হিমেল

মুহাম্মদ শামসুল ইকরাম পিরু ১৫ নভেম্বর ২০১৩, শুক্রবার, ১১:০৯:১৮অপরাহ্ন গল্প, সমসাময়িক ২৮ মন্তব্য

ফিরে যাচ্ছে সে এখন । হতাশায় চিবুক বুক স্পর্শ করে আছে। স্বপ্ন চুরমার , বর্ণিল স্বপ্ন গুলোর টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চতুর্দিকে । গায়ের হলুদ পাঞ্জাবীর রং লোমকূপ থেকে শরীরের অভ্যন্তর ঠাই নিচ্ছে দ্রুত , ধীরে ধীরে শরীরের রং পাল্টে যাচ্ছে , একটি সময়ে হয়ে গেলো হলুদ ।
এয়ার হোস্টেস বার কয়েক চেষ্টা করেও তাঁর হাতে কিছু দিতে পারেনি। নাস্তা , চা , কফি , জুস , বিয়ার বা হার্ড ড্রিংকস কিছুই নিচ্ছে না সে , লাঞ্চ বক্স এর দিকে ফিরেও তাকায়নি। এমন কেন এই যুবক ?
সেই যে এসে বসেছে সিটবেল্ট পর্যন্ত খোলেনি । হতাশা মনে হয় সংক্রামক । এয়ার হোস্টেস নিজেই আগ্রহী হয়ে পরেছে এই যুবকের দিকে। অসুস্থ কি সে ? গভীর মমতায় সিট বেল্ট খুলে দিয়ে , গায়ে একটি কম্বল জড়িয়ে দিল । কোন ভাবান্তর নেই যুবকের। চোখ খোলা , নীচের দিকে তাকানো , কম্বল জড়ানোর সময় ইচ্ছে করেই নীচ থেকে উপরের দিকে তাকিয়েছিল সুন্দরী এয়ার হোস্টেস । চোখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই , চোখের সামনে একটি মেয়ে , অথচ সে চোখ তাঁকে দেখছেনা। মুহুর্তের জন্য এয়ার হোস্টেসের  মনে হলো যুবকের শরীরের রং হলুদ । কিছুটা ভয় পেলেও সামলে নিলো  নিজকে । কিছুক্ষণ পরপর দেখে যাচ্ছে সে এই হতাশা গ্রস্থ যুবককে।

হিমেলের জন্ম জার্মানি । সে এখন ২০ বছরের যুবক । তাঁরা বাবা ৭৬ সন থেক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে আছে । মা জার্মান । এই প্রথম সে বাবা মায়ের সাথে বাংলাদেশে এসেছে । বাবা ছিলেন ১৯৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা । ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই বাবা জার্মান চলে আসেন । প্রথম দু বছর বন এ ছিলেন , এরপর ফ্রাংকফুর্টে এসে স্থায়ী হন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে হিমেল বাবার কাছেই । পাকিস্তানি সেনাবাহিনী , রাজাকার , আলবদর , আল-সামসদের হত্যা , ধর্ষণ , লুটপাট , অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা শুনে শিউরে উঠেছে হিমেল বার বার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হত্যা আর বীভৎসতাকেও হার মানিয়েছে বাংলাদেশের ১৯৭১ এর জেনোসাইড ।

জার্মান এবং সমমনা দেশ সমুহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবতা বিরোধী অপরাধের কারনে , নাৎসি নেতাদের বিচার হয়েছে যুদ্ধের পরপরই । এখনো খোজা হচ্ছে পলাতক নাৎসিদের । নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ । তাদের সাধারন নাগরিক সুবিধা দেয়া হয়নি , এখনো হচ্ছেনা । নাৎসিদের সমর্থনে কেউ রাজনীতি করতে পারেনা। সমর্থনকারীদের নাৎসি হিসেবে সনাক্ত করা হয়। রাজনীতি তো দুরের কথা , কোন মহল্লায় সামান্য ক্লাব পর্যন্ত করতে দেয়া হয়না , নাৎসি নীতি ধারনকারীদের ।

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে হিমেল বাবার দেশে এসেছিল । ঘুরে ঘুরে দেখবে জাতির গৌরবোজ্জ্বল স্থাপনা সমূহ । দেখবে জাতীয় শহীদ মিনার , সরোওয়ার্দি উদ্যান , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন , অপারেজয় বাংলা , সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ , বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং অন্যান্য স্থাপনা ।

হরতালের আগের দিন এসে নামলো ঢাকায়। আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে প্রথম দিন আর বের হওয়া হয়নি। এরপর বাসায় আটকে থাকলো হরতালে। হরতালে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে নিরীহ শিশু ও সাধারন জনতা । টিভি নিউজে দেখে দেখে আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে জেনে আঁতকে উঠে সে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী এবং এর সমর্থনকারী এই আন্দোলন করছে ? যাদের এদেশে রাজনীতি করার কোন সুযোগ থাকার কথা নয় তারা ? বাবাতো এসব কথা কোনদিন বলেনি ! এ নিয়ে বাবার সাথে আলাপ করলে বাবা বলেন যে , বাঙালীর এই ব্যর্থতার কথা হিমেলের কাছ থেকে লজ্জায় গোপন করেছেন তিনি।

হিমেল বিমর্ষ তখন থেকেই । অভিমান , ঘৃণা , ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে দেশের জনগনের উপরেও। কেমন মানুষ এরা ? কিভাবে এদের ক্ষমতায় বসায় ? এমন দেশের কোন মনুমেন্ট এ যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে হিমেল । টিকেটের দিন এগিয়ে আনে । একা ফিরে যাচ্ছে সে । বাবা মা কিছুদিন পরে আসবেন।

হাটুর উপর কারো হাতের চাপ অনুভব করায় এই প্রথম দৃষ্টি দেয় সে । একটি হাসিমাখা মুখ । এয়ার হোস্টেস জেনি।

২০৪৩ সাল । ঢাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর একটি প্লেন এর দরজা খুললো । হলুদ পাঞ্জাবী , হলুদ শাড়ি আর হলুদ জ্যাকেট পরিহিত তিনজন মানুষ নেমে এলেন গর্বিত ভাবে । হিমেল , জেনি আর তাঁদের মেয়ে নদী ।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ