স্বাধীন বাংলাদেশে  দুর্ভিক্ষ বলতে কি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকেই বোঝায়? আমি বলি না! সে-সময় তো বাংলার কিছু মানুষ ক’দিন ভাতে কাপড়ে কষ্ট করেছিল। সে-সময় তো ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ। যা একটা পোড়া বাড়ির মতো ছিল অবস্থা।  তাহলে অভাব তো একটু আধটু থাকার কথাই। তাই বলে কি এখনো ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের দুর্গন্ধটা অনেকের নাকে লেগে থাকবে? গন্ধটা লেগে থাকার তো কথা নয়! আমার মতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের চেয়েও দেশ স্বাধীন হবার আগে নীরব দুর্ভিক্ষ বাংলার ঘরে ঘরে ছিল। কিন্তু সেই নীরব দুর্ভিক্ষের কথা বাংলার মানুষের হয়তো মনেই পড়ে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হবার আগের নীরব দুর্ভিক্ষ অভাবগ্রস্ত পরিবারের আমি একজন অভাবী এখনো বেঁচে আছি এই বাংলার বুকে। সে- সময়ের অভাবের কথা এখনো সময় সময় মনে পড়ে। সে-সময়ের অভাবের কথা ভুলিনি, তা ভোলাও যায় না।

সে-সময়ে শুধু ভাত-কাপড়ের অভাবই ছিল না। অভাব ছিল শিক্ষার। অভাব ছিল শিক্ষা সামগ্রীর। অভাব ছিল ভাত-কাপড়ের। অভাব ছিল টাকা-পয়সার। মোট কথায় মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবকিছুরই অভাব ছিল। সেই অভাবের মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা জীবন। জন্ম আমার ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের এক সুন্দর সময়ে। সেই অভাবের কথা এই যুগের ছেলে-পেলেদের কাছে বলতে গেলে অনেকেই বলে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছি। ওরা উল্টে আমাকে শুনিয়ে দেয় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বা অভাবের কথা। আসলে কিন্তু রূপকথার গল্প নয়, যা বলছি তা বাস্তব কাহিনী।

তখনকার সময়ে শিক্ষার অভাব এমন ছিল যে, আমাদের পুরো গ্রামে হাতেগোনা তিন চারজনেই ছিল মোটামুটি শিক্ষিত। আর সবাই ছিল অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত। শুধু আমাদের গ্রামেই নয়! সে-সময়ে শিক্ষার এমন করুণ অবস্থা এ-দেশের প্রতিটি গ্রাম গঞ্জেই ছিল। আমার বাপদাদারাও বেশি শিক্ষিত ছিল না। যদিও তাঁদের চলার মতো জায়গাজমি ছিল, কিন্তু টাকা-পয়সা কম ছিল বিধায় লেখা-পড়াও ছিল কম। আগেকার মানুষে বলতো, সবার কপালে নাকি লেখা-পড়া জোটে না। একটা গ্রামে বা একটা মহল্লায় যদি ভাগ্যক্রমে একজন মেট্রিক পাস করতে পারতো, তাহলে দুই চার গ্রামের মানুষ মেট্রিক পাস করা মানুষটাকে দেখতে আসতো। আর এখন ঘরে ঘরে আইএ পাস, বিএ পাস, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাস করা মানুষের অভাব নেই। সবার কপালে লেখা-পড়া জোটে না, বুড়ো বুড়িদের এমন কথা এখন উলট-পালট।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে নিরক্ষের হার কমে শিক্ষার হার বাড়তে শুরু করলো। তাই বর্তমান যুগে মানুষের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, অন্তত লেখা-পড়া কমবেশি সবার আছে। ধনী গরিব সবাই চেষ্টাও করে, যাতে ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়া হয়। কয়েক বছর আগেও টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত নিরক্ষরতা দূরীকরণ নিয়ে কতরকম প্রচারাভিযান। বুড়ো বুড়ো মানুষদের স্বাক্ষর শেখানোর জন্য দেশেও গড়ে উঠেছিল কতো সন্ধ্যাকালীন পাঠশালা। টেলিভিশনের পর্দায় এখন আর ওইসব দেখা যায় না। এখন মনে হয় আমাদের দেশে তেমন নিরক্ষর নামের মানুষ নেই। এখন সবাই অক্ষর লিখে স্বাক্ষর করতে জানে। এখন স্ট্যাম্প পেইডের কালি বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপ নামের ছাপ দেওয়া মানুষ আছে বলেও মনে হয় না। এখন সবাই কলম ধরে লিখতে জানে। নিজের নাম লিখতে জানে, পড়তে জানে।

কিন্তু আজ থেকে যদি ৪০ বছর আগের দিনে ফিরে তাকাই, তাহলে প্রথমেই দেখা যায় দুই চারটা গ্রামের মধ্যে হাতে গোণা দুইএক জনই ছিল শিক্ষিত। মানে মেট্রিক পাসওয়ালা তাও হয়েছে বংশগত ভাবে, আর নাহয় অভিভাবকদের আপ্রাণ চেষ্টার বিনিময়ে। যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত, তাদের সংসারের ছেলে মেয়েদের আর লেখা-পড়া হয়নি। সে-সব অভাবী সংসারের মধ্যে আমাদের সংসার ছিল অন্যতম। তাই আমার বড়দাদার কপালেও লেখা-পড়া তেমন জুটেনি। যৎসামান্য কিছু লেখা-পড়া শিখে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। শেষতক বাবার পথে হেঁটে শেষ অবধি নারায়ণগঞ্জে চাকরি নিলো। বাবাও নাকি সেই যুবক থাকতেই নারায়ণগঞ্জ চাকরি করতো। বাবা বেতন পেতো মাসে ১৫০ টাকা। বড়দাদা বেতন পেতো যৎসামান্য।

তারপরও ভাতে- কাপড়ে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। চার বোন আমি আর মা থাকতাম গ্রামের বাড়িতে। বাবার পাঠানো সামান্য টাকা দিয়েই চলতো আমাদের ছয়জনের সংসার। কোনও দিন তিন বেলায় দুই বেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছি। পুরো গ্রামে আমাদের মতো আরও অনেক মানুষেরই অভাব ছিল। মানুষের টাকার অভাব তো ছিলই, ছিল কাপড়ের অভাবও। কাপড়ের অভাবে জোয়ান বুড়োদের দেখেছি সারাদিন লেংটি পরে থাকতে। লেংটি মানে দেড় হাত লম্বা দোপাট্টা কাপড়। যা কোমড়ে থাকা বাট্টা বা কাইতনের সাথে কোনরকম আটকানো থাকতো। দূর থেকে একরকম উলঙ্গই দেখা যেত। ছোটবেলা নিজেও সারাদিন লেংটি পড়ে থাকতাম। শুধু স্কুল বাদে খেলাধুলায়, দৌড়ঝাঁপে, হাট-বাজারে, সবখানেই থাকতাম যেতাম লেংটি পড়ে। তখন এই লেংটির দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। কারণ, সবার অবস্থা তখন একইরকম ছিল।

সে-সময় মনে হয় লজ্জা নিয়েও কেউ বেশিকিছু ভাবত না। ভাবতো শুধু আগামীকাল কীভাবে বেঁচে থাকবে, সেটাই ছিল বড় ভাবনা। বস্ত্রের অভাবে মানুষ অর্ধনগ্ন হয়ে থাকত। কেউ কারোর দিকে ফিরেও তাকাতো না। এ-সব কাহিনী বেশি দিনের নয়! ঘটনা দেশ স্বাধীন হবার আগের কথা। আমি তখন ৭-৮বছরের বালক। বাবা যেই কাপড়ের মিলে চাকরি করতেন, সেই মিল থেকে প্রতি ৩-মাস পরপর কিছু রিজেক্ট কাপড় পেতো। এটাকে বলা হতো ডাস্টার কাপড়। শুধু আমার বাবা একা পেতেন না, মিলের সব শ্রমিকরাই পেতো। যেহেতু মিলের শ্রমিক, তাই। তাও সীমিত কিছু অর্থের বিনিময়ে।

সেই কাপড় লোক মারফত নাহয় বড়দাদাকে দিয়ে বাড়িতে পাঠাতো। মা সেই কাপড় দা দিয়ে কেটে সুই সূতা দিয়ে সেলাই করে জামা বানিয়ে দিতো, আমরা গায়ে দিতাম। কাপড় কাটার জন্য কেঁচিও ছিল না। টাকার অভাবে কেঁচি কিনতে পারেনি বলেই, দা দিয়ে কাপড় কাটতো। আর হাতে সেলাই করতো। হাফপ্যান্ট বানিয়ে দিতো, হাফশার্ট বানিয়ে দিতো। মায়ের হাতে বানানো জামা প্যান্ট শুধু স্কুলে যাবার সময়ই পরতাম। আর বাকি সময় দোপাট্টা লেংটি পরে থাকতাম। পায়ের জুতা বা স্যান্ডেল তো ছিলই না। খালি পায়েই সারাদিন দৌড়া-দৌড়ি করতাম। হাটে যেতাম, বাজারে যেতাম। রাতে ঘুমানোর আগে বিশেষ ধরনের একপ্রকার জুতা পায়ে দিয়ে পা ধুয়ে বিছানায় যেতাম। জুতো গুলো তৈরি হতো সুপারি গাছের খোল দিয়ে। এখন আর সেই দিন নেই। সেই দিনের কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। এখন মানুষে তিন-চার হাজার টাকা দামের জুতো ব্যবহার করে থাকে। আগেকার সময়ে লোকের কাছে একজোড়া পায়ের স্যান্ডেল ছিল মহামূল্যবান সম্পদ।

১৯৬৮-১৯৬৯ সালের কথা। তখন যেমন ছিল টাকার দাম, তেমন ছিল অভাব। বাবা বেতন পেলে, ১০০ টাকা দিয়ে বড়দাদাকে বাড়িতে পাঠাতো। বড়দাদা আসা-যাওয়া বাবদ ১০ টাকার মত খরচ করে বাকী ৯০ টাকা মায়ের কাছে দিতো। মা এই টাকা দিয়ে সারা মাস অতি কষ্টেসৃষ্টে আমাদের সংসারটা চালাতেন। এর এখন প্রায় ঘরের ছেলে-পেলেরা বিদেশে চাকরি করে। মাসে মাসে ডলার পাঠায়। স্বাধীনতার আগে যাঁদের অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাঁদের এখন রাজকীয় অবস্থা। বর্তমানে যাঁরা শহরের বস্তিবাসী, তাঁদের পরনেও থাকে লেহেঙ্গার মত দামী পোশাক। সিনেমার হিরোদের পোষাক জিন্সের শার্ট-প্যান্ট।

মনে পড়ে দেশ স্বাধীন হবার আগের কথা, ১৯৬৯ সাল। সামনে দূর্গাপূজা। গ্রামের বড় গৃহস্তদের বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। বাবা, বড়দাদা নারায়ণগঞ্জে। পূজার আনন্দ নেই আমাদের মতো আরও অনেকের সংসারে। মা আমাকে আশা দিয়ে রেখেছেন, বাবা আসতে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে আনবেন। আশায় থাকলাম আমি। আশায় থাকলো আমার বড় তিন বোন। পূজার ঠিক দুইদিন আগে বাবা বাড়িতে আসলেন। কী আনন্দ! বাবা শহর থেকে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে এনেছে। আমার জন্য নতুন জামা-কাপড় আনেছে ১০ টাকা দামের গাউনের জামা-প্যান্ট। বোনদের জন্য এনেছিলেন কমদামি ছাপা মার্কিন কাপড়। ওই গাউনের জামা-প্যান্ট পেয়েও মহাখুশি হয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো আমি এই ভবসংসারের একজন রাজকুমার। সেই অভাবের দিনে গাউনের পোশাক পরেই রাজার বেশে পূজার আনন্দে মেতেছিলাম।তখন কমদামী আর বেশি দামি বুঝতাম না। অভাব কাকে বলে তাও বুঝতাম না। এখন বুঝি! এখন ভাবি ১৯৭৪ সালের আগেও নীরব দুর্ভিক্ষ এদেশে ছিল। অথচ দুর্ভিক্ষের দুষিত গন্ধটা ১৯৭৪ সালের গায়ে লেগেই থাকলো।

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ