কুকুরের ভালোবাসা

নিতাই বাবু ২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:১২:০২পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৮ মন্তব্য

আমাদের দেশে প্রতিবছরই ভাদ্র-আশ্বিন আর কার্তিক মাসে কুকুর বাচ্চা প্রসব করে। সেসময় শহরের মহল্লার রাস্তায় কুকুরের ছোট ছোট বাচ্চা দেখা যায়। তখন এসব কুকুরের বাচ্চাগুলোকে রক্ষণা- বেক্ষণের অভাব হয় না। মহল্লার অনেক শিশু কিশোররা এঁদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে ফেলে। বাচ্চাগুলোকে সেবা-যত্ন করার প্রস্তুতি নিয়েও নেয়। কেউ কুকুরের বাচ্চাগুলোর গলায় রশি বেঁধে টানে। কেউ কোলে- পিঠে করে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চা কুকুরটি অন্তত কয়েকদিন নিজের হেফাজতে রাখার জন্য অনেক রকমের চেষ্টাও করে। কয়েকদিন খুবই আদর-যত্ন করে রাখেও।

নিজ বাড়ির সামনে থাকা একটা কুকুরের যদি পাচ- ছয়টি বাচ্চা থাকে, তো বাড়ির পাচ- ছয়টা ছেলে- পেলেদের মধ্যে তা ভাগাভাগি হয়ে যায়। এটা আমার, ওটা তোমার! কেউ কারোরটা ধরতে বা ছুঁতে পারবে না। একে অপরেরটা ধরলেই, লেগে যায় হট্টগোল হুলস্থুল! মানে– মারা-মারি, ধরা-ধরি, আর ঝগড়া।

কুকুরের বাচ্চা নিয়ে ছোটবেলা এমন ঝগড়া- ঝাঁটি নিজেও অনেক করেছি। যখন ছোট ছোট ছেলে- পেলেদের কুকুরের বাচ্ছা নিয়ে এমন আদর আহ্লাদ দেখি, তখন আমরও শখ হয় বাচ্চাগুলোকে কোলেকাঁখে নিতে। কিন্তু পারি না লোকলজ্জার ভয়ে, আর মানুষের নানারকম কথার কারণে। তবুও থেমে থাকার পাত্র আমি নই। কোলে- কাঁখে নিয়ে না বেড়ালেও, চোখে চোখে আদর করি, খাবার দেই, কাছে ডাকি।

একদিন একটা কুকুরের সাদা রঙের মাঝে কালো ছাপওয়ালা বাচ্চা দেখে লোভ আর সামলাতে পাড়লাম না। বাচ্চাটিকে নিয়ে গেলাম বাসায়। বাসা বলতে নিজের বাপ-দাদার কেনা বাড়ির বাসা নয়! ভাড়াটে বাসা! মানে– যেই বাড়িতে ভাড়া থাকি, সেই বাড়িতে থাকা বাসায়।

এদিকে কুকুরের বাচ্চাটির জন্য ওর মা কুকুরটি প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কাঁদে, ঘেউ ঘেউ করে। মা কুকুরটি বাচ্চার শোকে একরকম পাগলের মতো হয়ে গেল। তা আমি দেখি, বুঝি! মা কুকুরটিকে কাছে ডাকি। বিস্কুট অথবা পাউরুটি খেতে দেই! কিছু খায়, আবার অন্যদিকে চুপ-চাপ চেয়ে থাকে। খাবার শেষ না করেই পাগলের মতো আবার ছুটতে থাকে। এসব আমি আমার অফিসের সামনে যেখান থেকে কুকুরের বাচ্চাটিকে নিয়ে গেছি, সাখানে কুকুরের বাচ্চার মায়ের এরকম অবস্থা দেখতে পাই। তা দেখে নিজের কাছেও খারাপ লাগে। তারপরও কুকুরের বাচ্চাটি পোশ মানানোর জন্য আমার খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল।

বাচ্চাটি ছিল খুবই সুন্দর, দেখতে বিদেশি কুকুরের বাচ্চার মতো। বাসায় নেওয়ার সাথে সাথেই লেগে গেল হট্টগোল আর গণ্ডগোল। আমরা হিন্দু বলে কথা! ধর্মের আচার- বিচারের আর শেষ নেই, তাই। ছিঃ ছিঃ, রাম রাম, ঠাকুর ঠাকুর ইত্যাদি সহ আরও কত কী! তবু কারোর ছিঃ ছিঃ, আর রাম রামের দিকে ফিরে তাকালাম না। কুকুরটিকে বাসার দরজার সামনে একটা রশি দিয়ে বেধে রাখলাম। এরমধ্যেই নিজের গিন্নির সাথেও লেগে গেলো বাকবিতণ্ডা। গিন্নি বলে, “নিজে পায় না জায়গা, কুত্তা আনে বাগা।” গিন্নি ছাড়াও আ-কথা কু-কথা বলার মতো বাড়িতে থাকা ভাড়াটিয়ারা তো আছেই।

যদি কুকুরের বাচ্চাটি এই বাড়িতে থাকে, তো কারোর ঘরে যেতে পারবে না। কারোর শরীরে ঘেঁষাও লাগতে পারবে না। রোদে শুকানোর জন্য তারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়েও লাগতে পারবে না। কাপড়ে কুকুরের ছোঁয়া লাগলেই, সেই কাপড় আমাকে আবার ধুইয়ে দিতে হবে। কারণ, এঁরা অশুচি কুকুর বা কুত্তা। সবসময় ময়লা আবর্জনায় থাকে বলে, ওরা নাকি সবসময় নাপাকই থাকে! তাই এদের প্রতি আমাদের যতো অবহেলা, আ-কথা, কু-কথা আর ঘৃণা।

তারপরেও আমি থামছি না। সব ভাড়াটিয়াদের সবরকম কথা আর শর্তাবলী মেনে নিয়ে শুরু করে দিলাম, বাচ্চাটিকে সুন্দরভাবে রাখার ব্যবস্থা। দিনে এবং রাতেরবেলা বাচ্চাটি রাখার নির্দিষ্ট জায়গাও ঠিক করে ফেললাম। বাজার থেকে বাচ্চাটির জন্য সেম্পু-সহ গলার বেল্ট আর ঘণ্টাও কিনে নিয়ে গেলাম। কুকুর বা কুত্তার বাচ্চাটির (ধলু) নামও রাখে দিলাম। ওর নাম এখন ধলু। ধলু বলে ডাকলে কুকুরের বাচ্চাটি আমার দিকে টগবগ করে চেয়ে থাকে। ও বুঝে গেছে যে, ওর নাম ধলু! তাই ধলু নাম কেউ উচ্চারণ করলেই কুকুরের বাচ্চাটি কেও মেও শুরু করে দেয়।

আবার বাড়ির কয়েকজন ব্রাহ্মণ টাইপের ফ্যামিলি বলা-বলি করতে লাগলো, “বাড়িওয়ালার কাছ থেকে অনুমিত না নিয়েই বাড়িতে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছে। যেমন ওর নিজের বাড়ি!” এসব কথা আমি না শুনলেও আমার গিন্নি শুনে আমাকে শাসাতে লাগলো। গিন্নি বলতে লাগলো, “কুকুরের বাচ্চাটি যেখান থেকে এনেছ, ঠিক সেখানেই দিয়ে আসো! নাহয় তোমার একদিন কি আমার একদিন। ভাড়াটিয়া বাড়িতে কুকুর বা গরু ছাগল লালন-পালন করতে হলে, বাড়িওয়ালার অনুমিতর প্রয়োজন হয়। তা কি তুমি জানো না? আর যদি এখানে এই বাড়িতে কুকুর রাখতেই হয়, তো আগে বাড়িওয়ালার অনুমিত নিয়ে নাও!”
গিন্নির কথামত আমি বাড়িওয়ালার কাছ থেকে বাচ্চাটিকে রাখার জন্য অনুমিতও নিয়ে নিলাম। এখন আমাকে আর ঠেকায় কে? শুরু করে দিলাম এর পরিচর্যা। আর সময় অসময় এর দেখাশুনা।

তারপরও ঘরে বাইরে চলছে কুকুর নিয়ে ঝগড়া। নিজ ঘরেও ঝগড়ার শেষ নেই। কুকুরের বাচ্চাটিকে ছুঁলেই, আমাকে স্নান করে ঘরে ঢুকতে হবে। নাহয় মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয়! ঘরে এটা ছুঁতে দেয় না, ওটা ধরতে দেয় না। এমন আরও নিয়ম-কানুন! তবুও ধৈর্য ধরে সবকিছু সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে পাচ- ছয়দিন পার করে দিলাম।

এভাবে ছয় থেকে সাতদিনের মধ্যেই বাচ্চাটির চেহারা কেমন যেন পালটে গেল। বাচ্চাটি এখন দেখতে ঠিক বিদেশি এক বিশেষ জাতের কুকুরের মতো হয়ে গেল। শরীরের পশমগুলো হয়ে গেল লম্বা লম্বা। আর সাদা রঙের মাঝে ঝলকানো কালো দাগগুলো যেন ফুটে উঠেছে। এখন যে-ই দেখে, সে-ই বাচ্চাটির দিকে চেয়েই থাকে। প্রতিদিন সকালবেলা কুকুরের বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে রাস্তায় বের হলেই, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “দাদা, এই বিদেশি কুত্তার বাচ্চাটি কোত্থেকে এনেছেন?”
আমি প্রশ্নকারী ব্যক্তিদের সাথে আর মিথ্যা বলতে পারিনি। সত্য কথাই বললাম, “এটা বিদেশি কুত্তার বাচ্চা না, এটা দাদা এদেশি।” আমার কথা শুনে অনেকেই আমাকে বলে, “আপনিতো ভাড়া থাকেন! তো বাচ্চাটিকে আদর- যত্ন করে রাখবেন কোথায়? তারচেয়ে বরং এটা দাদা আমাকে দিয়ে দেন।”

আমি কারোর কথায় আর কান দিলাম না। যতদিন রাখতে পারি ওকে নিজের হেফাজতেই রাখবো। এটা ছিল আমার মনের কথা, আর নিজের সিদ্ধান্ত। খটকা কিন্তু বেধে যায় বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সাথে। আর নিজ ঘরের গিন্নির সাথে। অনেক সময় এই কুত্তার বাচ্চাটা নিয়ে, কারণে অকারণে প্রতিদিনই বাড়ির ভাড়াটিয়াদের আমার এবং আমার গিন্নির ঝগড়া করতে হয়। এই ঝগড়া- ঝাঁটির কারণে, আমি (ধলু) কুকুরের বাচ্চাটিকে আর আমার কছে রাখতে পারলাম না। কাউকে দিয়েও দিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, যেখান থেকে এনেছি, ঠিক সেখানেই ওর মায়ের কাছে নিয়ে ছেড়ে দিবো।

যেই কথা সেই কাজ! একদিন সকালবেলা দোকান থেকে একটা পাউরুটি কিনে এনে ধলুর সামনে দিলাম। ধলু আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে সামান্য রুটি খেয়ে চুপ করে বসে রইল। আমিও ধলুর সামনে বসে ধলুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “ধলু, আজ তোকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো। আজ থেকে তুই তোর মায়ের কাছেই থাকবি। আজ থেকে তুই মুক্ত! তোর গলায় আর বেল্ট বাধা থাকবে না। তোর জন্য আর কারোর সাথে আমার ঝগড়াও বাধবে না। এই বাড়ির আর কারোর মহাভারত অশুদ্ধও হবে না।”

ছবিতে আমার সেই ধলু। এখন ধলু অনেক বড় হয়ে গেছে। থাকে আমার অফিসের সামনের মহল্লায়। আমি রোজ যেই রাস্তা দিয়ে অফিসে আসি, সেই রাস্তায় ও আমর জন্য অপেক্ষায় থাকে। সকালে ওকে অন্তত দুটি বিস্কুট না দিয়ে আর অফিসে যাওয়া যায় না। আমার ভালোবাসা ধলু আজও মনে রেখেছে। কিন্তু অনেক মানুষেই মনে রাখে না।

বাসা থেকে বের হয়ে ধলুকে নিয়ে একটা রিকশা চড়ে আমার অফিসের দিকে যাচ্ছি। অফিসের সামনেই থাকে ধলুর মা কুকুরটি। অফিস থেকে একটু সামনে রাস্তার পাশে ধলুর মা কুকুরটি বসে রিকশার দিকে চেয়ে আছে। চলন্ত রিকশা থেকেই ধলু ওর মাকে দেখে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো। ধলু গলার ওয়াজ ওর মায়ের কানে পৌঁছা মাত্রই, ওর মা দৌড়ে সামনে আসতে লাগলো। আমি রিকশাওয়ালা ভাইকে বললাম,”ভাইজান আপনার রিকশা এখানে থামান!” রিকশা থামতে দেরি, ধলু রিকশা থেকে লাফ দিতে আর দেরি করেনি। ওর মা কুকুরটিও সামনে এসে ধলুকে চুমাইতে লাগলো। ধলুও ওর মাকে চুমাইতে লাগলো। এভাবেই অনেকক্ষণ চলছিল মনের আনন্দে মা ছেলের লাফা-লাফিও। আমি রিকশায় বসেই অনেকক্ষণ দেখলাম! এরপর ধলু আমার দিকে একনজর চেয়ে ওর মায়ের সাথে লাফাতে লাফাতে এক বাড়ির চিপায় ঢুকে গেলো। আমি দুই চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার অফিসে চলে গেলাম।

এরপর থেকে ধলু আস্তে আস্তে হাতে-পায়ে বড় হতে লাগলো। আমিও অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝে ধলুকে ফলো করি। খাবার কিনে দেই। আদর করি। ধলুও যেসময় যেখানেই আমাকে দেখে, সামনে আসে। ঘেউ ঘেউ করে মনের ভাব প্রকাশ করে। খাবারের আবদার করে। না দেওয়া পর্যন্ত সামনেই বসে থাকে। দোকান থেকে রুটি অথবা বিস্কুট কিনে দিলে খায়! সাথে ওর মা কুকুরটিও খায়। আমার সামনে অন্য কোনও কুকুর দেখামাত্র ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে দেয়। অন্য কুকুরগুলো যাতে আমাকে কামড় না দিতে পারে, তাই ও ঘেউ ঘেউ করে আমার সামনে থাকে অন্য কুকুরদের তাড়িয়ে দেয়। বর্তমানেও ধলু যেন আমার খুবই আপন। আমাকে দেখা- শোনার দায়দায়িত্বই যেন ধলুর উপর ন্যস্ত! আমি যতক্ষণ পর্যন্ত অফিসে থাকি, ধলু আমাকে সবসময় ওর চোখে চোখেই রাখে। যাতে আমার কোনরকম ক্ষতি না হয়। অফিস থেকে বের হলেই ধলু লেজ নেড়ে আমার সামনে আসে। চোখে চোখ রাখে। খাবার চায়! তাই আমাকে ধলুর সময় অসময়ের আবদার রাখতেই হচ্ছে।

রাতে যতক্ষণ আমি আমার অফিসে থাকি, ধলু আমার অফিসের সামনেই শুইয়ে থাকে। বাসায় ফেরার সময় অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত আরও কয়েকটি কুকুর সাথে নিয়ে আমাকে আগাইয়া দেয়। ওর এই ডিউটি খাবার দিলেও করে, না দিলেও করে। আমার সাতদিনের ভালোবাসা আজও ধলু ভুলতে পারেনি। আর একটা মানুষকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছরও সাথে রেখেছি, খাওয়াইয়াছি। শেষতক মনে রাখেনি। মানুষটির সময় আর সুযোগ পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথেই, পেছনের কথাগুলো ভুলে গিয়েছে। অথচ আমার সাতদিনের ভালোবাসা ধলু আজও ভুলতে পারেনি। অনেক বড় হয়েও, সেই ভালোবাসা ওর মনে রেখে নিঃস্বার্থে আমাকে ভালোবেসে যাচ্ছে। অথচ অনেক মানুষই তা মনে রাখেনি।

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ