মাহে রমজান

রোকসানা খন্দকার রুকু ২৬ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ১১:১১:৩৫অপরাহ্ন সমসাময়িক ২১ মন্তব্য

রমজান মুসলমানদের যেন এক আমেজের মাস। চাঁদ ওঠা থেকেই শুরু হয় মুসলমানদের এ আমেজ। চাঁদ দেখার সাথে সাথেই পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা পটকা ফুটিয়ে, দলবেঁধে চিৎকার করে চাঁদকে বরণ করে নেয়।
রাত একটা থেকে শুরু হয় মাইকে ঘোষনা- ‘ওঠো মা বোনেরা ওঠো, সেহেরীর সময় হয়েছে ওঠো’। বিশেষ করে গ্রাম বা মফস্বল শহর গুলিতে রাত যেন সরগরম, নির্ঘুম কাটায়।
সন্ধ্যায় মাইকে সাইরেন হয়, আজান হয় তারপর লোকজন ইফতার করে। শহুরে লোকজন আয়েশ করে নানাপদ খায়। তবে এখন গ্রামের অবস্থাও অনেক পরিবর্তন হওয়ায় উচ্চবিত্তরা ঠিক শহুরে জীবন-যাপনই করে। সেরকম খাবার- দাবারই খায়।

তবে গ্রাম শহর দুজায়গাতেই গরীব মানুষরা এখনও বড়লোকদের মত নানাপদে ইফতার/ সেহেরী সারতে পারে না । গরীব মানুষজন চিডা-মুডি, কলাসহ সাধারন খাবার দিয়ে ইফতার সারে। অনেকেই সরাসরি ভাতও খেয়ে ফেলে। সেহেরীতেও তাই খায়।

এখনকার চালচিত্র এমন হলেও যখন মানুষের ঘড়ি ছিল না, সাইরেন ছিল না কিংবা এত মাইকে ডাকাডাকিও ছিল না। মানুষ তাহলে তখন কেমন করে জাগতো বা সময়মতো ইফতার বা সেহেরী সারত!

লোকমুখে শোনা- তখন লোকজন সন্ধ্যার আযান শুনেই ইফতার খেত। যদি কোন কারনে মাইকে ঘোষণা না হতো তাহলে তারা পশু- পাখির বিভিন্ন কার্যকলাপে বুঝতে পারতো এখন ইফতারের সময় হয়েছে। যেমন- চামচিকা, দেখতে অনেকটা বাঁদুরের মত কিন্তু অতো বড় নয় ছোট ছোট দেখতে। এরা যেহেতু দিনের বেলা চোখে দেখে না তাই সারাদিন তারা কোথাও লুকিয়ে থাকে। এবং ঠিক ইফতারের সময়েই সে চোখ মেলে বের হয় খাবারের উদ্দেশ্য।তাদের উড়া উড়ি শুরু হলে লোকজন বুঝতে পারে ইফতারের সময় হয়েছে।

মায়ের গল্প- আমার নানা রোজা রাখতেন কিন্তু খুব কষ্টে। ইফতারের সময় মাইকে আযান না হতেই তার মনে সময় পার হয়েছে এবং নির্ঘাত মুয়াজ্জিন ঘুমিয়ে পরেছে। তখন তিনি একটা লাঠি নিয়ে পরিত্যক্ত ঘরে থাকা বাঁদুর- চামচিকাদের গুতাগুতি করে জাগানোর চেষ্টা করতেন। তারা জাগলেই তিনি ইফতার সেরে ফেলবেন। তাতে কোন লাভই হতো না। যতক্ষন সময় না হতো ততক্ষন তারা বেরই হতো না। নানা রাগে গজর গজর করতেন। সবাই এটা নিয়ে বেশ মজা পেতো এবং হাসাহাসি করতো।

এখন সেহেরীতে কত ঘোষনা চলে। কিন্তু তখনকার মানুষ কিভাবে সেহেরী খেত। যখন ভয়ে লোকজন বাইরে বের হতে পারতো না। কিংবা মাইকে কোন ঘোষনা ছিল না, সাইরেন ছিল না। তখন মানুষ আকাশের চাঁদের অবস্খান থেকে সেহেরী নির্নয় করতো। আবার মোরগ ডাকলে মনে করা হতো সেহেরীর সময় শেষ হয়েছে। কিংবা গায়ের লোম যতক্ষন দেখা না যেত, মনে করা হতো ততক্ষন সেহেরীর সময় আছে।

এসব কিছু বছর আগের অবস্থা। তখন মানুষজনের খাবারের নিদারুন অভাব ছিল। মানুষ পান্তা দিয়ে ইফতার বা সেহেরী সারতো। অবশ্য কারনও ছিল। বলা হয়, পান্তা পেট ঠান্ডা রাখে। যুগে যুগে মানুষ বদলেছে, বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা।

বাংলাদেশ মিশ্র একটি জাতিগোষ্ঠীর দেশ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আসতো এদেশে। আমরা তাদের থেকে কিছু কিছু করে অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছি। নিজেদের খাদ্যাভাস বদলে আধুনিক হয়েছি। আজ আর আমাদের প্রাচীণে মন নেই। নেই সেই সময়- সূচী কিংবা খাবার- দাবার। আমরা এখন ইফতারে ঘরে ঘরে খাই নানাপদ।

আমাদের দাদা বা বাবারা একই পাতে কলা- মুডি মেখে বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতেন। আমরা এখন আর নেই সেই ভাগাভাগি বা কলা মুড়িতে। সন্ধ্যা হলেই অপেক্ষা করা হতো একজন আগুন্তকের। তাকে মনে করা হতো আল্লাহর প্রেরিত কিংবা রহমত। এখন আমরা আর সেই অপেক্ষায় নেই বরং গেটে তালা ঝুলিয়ে নানা পদ গলাধ্ধ করনেই সার্থক।

তবুও জেনে নেই মুখরোচক এই নানা পদগুলি কেমন করে এলো বা পেলাম-
খেজুর: রমজান খেজুর ছাড়া অসম্পূর্ণ । মহানবী হয়রত মুহামাদ্দ (স:) খেজুর পছন্দ করতেন। এটা খাওয়া সুন্নাত। তাই প্রায় সকল দেশের সকল মুসলমানই ইফতারে খেজুর খায়।

শরবত: আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতীয়দের কাছ থেকে শরবত আমাদের পাওয়া। তারা বিভিন্ন পদের শরবত পান করতে পছন্দ করতেন। বিষেশ করে মোঘল রাজারা এটি সুরা পানিয়ের বদলে পান করতেন।

বুট বা ছোলা: অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার যা শহর গ্রাম সব জায়গার মানুষই খায়। এটা আফগানদের পছন্দের খাবার। বুট থেকে যে হালুয়া বানানো হয় এটাও তাদের কাছ থেকেই আমাদের পাওয়া।

বুন্দিয়া জিলাপী: এটিও আফগানদের পছন্দের খাবার সেখান থেকেই আমাদের পাওয়া।

চপ, পেয়াজু, ভাজাভুজি: ভারতের লোকজন ভীষন ভাজা পোড়া খায়। তাদের দেশে সারাবছরই রাস্তার পাশে সাজানো ভাজা পোড়ার পশরা। আমরা সেখান থেকে এটিও পেয়েছি। রমজান ছাড়াও অন্যান্য সময়েও আমরা খেয়ে থাকি।

হালিম, তন্দুর, নান, কাবাব, বিরিয়ানী: মোঘল সম্রাটরা একসময় আমাদের পুরোনো ঢাকায় তাদের রাজধানী স্হাপন করেছিলেন। তাদের জন্য খানদানী বড় বড় প্লেটে করে এসবখাবারের পশরা সাজানো হতো। এসব খাবার বানাতো পুরান ঢাকার বাবুর্চীরা। আর তাই আজও পুরান ঢাকায় জমজমাট। এগুলো খাবারে পরবর্তীতে ঢাকার লোকজন অভ্যস্ত হয়ে এখন মোটামুটি পুরো দেশের অভিজাত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ইফতার/ সেহেরীতে পরিনত হয়েছে।

পবিত্র এ মাসে আমরা যত খাবারই খাই না কেন? পরিপূর্ন রোজা কিন্তু নিজের উদোর পূর্তিতেই নয়। আমাদের পাড়াপ্রতিবেশী যারা গরীব রয়েছে তাদের খোঁজ খবর নেওয়াও একান্ত কর্তব্য। শুধু নিজেদের জন্য খাবারের পশরা সাজিয়ে খেয়ে রোজা রাখলেই হবে না। বরং অন্যদের এ খাবারে ভাগীদার ও খোঁজ খবর রাখাতেই অধিক সওয়াব ও এটি মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য।
‘একটি পরিপূর্ণ রোজা তোমার সংযম এবং তোমার পাশের গরীব প্রতিবেশীর তোমার প্রতি সন্তুষ্টি।’

তাই আসুন আমরা সবাই অধিক খেয়ে উপোষ নয় গরীবদের ভাগীদার করে পরিপূর্ন রোজা রাখি।
কারণ- পরিপূর্ন রোজার পুরষ্কার হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ নিজ হাতে দিবেন।(সহীহ বুখারী-১৮৯৪)
ছবি- নেট

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ