ঘুরে এলাম সুন্দরবন (পর্ব-২)

শামীম চৌধুরী ২৭ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ০৩:১০:১৪অপরাহ্ন ভ্রমণ ১৭ মন্তব্য

খুব ভোরে সমুদ্রের ঢেউয়ের নৃত্যের শব্দে আর পাখির কলতানে ঘুম ভাঙ্গলো। প্রাকৃতিক কাজ শেষে  প্রস্তুত হলাম কটকায় জমতলা যাবার জন্য। এরি মধ্যে আমাদের খেদমতে থাকা জাহাজের বয় ইমরান চা/কফি ও বিস্কুট দিয়ে গেলো আমাদের কেবিনে। চা পান করে আমরা সবাই একত্রে নৌকায় বসলাম। দশ মিনিটে নৌকা জামতলার পল্টুনে ভিড়লো। আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে পল্টুনের উপর সমবেত হলাম। সবার উদ্দেশ্যে জামতলায় বণ্যপ্রানীদের আচরন সম্পর্কে কিছু কথা বললাম। মুখে কোন শব্দ উচ্চারন করা যাবে না। দলবদ্ধ হয়ে একসাথে থাকতে হবে। কারন এই জামতলা হচ্ছে বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্য। প্রতিদিনই বাঘ বন বিভাগ কর্তৃক খনন করা পুকুরের মিঠা পানি পান করতে আসে। আল্লাহর নাম স্মরন করে অভিযাত্রিক দল জামতলা প্রবেশের জন্য প্রস্তুত। পিনপতন শব্দে এক লাইনে সবাই হাঁটছি। কারো সাথে কারো কথা নেই। সবার মুখে ভয় ও উচ্ছলতার ছাপ দেখতে পেলাম। ওয়াচ টাওয়ারের সামনে আসতেই সজারু দৌড়ে বনের ভিতর ঢুকে গেল। সামনে যেয়ে দেখলাম সজারু মাটি গর্ত করে বাসা বানিয়েছে। এখন সজারুর প্রজনন সময়। এতই দ্রুত গতিতে সজারুটি চলে যায়, ছবি নেবার সময়টুকু দেয়নি। কটকার জামতলায় হরিনের অবাধ বিচরন। কারন কচিখালি ও জামতলায় একমাত্র  বালুর ঢিবিতে সবুজ ঘাস দেখা জন্মায়। কচি ঘাস হরিনের প্রিয় খাবার। গাছে গাছে রেসাস বানরের নৃত্য চোখে পড়ার মতন। অথচ সেদিন জামতলায় একটি হরিণও চোখে পড়লো না। বানরের খুদী জাম খাওয়ার ভঙ্গিমাও দেখলাম না। তখনই ভাবলাম জামতলায় বাঘ আছে। এরি মধ্যে অভিযাত্রিক দলের দুইজন সদস্য বাঘের পিছন অংশ দেখে থেমে গেল। নাজিম নামে একজন ছোট ভাই আমার কানে বলতে শুরু করলো ভাইয়া বা আআআআ ঘ। আর সামনে যাবেন না। কোথায় বাঘ বলতেই সবাই আতঙ্কগ্রস্থ হলো। কেউ কেউ ক্যামেরা রেখেই দৌড় দিতে শুরু করলো। কেউ সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সাহস করলো। দশজন সদস্যদের এমন কার্যকলাপে আমিও বুদ্ধিহীন হয়ে বোবার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবছিলাম এখন কি করা যায়? আমাদের সাথে থাকা গানম্যান বললেন, আপনারা দাঁড়ান আমি সামনে যেয়ে দেখি বাঘের শরীরের গন্ধ পাই কিনা। আমিও গানম্যানের সাথে সঙ্গী হলাম। পুকুর পাড়ের সামনে আসার পর নাকে বিশ্রী গন্ধ পেলাম। গানম্যানকে বললাম মামা এটা কিসের গন্ধ? গানম্যান বললেন, মামা উনি সত্যিই বাঘ দেখেছেন। সবার এক সাথে থাকা দরকার। আর আস্তে আস্তে এলাকা থেকে চলে যাওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারন বাঘ পিছন থেকে শিকার ধরে। আর বাঘের শিকার থাকে টার্গেট। বাঘ আমাদের দেখবে অথচ বাঘকে আমরা দেখতে পারবো না। কথাগুলি শুনে বলি মামা চকলেট বোমা ফাঁটান। উনি বললেন দরকার হবে না। ফিরে এসে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম জামতলা ত্যাগ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আমি ট্যুর অপারেটর রুবেলকে বললাম , আমি যদি ওয়াচ টাওয়ারের উপরে একা থাকি আর আপনি সন্ধ্যার আগে কি আমাকে ওয়াচটাওয়ার থেকে নিয়ে যেতে পারবেন? কারন ক্যামেরার ফ্রেমে বাঘ বন্দী করা আমার বহুদিনের স্বপ্ন। উনি শুনে বললেন আমরা যদি আজ তিনটার মধ্যে কটকা থেকে জাহাজ না ছাড়তে পারি তবে পক্ষীখালে পৌছতে পারবো না। নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে সঙ্গীদের কথা ভাবলাম। কারন তারাওতো আমার মতন সৌখিন ফটোগ্রাফার।

নীচের ছবিটির ডান দিকেই পুকুর।

জামতলা থেকে ফিরে যখন নৌকায় বসি তখন সময় সকাল ৭:০০ টা। নদীতে ভাটা চলছে। জামতলা খালের দুইধারে জন্মানো শাঁসমূল জেগে উঠেছে।। নৌকা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দুই ধারের কেওড়া, সুন্দরী, হেতাল ও গোলপাাতা গাছের সবুজ রঙের চাকিচিক্যতা নয়ন জুড়ে অনুভব করছি। প্রকৃতির সবুজাভাব দেখে বাঘের চিন্তা মাথা থেকে উড়ে গেছে। খালের এক পার থেকে অন্য পারে  হরেক প্রজাতির পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখির শীষ,গান ও কলতানে মনে হচ্ছে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। নিজেকে হারিয়ে ফেললাম প্রকৃতির সৌন্দের্যে। ফাঁকে ফাঁকে ছবি তোলার কাজও চলছে। এরি মধ্যে Chestnut-winged Cuckoo বাদামি-পাখ কোকিল পাখির ছবি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। কারন এই পাখিটিকে বহু বছর ধরে এই সুন্দরবনেই খুঁজছিলাম। আজ পেলাম। যা আমার ঝুলিতে আরেকটি পাখি নতুন যুক্ত হলো। একটু সামনের দিকে এগুতেই মাঝি বললো স্যার খোঁড়লে সাপ দেখলাম। মাঝি ভাইকে বললাম কোথায়? উনি আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন। সবাই সাপের ছবি তুললাম। সাপটি ছিলো “কিং কোবরা”। নৌকা চলছে আর আমরা ছবি তুলছি। সবার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ ফুঁটে উঠেছে। ময়মনসিংহ থেকে আসা আমার এক অনুজ বলে ফেললেন আপনাকে ধন্যবাদ ভাই। বর্ষায় প্রকৃতির এমন রূপ ও ভিন্ন প্রজাতি বণ্যপ্রানীর দেখানোর জন্য। সবার আনন্দ দেখে আমিও আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগলাম। তিন ঘন্টা জামতলা ও আশে-পাশের খাল ঘুরলাম। বেশ কিছু পাখি,সাপ ও প্রকৃতির ছবি নিলাম। জাহাজে ফিরে হাত মুখ ধুঁয়ে সকালের নাস্তা করলাম। নাস্তায় ছিলো খিঁচুড়ি,বেগুন ভাজি, ডিম ভাজি ও আচার। নাস্তা শেষে সবাইকে আম দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। চা-কফি পান করে জাহাজের ডেকে বসে বিশ্রাম করছি। ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁইছুঁই। সবাই জানতে চাচ্ছেন পরবর্তী প্রোগ্রাম কি? কটকা অফিস পাড়ায় টাইগার টিলায় যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা নিলাম। পূর্ন জোয়ার থাকায় অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর এই কটকাই হচ্ছে পৃথিবীর  বনভুমির শেষ প্রান্ত । তারপর থেকে শুরু হাজার হাজার মাইল সাগর আর সাগর। সমুদ্রে ভাটা শুরু হবে দুইটা থেকে। কটকা অফিস পাড়ায় টাইগার টিলা যদি যাই, তবে আমদের সুন্দরী খাল দেখা হবে না। কারন সুন্দরী খাল পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। অনেকেই বললেন তবে কি বিশ্রাম নেবো? এরি মধ্যে সাহসী ৫জন বলে উঠলেন ভাই চলেন আবার জামতলায় যাই। আমারও ইচ্ছে ছিলো জামতলায় সারাদিন থাকার। তাই প্রস্তাবটি শোনার সাথে সাথে সতীর্থদের বললাম যাবেন নাকি? যারা সাহস করে যেতে চান সঙ্গী হতে পারেন। জামতলায় যাবার জন্য ৬ জন আবারো নৌকায় বসলাম। বেলা ১ টায় জামতলায় আসলাম। সাহসী ৬ যোদ্ধা বীরদর্পে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। গানম্যান মামা  সঙ্গে   আছেন। সবার ভিতর একটা চ্যালেঞ্জিং মনোভাব কাজ করছে। অভিযাত্রিকদের মনোভাব দেখে মনে হলো বাঘের সঙ্গে দেখা করবেই। আমার খুব ভালো লাগলো উনাদের এমন দুঃসাহস দেখে। কারন আমি নিজেই দুঃসাহকিতার চ্যালেঞ্জ গ্রহনে অভ্যস্ত।

জামতলার গহীন বনে হাঁটছি। সবাই চুপচাপ। গানম্যান সবার পিছনে। কারন বাঘ আক্রমন করে পিছন থেকে। বনের গাছে হরেক প্রজাতির পাখি। এই প্রথম হরিনের অবাধ বিচরন চোখে পড়লো। হরিনগুলো আমাদের দেখে দৌড়ে পালাচ্ছে। হঠাৎ বাচ্চা সহ বণ্য শুকুরের পরিবার বনের ভিতর থেকে বের হলো। কি সুন্দর বাচ্চাগুলো। অবাক চোখে দেখলাম। তবে পুরুষ বণ্য শুকর ভয়ঙ্কর হয়। তাড়া তেড়ে আসে সামনের দিকে। আমরা সংখ্যায় বেশী থাকায় সেই ভয়টি কাজ করেনি। বন্য শুকুরের ছবি নিলাম। ফাঁকে ফাঁকে গাছ থেকে খুদি জাম পেড়ে খাচ্ছি। বেশ আনন্দ নিয়েই সহযোদ্ধারা অগ্রসর হচ্ছেন। আমার চোখ ও নেশা বাঘের জন্য। যদি দেখা পেতাম এই আশায় বনের ভিতর হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সমুদ্রের পাড়ে পৌছালাম। একসময় এটাই ছিলো কটকার মূল বীচ। সিডরের তান্ডবে এই বীচ নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে সাগরের বুকের ভিতর বীচটি। আমাদের একজন মোবাইলের এ্যাপসে দেখে নিলেন  ৪.২৫ কিঃমিঃ পথ  চলে এসেছি। সেখান থেকে জামতলা যেতে আরো ৪.২৫ কিঃমিঃ পথ হাঁটতে হবে।  ৮:৫০ কিঃমিঃ পথ বনের ভিতরে হাঁটা ও নতুন কিছুর সন্ধান খুঁজে পাবার নেশা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী আনন্দের। এই অভিযানে হরিন, বানর, বন্য শুকর ও  পাখির ভালো ছবি পাওয়ায় শ্রাবনের নীল আকাশের নীচে প্রচন্ড দাবানলে ঘর্মাক্ত শরীরের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেল। বেলা ৩ টায় আমরা জাহাজে পৌছে দুপুরের খাবার খাই।

(চলবে)

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ