তাইতেই তো আকাশটা হয়ে উঠেছিল ঘন নীল। প্রিয় পূষন, আমি বড় হতে হতে তোমাকে ছুঁয়ে ফেললাম একদিন, তুমি আগের মতোই রয়ে গেলে। তোমার বয়স বাড়ে না। তোমার আগুন কখনো নেভে না। তোমার দীপ্তি কখনো ম্লান হয় না।

শুনেছি তুমি দক্ষিণে চলে গেছো, পরিযায়ী পাখীর মতো, নিম্নতর অক্ষাংশের দিকে। ফিরবে নাকি ছয় মাস পরে! এতদিন আমি টিকবো তো? ক্যাম্পের চারপাশে নেকড়ে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন অথবা সারারাত। দিন রাতের হিসেব এখানে অর্থহীন। সময়ের হিসেব হারিয়ে গেছে সেই কবে। নক্ষত্রের চলাচল গুনে গুনে আর কত? এখন বুঝি, সময়ের অর্থ আসলে তুমি-ই, আর এইজন্যেই তোমার বয়স বাড়ে না। দক্ষিণে যাবার আগে তুমি যে কয়েক টুকরো চকমকি পাথর দিয়ে গিয়েছিলে, ওগুলোই এখন সম্বল। কোন রকমে ছোট্ট একটা আগুন জ্বালি, আগুনের ওপর শীতার্ত হাতগুলো মেলে দেই। নেকড়ের পাল বিরক্ত হয়, গরর গরর করে দূরে সরে যায়। আমি চেয়ে দেখি ওদের ক্ষুধার্ত আদিম চোখে আগুনের প্রতিফলন। বরফের ওপরে ঠিকরে পড়া অনলের আভার মতো জ্বলজ্বল করে আদিমতর ক্ষুধায়। কয়েকদিন আগে ওরা আক্রমণ করেই বসেছিল। আমি ছিলাম ক্ষুধার্ত, ঠান্ডায় কাতর। চোখটা লেগে এসেছিল, আর আগুনটাও হয়ে এসেছিল স্তিমিত। এই সুযোগে পালের গোদাটা আরেক স্যাঙ্গাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে তুমি যে যাদুর লাঠিটা দিয়েছিলে, ওর ভেতরে তোমার ছুঁয়ে দেয়া কয়েকটা সীসের টুকরো ছিল। ঐ দিয়েই শেষ পর্যন্ত তাড়িয়েছি বদমাশগুলোকে। তবে সীসের যোগানেও টান পড়েছে। ওদিকে পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছে নেকড়ের দল।

প্রিয় পূষন, তুমি ভেবো না। তবুও আমি টিকে যাবো এ যাত্রা। বাংলাদেশের জোড়া বেলের মতো তোমার দুই স্তনের মাঝে মুখ ডুবিয়ে বুক ভরে আগুনের সুঘ্রাণ টেনে না নিয়ে আমি মরবো না। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা প্রিয়তমা। এখন আবার বাতাস ছেড়েছে খুব। চারপাশে ঝড় উঠেছে হাহাকারের মতো। নেকড়েগুলো কাছাকাছি হচ্ছে। বাতাসের বেগ একটুখানি কমলেই ওরা আবার চেষ্টা চালাবে। তবে পরোয়া করিনা। রাইফেলের গুলী যদি শেষ হয়েও যায়, রাইফেলটাকে লাঠির মত ধরে পিটিয়েই তক্তা করবো আজ সারমেয়ের পূর্বসূরী এইসব চতুষ্পদ শ্যালকদের। তোমার নিশ্বাসের উত্তাপ টের পাচ্ছি আমার রক্তের ভেতরে। ভালো থেকো পূষন, প্রিয়তমা আমার। আমরা নিশ্চয়ই আবার মিলিত হবো। ছয় মাস পরে।

ইতি,
তোমার-ই ২১শে ডিসেম্বর
২৮.১২.২০১৯
উত্তর মেরু

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ