তখন চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ি। প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদের সাধারণ জ্ঞান ও ড্রইং ক্লাস হতো। সাধারণত এই ক্লাসটা নিতেন একজন কনকবালা  ম্যাডাম, তবে মাঝে মাঝে অন্যান্য শিক্ষকরাও নিতেন। অন্যান্য সব ক্লাসের চাইতে এই ক্লাস টা আমরা সবাই খুব উপভোগ করতাম। বৃহস্পতিবার মানেই টিফিন পিরিয়ডে ছুটি, আর এই ক্লাস নেয়া হতো ছুটির আগে।

যাইহোক, সেদিন আমাদের সাধারণ জ্ঞানের ক্লাস নিতে আসলেন আবু বকর সিদ্দিক স্যার। তিনি হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের অংক, বিজ্ঞান পড়াতেন। প্রচন্ড রাগী ছিলেন, শিক্ষার্থীরা তাকে আড়ালে আবডালে এবিসিডি স্যার বলে ডাকতাম। এবিসিডির মিনিংটা ধরতাম এভাবে,
এ- আবু
বি-বকর
সি-সিদ্দিকি
ডি-ডেঞ্জারাস!
তার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা ছিলো না। পড়ানোর সময় তিনি বলতেন, যতক্ষণ না বুঝবে প্রশ্ন করতে থাকবে, যখন বলবে বুঝেছি তখন আর ভুল করা চলবে না। ক্লাস সেভেন থেকে আমি নিয়মিত তার কাছে পড়ার সুযোগ পেয়েছি,  এবং জেনেছি শিক্ষক মানে কি, এবং একজন প্রকৃত শিক্ষকের মাহাত্ম্য কেমন হতে হয়। আজ তিনি বেঁচে নেই, তার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত বাসী করুন।

যা বলছিলাম,সেদিন কনক ম্যাডাম অসুস্থ থাকায় আমাদের ক্লাস নিতে এলেন এবিসিডি স্যার। এসেই আমাদের দেশের জাতীয় নিদর্শন, পশু-পাখি, মাছ-নদী ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। আমরা সানন্দে জবাব দিচ্ছিলাম। এক সময় তিনি আমাদের বললেন জাতীয় নির্দশন গুলোর ছবি এঁকে দেখাতে। যে যেটা পারে সেটাই এঁকে দেখাতে বললেন।

আমরা যে যার মতো আঁকলাম, আর তার কাছে নিয়ে গেলাম। কেউ এঁকেছে ইলিশ মাছ, কেউ শহীদ মিনার, কেউ পদ্মা নদী! আবার কেউ কেউ কাঠাল একেছিলো। আবার অনেকে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ছবিও একেছিল সেদিন। তিনি একটা একটা ছবি দেখছেন আর খাতায় নাম্বার দিচ্ছেন। আমিও আমরা আঁকা ছবিটা নিয়ে তার কাছে গেলাম। তিনি আমার ছবিটার দিকে চোখমুখ কুঁচকে রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তারপর অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলেন এটা কি একেছো?
- রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আমাদের জাতীয় পশুর ছবি এঁকেছি স্যার।
আমি উৎসাহিত হয়ে জবাব দিলাম।

তার হাতে তিনি সব সময় জোড়া বেত নিয়ে ঘুরতেন। খেয়াল করে দেখলাম তিনি একবার তার বেতের উপর একবার আমার খাতাটার উপর হাত বুলাচ্ছেন। তারপর হঠাৎ করেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,❝ শোন তুমি যেটা এঁকেছো এটা মোটেও তা নয়। ডোরাকাটা দাঁগ দিয়ে দিলেই সেটা বাঘ হয়ে যায় না। এটা বাঘ তো হয়ইনি, গরুও হয়নি। অন্যান্য ছবি যদি আঁকতে চাও অবশ্যই নিজের খেয়াল খুশি মতো আঁকবে। কিন্তু যে ছবির সাথে দেশ, স্বাধীনতা, জাতীয়তা মিলেমিশে থাকবে সেই ছবিতে নিজের খেয়াল মিশিও না। আগে শিক্ষবে তারপর চেষ্টা করবে❞৷  ছোট মানুষ,এই তিরষ্কার তখন নিতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝি ঐ কথাগুলো আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো ভাবছেন আজ এতো কথা কেন লিখছি,
বলছি। আজ এতো কথা মনে পড়ছে এই জিনিস গুলো দেখে। শহর, রাস্তা, বিনোদন পার্ক গুলোর সৌন্দর্য বর্ধনের হেতু যেসব ভাস্কর্য বানানো হয় তাতে দোষের কিছু দেখি না।  কিন্তু বস্তুর সাথে অমিল রেখে আমাদের সামনে যখন এমন সব ভাস্কর্য তুলে ধরা হয় এটা জাতি হিসেবে মেনে নিতে পারি না। আমি / আমরা মনে করি ভাস্কর্য দিয়ে জাতীয়তার পরিচয় তুলে ধরতে চাইলে সঠিক ভাবে তুলে ধরা উচিৎ। নিজের খেয়াল খুশিমতো একটিকে আরেক জিনিসে পরিনত করার কি দরকার!

চাঁদপুরের ইলিশের ভাস্কর্য,

 

রয়েল বেঙ্গল টাইগার! সিরিয়াসলি!  এরা কি বাঘ কল্পনায় দেখেছিলো!!

 

সুস্থির হতে পারিনি প্রানপ্রিয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখেও। চীন, যারা সবকিছুর ডুপ্লিকেট বানাতে সক্ষম বিশ্বের একমাত্র জাতি! যারা চাইলেই পৃথিবীর মতো হুবহু আরেকটা পৃথিবী বানিয়ে ফেলতে পারে, তারা কি করে পারলো এমন করে বঙ্গবন্ধুর আদল তৈরী করতে? বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র  কোন একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি গোটা বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতির অধিপতি। জাতীয়তা নির্মাণে যার ভুমিকা অপরিসীম, কেন তার ভাস্কর্য নির্মাণে আরেকটু মনোযোগ দেয়া হয়নি!! বঙ্গবন্ধুকে নিখুঁত বিন্যাস দেয়া হয়নি, এ দায় কার? অবশ্যই  আমার, আপনার, আমাদের সবারই।

 

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি তার বিদেহী আত্মার প্রতি। তিনি বেঁচে থাকবেন প্রতিটি মানুষের মনে, প্রানে, ইতিহাসে। জয়বাংলা।

 

* ছবি নেট থেকে নেয়া।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ