এসো নীপবনে

আসিফ ইকবাল ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:১১:৩৮পূর্বাহ্ন গল্প ২১ মন্তব্য

০১লা আষাঢ়, ১৪২৬
------------------------------------------------------------------
আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। বৃষ্টি পিয়ে মাতাল হবো হিক!
বাদল-ও দিনের-ও প্রথম-ও কদম ফুল...কে দেবে আমাকে? কেউ কি দেবে? আচ্ছা, কদম কি ফুটেছে? শালার শহরে কদম গাছ-ও কি আর আছে? আমার ছোটবেলায় মোহাম্মদপুরে চুনকাম করা তবে সবুজ শ্যাওলা ধরা দূর্গের দেয়ালের মতো উঁচু এক দেয়ালের পাশে এক বিশাল কদম গাছ ছিল। প্রতি বর্ষায় ছেয়ে যেত নরম হলদে-সাদা, নাহ, এটা হলুদ-সাদা হবে, লেখাটার কিছু কিছু জায়গা আনুষ্ঠানিক, তাই হলদে-সাদার বদলে হলুদ-সাদা লেখা সঠিক হবে, কদম ফুলে। আমি বড় হতে হতেই কোন শুয়োরের বাচ্চা জানি গাছটা কেটে ফেলেছিল। আচ্ছা, আমি কিন্তু খুব অবাক হতাম। কদম ফুল হাতে নিয়ে...আমার মনে হত ফুল মানেই গন্ধ। কদম ফুল নাকের সাথে চেপে ধরে শুঁকেও কোন গন্ধ পেতাম না...তবে এর নরম রোঁয়াগুলো নাকে-মুখে আদরের পরশ বুলাতো। আসলে কদম ফুলের প্রেমাতাল গন্ধ পাবার বয়স তখনো হয়নি, তাই বুঝতে পারতাম না। আরেকটা ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে জানোয়ারের মতো এর সব রোঁয়া টেনে তুলে ফেলতাম। দেখতাম ভেতরে কেমন করুণ সবুজ একটা বলের মতো আছে...কষ্ট পেতাম, হতাশ হতাম নাকি বিহবল হতাম মনে নেই। তবে মাঝে মাঝে নেড়ীকুত্তার মতো খেউ খেউ করে ওটা দিয়েই ফুটবল খেলতাম। আর রোঁয়া তুলে ফেলার পর ওটাকে ঠিক আম্মুদের কামিয়ে দেয়া মাথা আমার, ভাইয়ার বা অন্যান্য খেলার সাথীদের ন্যাড়া মাথার মতোই লাগতো। হা ঈশ্বর!

এভাবে বড় হতে হতে একদিন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় দুষ্টু বাও বাতাস এসে কানে কানে বলে গেল, জোড়া কদম হলো নারীর জোড়া স্তন। তখন থেকে কদম ফুলের মানেটাই বদলে গেল। কিভাবে যেন দেখতাম, ছুঁতাম ওদেরকে। শিহরিত হতাম কি? পরে শুনলাম সেইগান, "এসো নীপবনে...", এটাও বুঝলাম নীপা এক অসম্ভব সুন্দরী আপুর নাম...আপুর নীপবনে খুব গোপনে আমি কি যেতে চাইতাম না? আচ্ছা এটা কোন প্রশ্ন হলো? ওইসব ক্ষুদে ক্ষুদে কোন ইঁদুরের বাচ্চা শালার ব্যাটারা ওখানে যেতে চাইতো না? আপুকে দেখলে বুকের রক্ত ছলাত ছলাত করতো। আমি চোখে হলুদ সর্ষে মানে কদম ফুল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতাম না। খুব চেষ্টা করতাম আপুর কদম ফুলজোড়ার দিকে না তাকাতে। চেষ্টা করতাম পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু পারতাম না। আপু যেইদিন হলুদ জামা পড়ত, আর হাতায় সাদা কাজ করা থাকত, অথবা হলুদ কামিজের ওপর বুকে পরা থাকত সাদা ওড়না, সেইদিন আমার ভরা বর্ষা, মানে আমি আষাঢ় মাসের পুলকিত কোলা ব্যাং। নীপা'পু টের পেতেন? মনে হয়। কেমন করে যে হাসতেন! ঐ হাসি দেখে আমার নদীতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করতো।

তারপর একদিন আষাঢ়ের এক বিকেলে সারা শহরে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। চোখে গাঢ় করে সুরমা পরে ফেলেছে দিগন্ত। সরসর করে হাওয়া বইছে কদমের ডালে, পাতায়, ফুলে। মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে নীপা'পু ডাকলেন। সাদা সেলোয়ার, হলুদ কামিজ, দুধের মতো সাদা ওড়না- বুকে নেই। প্রবল হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে গলায়। তখন মেয়েরা গলায় ওড়না পরতো না। বুকেই পরতো। কিন্তু নীপা'পু ওড়না নামালেন না। নামিয়েও হয়ত লাভ হতো না। উনার উর্বশী মুখে তখন উড়ে আসা জলের কণারা সঞ্চিত হচ্ছে। তবে আমি জানি সবটাই উড়ে আসেনি। উনি কিছু বলছেন হাত নেড়ে। আমার কানে পৌঁছানোর আগেই সর্বনাশা বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, উনি হয়ত ভেজা গলায় বলছিলেন, "চলে যাচ্ছি রে। এই দেখে নে। আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না।" যে সৌন্দর্য সেদিন সেই অলোকসামান্য বিকেলে দেখেছিলাম, না অনুভব করেছিলাম, তার কোন বর্ণনা নেই। কোন বঙ্গভাষীর পক্ষে হয়ত লেখা সম্ভব না।

এর কয়েকদিন পর কোন এক শুওরের বাচ্চা এসে নীপা'পুকে বিয়ে কর নিয়ে চলে গেল অনেক দূরে। যেখানে বৃষ্টি হয়না, কাদার মত বরফ পড়ে। আমি জ্বরে পড়ে ছিলাম। জানতেও পারিনি। লোকটাকে সেই সময় দেখতে পেলে নির্ঘাত দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতাম। সেই সময় “দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া” শব্দবন্ধের খুব প্রচলন ছিল। কেউ কাউকে হুমকি দেবার সময় হত্যা, খুন, খতম এইসব না বলে এইটা বলতো। যাকে বলা হতো তার গায়ের রক্ত সাথে সাথে হিম হয়ে যেতো।
এরপর আমিও আরেকটু বড় হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরঙ্গ বাসে যাতায়াত করি। একদিন শ্রাবণ মাস। দুপুর বেলা আকাশ মেঘে ঢাকা, ঘন কালো সুরমা পরে অভিমানী চোখে চেয়ে আছে সারা দিগন্ত। চারিদিকে বৃষ্টির তুমুল জল-নূপুর। বাস গিয়ে থামল, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফটকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টি ভেজা নীপা'পু- না, না কদম গাছ। হলুদ-সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। বাসের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। আমি সাবিনার দিকে তাকালাম। সাবিনা আমার দিকে। আমি ছিলাম জানালার পাশে, ও ছিল আমার পাশে। ওর অনিন্দ্যসুন্দর-ফর্সা মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। যেন বৃষ্টি ধোয়া কদম ফুল। হাত বাড়ালাম। আমার হাতে চলে এলো একজোড়া জলসিক্ত কদম। একুশ বছরের সাবিনা হেসেছিল। খুশীতে। অসভ্য বাতাসে ওর ওড়না সরে গিয়েছিলো। মরালী গ্রীবায় গিয়ে লটকে ছিল। সাবিনাও গলায় নয়, বুকেই ওড়না পরতো। ও সেদিন পরেছিলো সাদা সেলোয়ার। কদম ফুলের মতো হলুদ জামার ওপরে দুধের মত সাদা ওড়না। কিছুটা লাজুক, এবং ভীষণ লক্ষী মেয়ে সাবিনা ঐদিন কেন যেন আর সাথে সাথেই ওড়না টেনে নেয়নি। অমন ঝড়ো বাতাস, হয়তো টেনে নিয়েও লাভ হতো না! আর আমি তো জানি সময় থেমে গিয়েছিলো।

এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে॥ দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ- এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে-

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ